বিজয়ের মাস ডিসেম্বর কয়েকদিন পেরিয়ে গেলেও সেই বোমার খোলসটি এখনো পর্যন্ত রং করা হয়নি। অযত্নে অবহেলায় রাখা রয়েছে ঈশ্বরদী উপজেলার পাকশি বিভাগীয় রেলওয়ে ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) দপ্তরের সামনে।
সেদিন যেভাবে হার্ডিঞ্জ ব্রিজে বোমা হামলা করা হয়েছিল তার বর্ণনা করছিলেন পাকশির তৎকালীন কয়েক ছাত্রনেতারা। প্রত্যক্ষদর্শী তৎকালীন পাকশি শহর ছাত্রলীগের সহ-সভাপতি এবং বর্তমানে পাকশি ইউনিয়ন পরিষদের প্রাক্তন চেয়ারম্যান, মুক্তিযোদ্ধা, হাবিবুল ইসলাম হবিবুল বাংলানিউজকে জানান, চারদিক থেকে তখন বিজয়ের খবর আসছিল। যদিও ঈশ্বরদী তখন মুক্ত হয়নি। ঈশ্বরদীজুড়ে ১০টি অপারেশন ক্যাম্প যুদ্ধের জন্য প্রস্তুত ছিল।
যশোর ও কুষ্টিয়া মুক্ত হওয়ার পর পালিয়ে পাকিস্তানি সেনারা পাকশী হার্ডিঞ্জ ব্রিজ হয়ে ঈশ্বরদীর দিকে আসছিল। পাকিস্তানি সেনা শত্রুদের মোকাবেলা করার জন্য আমরা ঈশ্বরদীর চরসাহাপুরে প্রকৌশলী আব্দুল গফুরের বাড়ির সামনের রাস্তায় অবস্থান করছিলাম। খবর পেলাম পাকিস্তানি হানাদাররা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ পার হচ্ছে। তারা ব্রিজে নাকি ডিনামাইট (চার্জ) লাগিয়ে বিদ্যুৎ সংযোজন করে রেখেছিল। আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) প্রস্তুত ছিলাম যে অবস্থা বেগতিক দেখলে ব্রিজটি উড়িয়ে দেবো। হঠাৎ দেখি পাকশী রেল টানেল ও বাঘইল রেল টানেলের মাঝামাঝিতে বসে ৩০ জন পাকিস্তানি সেনা কাঁচা বেগুন খাচ্ছে।
তখন তারা বেশ ক্ষুধার্ত ছিল বলে মনে হয়েছিল। মুক্তিযোদ্ধারা ঈশ্বরদী-কুষ্টিয়া সড়কে অবস্থান নিয়ে তাদের আত্মসমর্পণের আহ্বান জানালে পাকিস্তানি সেনারা কর্ণপাত না করে গুলি ছুড়তে থাকে। মুক্তিযোদ্ধারাও পাল্টা গুলি চালালে পাকিস্তানি সেনারা মুক্তিযোদ্ধাদের ওপর আক্রমণ শুরু করে দেয়। একপর্যায় মুক্তিযোদ্ধারা সংগঠিত হয়ে গ্রামের চারপাশ দিয়ে পাকিস্তানি সেনাদের ঘিরে ফেলে। বেপরোয়া হয়ে ওঠে পাকিস্তানি সেনারা। তখন হার্ডিঞ্জ ব্রিজের ওপর দিয়ে ট্যাংক, কামান ও জিপ নিয়ে পার হতে থাকে। এ পরিস্থিতিতে আমাদের দমদম মিত্র বাহিনীর সঙ্গে সার্বক্ষণিক যোগাযোগ ছিল। সে সময় আমাদের কমান্ডাররা ওয়্যারলেসের মাধ্যমে বিমানবাহিনীর সহযোগিতা চাই।
তৎকালীন পাবনা অ্যাডওয়ার্ড কলেজ ছাত্রলীগের সহসাধারণ সম্পাদক (এজিএস), বর্তমানে উত্তরবঙ্গের প্রখ্যাত শ্রমিক নেতা মোহাম্মদ রশীদুল্লাহ্ বাংলানিউজকে বলেন, কুষ্টিয়া মুক্ত হওয়ার পর পাকিস্তান সেনারা হার্ডিঞ্জ ব্রিজ অতিক্রম করে ঈশ্বরদী অভিমুখে আসতে শুরু করে। খবর পেয়ে আমরা (মুক্তিযোদ্ধারা) মুখোমুখি হতেই দু’পক্ষের মধ্যে গুলিবর্ষণ শুরু হয়। এ সময় পাকসেনারা তাদের ওয়ার্লেসের সাহায্যে পজিশন জানায়। তখন ৪২৪২ স্পষ্ট শোনা যাচ্ছিল। কিছুক্ষণ পরই তাদের উদ্ধারের জন্য রেসকিউ বাহিনী এসে আমাদের লক্ষ্য করে গুলি শুরু করে। এই সম্মুখযুদ্ধে আমরা ওই দিন পিছু হটতে বাধ্য হলেও কয়েকজন পাকসেনা নিহত হয়। সেদিন আমরা বাঘইল গ্রামে পাকশি কাগজ কল ব্যগাজ ইয়ার্ডের সামনে অবস্থান নিয়েছিলাম। দুপুর ১২টার দিকে পাকশির আকাশ দিয়ে ভারতীয় পাঁচটি যুদ্ধবিমান হার্ডিঞ্জ সেতুর ওপর দিয়ে চক্কর দিতে থাকে।
এরপর বিমান থেকে বোমাবর্ষণ শুরু। বোমার প্রচণ্ড আঘাতে ব্রিজের ১২ নম্বর স্প্যানটির ওপর আঘাত হানলে বোমার আওয়াজে আমরা চমকে ওঠি। ১২ নম্বর স্প্যানের একদিকের অংশ বিকট আওয়াজে ভেঙে পানিতে পড়ে যায়। দলবদ্ধ ও অ্যাম্বুশ ভেঙে পাকিস্তানি সেনারা পাকশি থেকে পালিয়ে যেতে শুরু করে। সেদিন আরও একটি বোমা ফেলা হয়েছিল পাকশি রেলস্টেশন প্ল্যাটফর্ম থেক ৫০ গজ অদূরে ব্রিজের পশ্চিমে বালুচরের মধ্যে। আরেকটি বোমা পড়েছিল রেললাইনের ওপরে। পরবর্তীতে সেনাবাহিনীর সহযোগিতা নিয়ে ওই বালুর ভেতরে বিস্ফোরণ ঘটানো হয়। যে বোমার খোলস আজও মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবহন চলেছে তরুণ প্রজন্মের কাছে। যা পাকশি ডিআরএম চত্বরের সামনে রেলওয়ে কর্তৃপক্ষ সংরক্ষণ করে রেখেছে।
পশ্চিমাঞ্চল রেলওয়ের পাকশি বিভাগীয় ব্যবস্থাপক মোহাম্মদ আহছানউল্লা ভূঞা বাংলানিউজকে বলেন, মহান মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি ধরে রেখে বোমার খোলসটি এখনো সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। পাকশি বিভাগীয় রেলওয়ের প্রধান দফতরের সামনে। নিরাপত্তাবেষ্টনির ভেতরে বোমার খোলসটি দেখার জন্য এখনো দুরদূরান্তর থেকে অনেক দর্শণার্থী আজও দেখতে আসে।
তিনি বলেন, লোহার তৈরি খোলসটির ওজন প্রায় দুই মণ। খোলসটি রং করে সিমেন্টের বেদিতে গাঁথা রয়েছে। সেই সময় ওই ঘটনার সাক্ষী হিসেবে ঐতিহাসিক মহান মুক্তিযুদ্ধের এই স্মৃতি বর্তমান তরুণ প্রজন্মের কাছে কালের সাক্ষী।
এই প্রজন্মের যারা মহান মুক্তিযুদ্ধ দেখেনি, মহামুক্তিযুদ্ধের স্মৃতি যারা লালন করেন, ধারণ করেন এবং পরবর্তী প্রজন্মের কাছেও যেন শুধুই স্মৃতি থাকবে। ধ্বংসপ্রাপ্ত বোমার খোলসটি আজও পাকশি বিভাগীয় রেলওয়ের ব্যবস্থাপক (ডিআরএম) চত্বরের সামনে কালের সাক্ষী হিসেবে সংরক্ষণ করে রাখা হয়েছে। সবসময়ই দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে দর্শণার্থীরা এই বোমার খোলসটি দেখতে এসে ফিরে যান মহান মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোর স্মৃতিতে। যা চিরদিনই অম্লান হয়ে থাকবে।
মহান মুক্তিযুদ্ধের ঈশ্বরদীর ইতিহাস ও ঐতিহ্যের ধারক ‘হার্ডিঞ্জ ব্রিজ’ এশিয়ার দ্বিতীয় বৃহত্তর রেলসেতু। স্বাধীনতা যুদ্ধে সেতুর ১২ নম্বর গার্ডার ক্ষতিগ্রস্ত হয়। ক্ষতিগ্রস্ত ১২ নম্বর গার্ডার স্বাধীনতার পর ১৯৭৫ সালে তৎকালীন বঙ্গবন্ধু সরকার ভারত সরকারের সহযোগিতায় ব্রিজের মূল আদলে আরেকটি গার্ডার প্রতিস্থাপন করা হয়। পরবর্তীতে ১৯৭৫ সালের ৫ আগস্ট এই সেতু দিয়ে পুনরায় ট্রেন চলাচল শুরু হয়।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৩০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৩, ২০১৯
এনটি