র্যাব সূত্র জানায়, শাকিল মাজহার উচ্চ রক্তচাপের সমস্যায় ভুগছিলেন, তবে তিনি হাসপাতালে ভর্তি হওয়ার মতো অবস্থায় ছিলেন না। তিনি জানতেন গ্রেফতার সম্রাট বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর মেডিক্যাল বিশ্ববিদ্যালয় (বিএসএমএমইউ) হাসপাতালের সিসিউইতে চিকিৎসাধীন।
শনিবার (২২ জানুয়ারি) ভোরে রাজধানীর মোহাম্মদপুর এলাকা থেকে মাজহার শাকিলকে আটক করে র্যাব-২। এ সময় তার কাছ থেকে ২টি বিদেশী পিস্তল, ২টি ম্যাগাজিন ও ৬ রাউন্ড গুলি উদ্ধার করা হয়।
র্যাব জানায়, টানা ক্যাসিনো বিরোধী অভিযানের কারণে আন্ডারওয়ার্ল্ডে অস্থিরতা সৃষ্টি হয়েছে। বর্তমানে দেশের কোথাও ক্যাসিনো নেই। এর একটি প্রভাব আন্ডারওয়ার্ল্ডে পড়েছে। সিটি নির্বাচনকে সামনে রেখে জিসানের পরিকল্পনা বাস্তবায়নে শাকিল গত ১২ জানুয়ারি দুবাই থেকে দেশে আসেন।
পরে শাকিল বিএসএমএমইউ-তে রোগী সেজে ভর্তি হন। সেখানে ভর্তির উদ্দেশ্য ছিল হাসপাতালের কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা সৃষ্টি করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দেওয়া।
র্যাবের ঊর্ধ্বতন এক কর্মকর্তা বাংলানিউজকে জানান, গ্রেফতার সম্রাটকে খুনের পরিকল্পনা ছিল শাকিলের। এজন্য শাকিল হাসপাতালের একটি ভবনের চারতলায় এইচডিইউতে ভর্তি হন। যে ভবনের দ্বিতীয় তলায় সম্রাট চিকিৎসাধীন রয়েছেন।
নিজের পরিকল্পনা অনুযায়ী শাকিল বেশ কয়েকবার সম্রাটের ইউনিটের সামনে লোকজনসহ ঘোরাফেরাও করেন। সম্রাটের অবস্থান রেকি করতেই তিনি সেখানে ঘোরাফেরা করেছেন। তার উদ্দেশ্য ছিল সম্রাটকে গুলি করে খুন করা। তবে হাসপাতালেই খুনের পরিকল্পনা ছিল কি-না বিষয়টি এখনো পরিস্কার নয়।
হাসপাতালে কোনো অনাকাঙ্খিত ঘটনা সৃষ্টি করে জনমনে আতঙ্ক ছড়িয়ে দিতে চেয়েছিলেন শাকিল। তবে র্যাবের তৎপরতায় তার এই হীন চেষ্টা ব্যার্থ হয়।
র্যাবের ওই কর্মকর্তা বলেন, দেশে ফেরার পর থেকেই শাকিলের গতিবিধি নজরদারী করতে থাকে র্যাব। হাসপাতালে সম্রাটের ইউনিটের সামনে দিয়ে ঘোরাফেরা করার সময় সম্রাট নিজেও শাকিলকে শনাক্ত করতে সক্ষম হন।
র্যাব জানায়, শাকিল হাসপাতালে ভর্তি হলেও ২০-২১ তারিখের মাঝামাঝি কোনো এক সময় কাউকে না বলেই হাসপাতাল থেকে চলে যান। অবশেষে শনিবার ভোরে মোহাম্মদপুর থেকে শাকিলকে আটক করা হয়।
কে এই শাকিল
২০০৫ সালে জগন্নাথ বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় ছাত্র রাজনীতি শুরু করেন শাকিল। পরবর্তিতে ঢাকা মহানগর ছাত্র রাজনীতির সঙ্গে জড়িত হন। ২০০৯ সাল থেকে বিভিন্ন টেন্ডার বাণিজ্যে জড়িয়ে পড়েন। এভাবে ২০১০-২০১২ সাল পর্যন্ত টেন্ডার বাণিজ্যে জড়িত ছিলেন তিনি। এ সময় ক্যাসিনো অভিযানে অপর গ্রেফতার সাবেক যুবলীগ নেতা খালেদ মাহমুদের সঙ্গে বিরোধের জেরে ২০১৩ সালে গ্রামের বাড়ি ফেনী চলে যান।
২০১৫ সালে পুনরায় ঢাকায় এসে রাজনীতি শুরু করেন। তখনও রেলওয়ের টেন্ডার বাণিজ্য নিয়ে খালেদের সঙ্গে বিরোধে জড়িয়ে পড়েন। এ সময় ক্যাসিনো অভিযানে আরেক গ্রেফতার সাবেক যুবলীগ নেতা জি কে শামীমের সঙ্গে সখ্যতা গড়ে ওঠে তার।
২০১৬ সালের জুন মাসে ঢাকা মহানগর দক্ষিণ যুবলীগের সহ-সম্পাদক রাজীব হত্যার এজাহারে নাম আসার চারদিন পরে শাকিল চীন চলে যান। ২০১৭ সাল পর্যন্ত তিনি সেখানেই বসবাস করেন এবং কার্গো সার্ভিসে কাজ করেন। ২০১৮ সালে চীন থেকে তিনি দুবাই চলে যান এবং ২০২০ সালের জানুয়ারি পর্যন্ত সেখানেই ছিলেন। আর সেখানেই জিসানের সঙ্গে তার পরিচয় হয় এবং তার সঙ্গে সখ্যতা গড়ে উঠে।
দুবাইয়ে অবস্থানকালীন জিসানের সকল ব্যবসা দেখাশোনার সুযোগ পান শাকিল। জিসানের দেওয়া আবাসিক ফ্ল্যাটে বসেই দেশে জিসানের সহোযোগীদের সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যমে চাঁদাবাজিসহ বিভিন্ন সন্ত্রাসী কার্যক্রম অব্যাহত রাখেন তিনি।
ক্যাসিনো অভিযানের ফলে আন্ডারওয়ার্ল্ডে শূন্যতা তৈরি হয়। সেই শূন্যতা পূরণ করে পুনরায় আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতেই জিসানের নির্দেশনায় জানুয়ারিতে শাকিল দেশে ফিরেন।
জিসান কোথায়?
কয়েকমাস আগে শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানকে ইন্টারপোল গ্রেফতার করেছে বলে জানা যায়। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনতে সবধরনের তৎপরতার কথাও জানায় দেশের আইন-শৃঙ্খলা রক্ষাকারী বিভিন্ন বাহিনী। তবে সংশ্লিষ্টদের ধারনা, জিসান দুবাইতে গ্রেফতার হলেও কোনো প্রক্রিয়ায় তিনি আবার ছাড়া পেয়েছেন। ছাড়া পেয়ে স্বভাবিকভাবেই নিজের আন্ডারওয়ার্ল্ড নিয়ন্ত্রণের চেষ্টা চালিয়ে যাচ্ছেন তিনি।
এদিকে, বিএসএমএমইউ থেকে গত ২০ ফেব্রুয়ারি রাত থেকে হাসপাতালে ভর্তি শাকিলকে পাওয়া যাচ্ছিল না বলে শাহবাগ থানায় একটি জিডি করেছেন তার চাচাতো ভাই ফাহিম মাহমুদ।
ফাহিম মাহমুদ বলেন, শাকিলের হার্টের সমস্যা রয়েছে এবং ব্লাড প্রেশারও বেশি। মাথা ঘুরে পড়ে গেলে গত ১৯ ফেব্রুয়ারি তাকে প্রথমে ধানমন্ডির একটি হাসপাতালে নেওয়া হয়। পরে ২০ ফেব্রুয়ারি সকালে নেওয়া হয় বিএসএমএমইউতে। ওইদিন রাত সাড়ে ১১টার দিকে শাকিল ও তার দেখাশোনার দায়িত্বে থাকা শাওনকে কে বা কারা তুলে নিয়ে যায়। এরপর আমরা হাসপাতালের কোনও সহযোগিতা না পেয়ে শাহবাগ থানায় একটি সাধারণ ডায়েরি (জিডি-১৪৮০) করি। পরে বিভিন্ন জায়গায় খোঁজাখুঁজি করেও তাদের পাওয়া যায়নি।
শাকিল আটক প্রসঙ্গে তিনি বলেন, শাকিল একজন হার্টের রোগী, পিজি হাসপাতালের (বিএসএমএমইউ) ৪র্থ তলায় কার্ডিওলোজি বিভাগের ১৩ নম্বর বেডে সে ভর্তি ছিল। আমার প্রশ্ন হচ্ছে- ওনি (শাকিল) হার্টের রোগী, ওনি কি করে হাসপাতাল থেকে সেখানে (মোহাম্মদপুর) গিয়ে অস্ত্রসহ ধরা খায়?
র্যাবের লিগ্যাল এন্ড মিডিয়া উইংয়ের পরিচালক লে. কর্নেল সারওয়ার বিন কাশেম বলেন, শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের নির্দেশ ও সহযোগিতায় দেশে নতুন করে সন্ত্রাসী কার্যক্রম প্রতিষ্ঠা করতে শাকিল দেশে এসেছেন।
শীর্ষ সন্ত্রাসী জিসানের অবস্থান সম্পর্কে জানতে চাইলে তিনি বলেন, আমরা ইন্টারপোলের মাধ্যমে জানতে পেরেছি জিসানকে গ্রেফতার করা হয়েছে। তাকে দেশে ফিরিয়ে আনার জন্য যে প্রক্রিয়াগুলো রয়েছে তা চলমান। তবে এ বিষয়ে শাকিলের কাছ থেকে কোনো স্পষ্ট ধারণা পাওয়া যায়নি।
আরও পড়ুন- আন্ডারওয়ার্ল্ডের নিয়ন্ত্রণ নিতেই জিসানের সহযোগী দেশে
বাংলাদেশ সময়: ০২৩৫ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৩, ২০২০
পিএম/এমএইচএম