মহামারিতে মানুষের জীবনের আশঙ্কার পাশাপাশি অর্থনৈতিক ক্ষেত্রেও নেতিবাচক প্রভাব পড়ছে। আর দক্ষিণ এশিয়াসহ বিশ্বের আরো কিছু দেশে একই সঙ্গে দুর্ভিক্ষের আশঙ্কাও করেছে জাতিসংঘ।
করোনার ছোবলে শুধু মানুষের মৃত্যুই হচ্ছে না, এই পরিস্থিতি বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থা ভেঙে পড়ার উপক্রম। এর প্রভাবে ব্যবসা-বাণিজ্য, পর্যটন, বিনোদন, যোগাযোগ ব্যবস্থা, ব্যাংক ও বিমা খাত এবং কলকারখানার উৎপাদন স্থবির হয়ে পড়েছে। প্রতিঘাত হিসেবে প্রতিদিন লাখ লাখ কর্মী বেকার হয়ে পড়ছে।
দেশি-বিদেশি বিশেষজ্ঞরা বলছেন, করোনাত্তোর বিশ্ব অর্থনৈতিক ব্যবস্থায় ব্যাপক মন্দা দেখা দিতে পারে। কেউ কেউ একে আবার ‘মহামন্দা’ও বলছেন। কোনো কোনো দেশে দুর্ভিক্ষও দেখা দেবে। কারণ ইতোমধ্যে কিছু দেশে পঙ্গপালের আক্রমণও হচ্ছে।
অদৃশ্য করোনার প্রভাব বাংলাদেশের অর্থনীতিতেও দৃশ্যমান হয়ে পড়েছে। বাংলাদেশের গার্মেন্টস শিল্প ও প্রবাসী শ্রমিকদের পাঠানো অর্থে নেতিবাচক প্রভাব এখন স্পষ্ট। পাশাপাশি অনলাইনে আউটসোর্সিংয়ের আয়ও মুখ থুবড়ে পড়েছে।
লকডাউনে কর্মহীন কলকারখানার চাকা বন্ধ থাকায় প্রতিদিন হাজার হাজার শ্রমিক বেকার হয়ে গ্রামে ফিরে যাচ্ছেন। এসব বেকার মানুষের দুর্দিনে তাদের পাশে দাঁড়ানো রাষ্ট্রের চ্যালেঞ্জ বলে মনে করছেন বিশ্লেষকরা। পাশাপাশি হটস্পট দেখে লকডাউন সীমিত করারও সুপারিশ আসছে।
গত ২৬ মার্চ থেকে বাংলাদেশে সাধারণ ছুটি ঘোষণা করা হয়, কার্যত লকডাউন পরিস্থিতে গণপরিবহন, উৎপাদনমুখী কলকারখানা বন্ধ রয়েছে। সাধারণ মানুষের জীবন ব্যবস্থায় ছন্দপতনই কেবল ঘটেনি, ক্ষুধার জ্বালায় অনেক স্থানে মিছিল-সমাবেশ হচ্ছে।
এই অর্থনৈতিক দুরাবস্থায় বাংলাদেশ আপাতত দুর্ভিক্ষে না পড়লেও সেই অবস্থায় যে পাল্লা ভারী হচ্ছে তা হাওরে ধান তোলার অব্যবস্থাপনাতেই ধরা পড়ছে। কারণ সেখানে দেখা দিয়েছে শ্রমিক সংকট।
জাতিসংঘ সম্প্রতি এক প্রতিবেদনে বলছে, করোনা ভাইরাস মহামারির কারণে বিশ্ব বড় রকমের দুর্ভিক্ষের ঝুঁকিতে রয়েছে। বিশ্বব্যাপী ক্ষুধা ও দারিদ্র বেড়ে যাবে। এই মন্দায় ১৩৫ থেকে ২৫০ মিলিয়নেরও বেশি মানুষ ভুগবে।
বিশ্ব খাদ্য সংস্থা বলছে, বিভিন্ন যুদ্ধ-সংঘাত, অর্থনৈতিক সংকট এবং জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত ১০ দেশ বেশি ঝুঁকিতে রয়েছে। সংস্থাটি তাদের চতুর্থ বার্ষিক গ্লোবাল প্রতিবেদনে ইয়েমেন, গণতান্ত্রিক প্রজাতন্ত্র কঙ্গো, আফগানিস্তান, ভেনেজুয়েলা, ইথিওপিয়া, দক্ষিণ সুদান, সুদান, সিরিয়া, নাইজেরিয়া এবং হাইতির নাম উল্লেখ করেছে।
জাতিসংঘ আরো বলছে, দক্ষিণ সুদানের ৬১ শতাংশ জনগণ গতবছর খাদ্য সংকটে ছিল। মহামারির আগেও পূর্ব আফ্রিকা ও দক্ষিণ এশিয়ার বিভিন্ন অঞ্চলে খরা এবং পঙ্গপালের আক্রমণে খাদ্য সংকট দেখা দেয়।
বিশ্বব্যাংকের পূর্বাভাষে বলা হয়েছে, করোনা মহামারির কারণে বাংলাদেশসহ দক্ষিণ এশিয়ার আটটি দেশে এ বছর অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি অর্জিত হবে শতকরা ১ দশমিক ৮ শতাংশ থেকে ২ দশমিক ৮ শতাংশের মধ্যে। অথচ ৬ মাস আগেও এই প্রবৃদ্ধির হার ৬ দশমিক ৩ শতাংশের কথা বলা হয়েছে।
বিশ্বব্যাংকের এই পূর্বাভাষ যদি সত্যি হয় তাহলে এটাই হবে এ অঞ্চলের দেশগুলোর গত ৪০ বছরের মধ্যে সবেচেয়ে খারাপ আর্থিক পারফরমেন্স।
আর লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে বিশ্বব্যাংকের ওই প্রতিবেদনে হুঁশিয়ারি দিয়ে বলা হয় যে, অর্থনৈতিক এই মন্দা অবস্থা ২০২১ সাল পর্যন্তও বিস্তৃত হতে পারে। এ সময়ে প্রবৃদ্ধি শতকরা ৩ দশমিক ১ শতাংশ থেকে ৪ শতাংশ অর্জিত হতে পারে। আগে এই প্রবৃদ্ধি ধরা হয়েছিল শতকরা ৬ দশমিক ৭ শতাংশ।
বাংলাদেশের অর্থনৈতিক প্রবৃদ্ধি গত অর্থবছরে ছিল ৮ দশমিক ২ শতাংশ। এই বৈশ্বিক সংস্থার পূর্বাভাসে শুধু এবছর নয়, আগামী অর্থবছরে তা আরও কমে দাঁড়াবে ১ দশিমিক ২ থেকে ২ দশমিক ৯ শতাংশ। ২০২১-২০২২ অর্থবছরে একটু ঘুরে দাড়াঁলেও তা ৪ শতাংশের নিচেই থাকবে।
লকডাউনে বাংলাদেশের সম্ভাব্য অর্থনৈতিক ক্ষতির একটি প্রাথমিক ধারণা দিয়েছেন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের একদল গবেষক।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদের নেতৃত্বে ‘অর্থনীতিতে করোনার প্রভাব’ শীর্ষক এক সমীক্ষা প্রতিবেদন প্রকাশ করে মঙ্গলবার তারা জানিয়েছে, এক মাসে বাংলাদেশের অর্থনৈতিক ক্ষতি এক লাখ কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে। লকডাউন দীর্ঘায়িত হলে প্রতিদিনের ক্ষতির পরিমাণ আরো বাড়বে। আর দিনে ৩ হাজার ৩শ কোটি টাকার মতো ক্ষতি হচ্ছে।
অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বাংলানিউজকে বলেন, আপাতত আমরা দুর্ভিক্ষের উপর জোর দিয়ে মানুষের মধ্যে আতঙ্ক তৈরি করতে চাই না।
দুর্ভিক্ষ দু’ভাবে হয় জানিয়ে তিনি বলেন, খাবারের অভাবে হয়। খাবার আছে কিন্তু মানুষ জানতে পারে না যে পর্যাপ্ত খাদ্য আছে কিন্তু বিলি হয় না ঠিকভাবে। আরেকটা হয় টাকা আছে কিন্তু খাবার নেই।
তিনি বলেন, ফসলটা ঠিকভাবে যদি তুলতে পারি সমস্যাটা হবে না। এজন্য ফসল তুলতে পারার উপর গুরুত্ব দিচ্ছি। সরকারি ব্যবস্থাপনায় ধান কাটার ব্যবস্থা করতে হবে, শ্রমিকদের বিভিন্ন এলাকা থেকে নিয়ে আসা এবং স্কুলগুলোতে থাকার ব্যবস্থা করতে হবে। ধান কাটার পয়সাটাও সরকার দিতে পারে, কারণ ধান বেচতে পারছে না, যেন মজুরি পরিশোধ করতে পারে।
খাদ্যাভাব এড়াতে ফসল আহরণ ও সঠিক ব্যবস্থাপনার উপর গুরুত্ব দিয়েছেন সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের অর্থ উপদেষ্টা ড. এ বি মির্জ্জা আজিজুল ইসলাম।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, বিশ্বে মহামন্দার বিষয়টি ঠিক আছে, তবে দুর্ভিক্ষের কথা এখনও খুব বেশি বলা হয়নি। কিন্তু ঠিকমতো ব্যবস্থাপনা করতে পারলে দুর্ভিক্ষ হবে না।
তিনি বলেন, আমাদের সরকার, ব্যবসায়ী, কৃষক সবার কাছে পর্যাপ্ত মজুদ আছে। আবার বোরোর কাল্টিভেশন শুরু হয়েছে। সেখানে নতুন চাল-ধান চাল আসবে।
ড. আজিজুল বলেন, আমাদের মূল চ্যালেঞ্জ- যারা আয় বঞ্চিত হয়েছেন তাদের কীভাবে অর্থিক ও খাদ্য নিরাপত্তা দিতে পারি। এটা খাদ্যের সুষ্ঠু বিতরণের মাধ্যমে করতে হবে। এজন্য বিতরণ সুষ্ঠুভাবে হতে হবে। বিভিন্ন জায়গায় যে চাল কালোবাজারি বা চোর ধরা পড়ছে সেগুলো শক্ত হাতে নিয়ন্ত্রণ করতে হবে।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের অধ্যাপক আবুল বারকাত সম্প্রতি একটি গবেষণা প্রবন্ধ সরকারের হাতে দিয়েছে, তাতে ৬ কোটি মানুষ দারিদ্র্য এবং ক্ষুধার কবলে পড়বে বলে জানিয়েছেন।
আবুল বারকাত বাংলানিউজকে বলেন, দারিদ্র্য বাড়বে। সম্ভাব্য দুর্ভিক্ষ অবস্থা বলা হয়েছে তাতে। এজন্য মানুষ বাঁচাও কর্মসূচি গ্রহণ করতে হবে। তালিকা করতে হবে দল-মত নির্বিশেষে। বণ্টন ঠিক করতে হবে। স্বচ্ছতা নিশ্চিত করতে হবে সব জায়গায়।
স্বাস্থ্য অর্থনীতি ইনস্টিটিউটের সাবেক পরিচালক অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ বলেন, আমরা আশা করছি মে মাস শেষে অর্থনীতি ধাপে ধাপে উন্মুক্ত করা সম্ভব হবে। আর সরকার ঘোষিত প্রণোদনা প্যাকেজের সুষ্ঠু বাস্তবায়নের মাধ্যমে অর্থনীতি স্বাভাবিক অবস্থায় ফিরতে শুরু করবে।
কিন্তু যদি মে মাসের পরেও অর্থনীতি উন্মুক্ত করা সম্ভব না হয় তাহলে রাজস্ব আদায় এবং জিডিপির প্রবৃদ্ধিসহ সামগ্রিক অর্থনীতিতে এর ব্যাপক প্রভাব পড়বে, যা কাটিয়ে ওঠা অনেক কঠিন হতে পারে। ক্ষতি কাটিয়ে ওঠার উপায়গুলো তাই আগে থেকেই খুঁজতে হবে বলে জানান অধ্যাপক সৈয়দ আব্দুল হামিদ।
বাংলাদেশ সময়: ১৩১০ ঘণ্টা, এপ্রিল ২২, ২০২০
এমআইএইচ/এএ