বলছিলাম লণ্ডভণ্ড হয়ে যাওয়া ব্রাহ্মণবাড়িয়ার নবীনগর উপজেলার কৃষ্ণনগর ইউনিয়নের উত্তর লক্ষ্মীপুরের হাজিরহাটি গ্রামের কথা। এই ইউনিয়নে বাজারের আধিপত্যকে কেন্দ্র করে গত ১২ এপ্রিল চলে বর্বর হামলার ঘটনা।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা যায়, গ্রাম জুড়ে ভয়াল নৃশংসতার ছাপ। কোথাও বাড়িঘর জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। আবার কোথাও তাণ্ডব চালিয় তছনছ করে দিয়েছে বসতভিটা। চালানো হয়েছে লুটতরাজ। অনেকেই গ্রাম ছেড়ে ঠাঁই নিয়েছেন আত্মীয় স্বজনের বাসায়। যেন এক অজানা আতঙ্ক তাদের ঘিরে রেখেছে।
স্থানীয়রা জানায়, কোথাও সারিবদ্ধভাবে ছয়টি, কোথাও দুটি, আবার কোথাও একটি এমন করে প্রায় অর্ধশত বাড়িঘর ভাঙচুর ও আগুন দিয়ে জ্বালিয়ে দেওয়া হয়েছে। এমন কি বাড়ির আশপাশে থাকা ফলদ ও বনজ গাছপালাও তাদের আগুন থেকে রক্ষা পায়নি। এ যেন জাহেলিয়া যুগের বর্বরতা।
কথা হয় হামলায় দুই ঘর হারানো বৃদ্ধ শিশ মিয়ার সঙ্গে। তিনি সেই বিভীষিকাময় দিনের বর্ণনা দিতে গিয়ে অশ্রুসিক্ত চোখে বাংলানিউজকে বলেন, বাইশমজা বাজারের আধিপত্য নিয়ে কাউসার মোল্লা, কাউসার মাষ্টার ও কবির চেয়ারম্যানের নেতৃত্বে পাঁচ গ্রামের লাঠিয়াল বাহিনী দেশীয় অস্ত্র নিয়ে হামলা চালায় হাজিরহাটি গ্রামে। মুহূর্তে তাড়া ঝাঁপিয়ে পড়ে তছনছ করে দেয় বাড়িঘর। নির্বিচারে হামলা চালায় সবার উপর। চোখের সামনে বাড়িঘর আগুনে পুড়িয়ে দিলেও অসহায় হয়ে দেখা ছাড়া কিছু করার ছিল না। আমার জীবনের রোজগার ও তিন ছেলের আয়ের টাকা দিয়ে দুটি বসত ঘরটি তৈরি করেছিলাম। কয়েকশ লাঠিয়াল বাহিনী আমার দুটি ঘরে হামলা চালিয়ে আগুন লাগিয়ে দেয়। এতে ঘরে থাকা সব কিছু জ্বলে পুড়ে ছাই হয়ে যায়।
পা হারিয়ে নিহত হওয়া মোবারকের ভাই জালালের সঙ্গে কথা হলে তিনি বাংলানিউকে বলেন, ভাইয়ের ওপর হামলার খবর শুনে দিশেহারা হয়ে ছুটলেও কিছু করার ছিল না। দূর থেকে ভাইয়ের আর্তনাদ শুনেছি। কিন্তু এগিয়ে যেতে সাহস পাইনি। আমার ভাই জীবন বাঁচানোর জন্য অন্যের বাড়িতে পালিয়ে আশ্রয় নিলে সেখানেও তার শেষ রক্ষা হয়নি। ধারালো অস্ত্রের কোপে দেহ থেকে একটি পা বিচ্ছিন্ন করে নিয়ে যায়। তারা আমার ভাইয়ের কাটা পায়ের অংশ নিয়ে গ্রাম জুড়ে উল্লাসে মেতে ওঠে। আমার ভাই ঢাকায় চিকিৎসাধীন অবস্থায় পৃথিবীর মায়া ত্যাগ করে। আমি এই নির্মম ঘটনার বিচার চাই।
ঘরের এক কোনায় একমাত্র সন্তানকে নিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা নিহত মোবারকের স্ত্রী সাফিয়া বাংলানিউজকে বলেন, তারা আমার স্বামীর পা কেটে নিয়ে হত্যা করেছে। আমি আমার স্বামী হত্যাকারীদের বিচার চাই। বিচার হলেই আমার অশান্ত মন শান্ত হবে।
স্থানীয় বাসিন্দা লৎফুর রহমান খান বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয় শালিসকারদের উদাসীনতা আর একরোখা মনোভাবের কারণে দীর্ঘ বছর ধরে চলে আসা এই বিরোধের সমাধান হচ্ছে না। কিছু কিছু গ্রাম্য মোড়লদের ইন্ধনের কারণে হাজিরহাটি গ্রাম বার বার ক্ষতবিক্ষত হয়েছে। তিনি এই গ্রামকে রক্ষায় সরকারে সুদৃষ্টি কামনা করেন।
প্রসঙ্গত, হাজিরহাটি গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য গোলাম হোসেন ঐতিহ্যবাহী বাইশমজা বাজারের সভাপতি হওয়ার পর থেকেই তার প্রতিপক্ষ কাউসার মোল্লা গ্রুপের সঙ্গে বিরোধ চলছিল। এ বিরোধের জেরেই গত ১২ এপ্রিল কাউসার মোল্লার নেতৃত্বে লণ্ডভণ্ড করে দেওয়া হয় হাজিরহাটি গ্রাম। এই হামলায় নিহত হয় একজন (মোবারক)।
নবীনগর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) রনোজিৎ রায় বাংলানিউজকে বলেন, এ ঘটনায় পৃথক দুটি মামলা হয়েছে। একটির বাদী পুলিশ অপরটির নিহত মোবারকের স্ত্রী। এ দুটি মামলায় এখন পর্যন্ত ৬৫ জনকে গ্রেফতার করা হয়েছে। পরিস্থিতি শান্ত রাখতে এলাকায় অস্থায়ী পুলিশ ক্যাম্প বসানো হয়েছে।
আরও পড়ুন>
** নবীনগরে পা কেটে নেওয়া সেই মোবারকের মৃত্যু
** পা কেটে মিছিল: দুই হোতাসহ আটক ৪২
** লকডাউন ভেঙে সংঘর্ষ, পা কেটে নিয়ে আনন্দ মিছিল!
বাংলাদেশ সময়: ০৬১৮ ঘণ্টা, এপ্রিল ৩০, ২০২০
আরএ