ঢাকা, শনিবার, ৮ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৩ নভেম্বর ২০২৪, ২১ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

করোনা: লকডাউনে বেপরোয়া সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১১৯ ঘণ্টা, মে ১৩, ২০২০
করোনা: লকডাউনে বেপরোয়া সুন্দরবনের হরিণ শিকারিরা ফাইল ফটো

বাগেরহাট: করোনা পরিস্থিতিতে সারাবিশ্বে এক ধরনের স্থবিরতা বিরাজ করছে। মানুষ ও যানবাহনের চলাফেরা নিয়ন্ত্রণ করায় পরিবেশ দূষণের হারও কমেছে অনেক।প্রিয় মাতৃভূমি বাংলাদেশও কার্যত লকডাউন।

লকডাউনের ফলে বিশ্ব ঐতিহ্য সুন্দরবনেও পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করেছে বন বিভাগ। বনে প্রবেশ নিষিদ্ধ থাকায় বনের অতন্দ্র প্রহরী বনরক্ষীরাও কিছুটা ঝিমিয়ে পড়েছে।

এই সুযোগে সুন্দরবনের অভয়ারণ্য এলাকায় হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে অসাধু চোরা শিকারিরা।

সুন্দরবনের হরিণ শিকারের জন্য সব সময় চোরা শিকারিরা তৎপর থাকলেও লকডাউনের পর থেকে আরও বেশি বেপরোয়া হয়ে উঠেছে। তবে বনবিভাগ বলছে চোরা শিকারিদের ধরতে অভিযান অব্যাহত রয়েছে।

বাংলাদেশে করোনা রোগী শনাক্ত হওয়ার পর ১৯ মার্চ থেকে সুন্দরবনে পর্যটক প্রবেশ নিষিদ্ধ করে বন বিভাগ। কার্যত এই আদেশের পরে বনরক্ষীরা কিছুটা ঢিমে তালে তাদের দায়িত্ব পালন শুরু করেন। এই সুযোগে চোরা শিকারীরা তৎপর হয়ে ওঠে হরিণ শিকারে।

লকডাউন শুরু হওয়ার পর থেকে ১২ মে পর্যন্ত বনবিভাগ, পুলিশ ও কোস্টগার্ডের অভিযানে ১০০ কেজি হরিণের মাংস জব্দ করা হয়। এর সঙ্গে এক হাজার ৯৫০ ফুট ফাঁদ, কয়েকটি নৌকা ও ট্রলার জব্দ করে আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর সদস্যরা। হরিণ শিকারের অপরাধে ছয় জন চোরা শিকারিকে আটক করা হয়। হরিণ৫ মে সর্বশেষ ৩০ কেজি হরিণের মাংস ও ৭শ ফুট ফাঁদসহ তিনজনকে আটক করে বন বিভাগ। ওই সময় শিকারিদের পেতে রাখা ফাঁদে আটক ২২টি হরিণ বনে অবমুক্ত করে বনরক্ষীরা।

এসবতো যারা অপরাধ করে ধরা পড়েছেন তাদের পরিসংখ্যান। এর বাইরে চোরা শিকারিরা কি পরিমাণ হরিণ ও হরিণের মাংস চালান করেছে তার সঠিক কোনো পরিসংখ্যান নেই কারও কাছে।

এছাড়া পূর্ব সুন্দরবন বনবিভাগ অভিযান চালিয়ে গেল এক বছরে ২৩১ কেজি হরিণের মাংস, ১০টি চামড়া, তিনটি মাথা জব্দ করে। আটক করা হয় ২৫ জন হরিণ শিকারিকে। এসময় চোরা শিকারিদের ব্যবহৃত ১০টি ট্রলার, ২৫টি নৌকা ও পাঁচ হাজার ফুপের বেশি ফাঁদ উদ্ধার করে বনবিভাগ। এসব ঘটনায় করা মামলার ৬৭ জন আসামি পলাতক রয়েছে।

সুন্দরবন সংলগ্ন এলাকাবাসী বলছেন, করোনা পরিস্থিতিতে বনরক্ষীদের টহল ব্যবস্থা কিছুটা ঝিমিয়ে পড়ায় বনের অভ্যন্তরে মায়াবী, চিত্রা হরিণ নিধনে মেতে উঠেছে সংঘবদ্ধ কয়েকটি শিকারি চক্র। এ চক্রের সদস্যরা গোপনে বা  ছদ্মবেশে বনের সংরক্ষিত অভয়ারণ্য এলাকায় অনুপ্রবেশ করে ফাঁদ পেতে হরিণ শিকার করে মাংস বিক্রি করছে। কখনো বা জীবিত হরিণও গোপনে পাচার করে দিচ্ছে। গত এক মাসে অন্তত অর্ধশত হরিণ শিকারের ঘটনা ঘটেছে। বন রক্ষীরা যে পরিমাণ হরিণের মাংস উদ্ধার ও শিকারিদের আটক করেছে তার চেয়ে অনেক বেশিই হরিণ নিধনের ঘটনা ঘটাচ্ছে শিকারি চক্রের সদস্যরা। এতে সুন্দরবনের জীববৈচিত্র্যের ওপর একটা বিরুপ প্রভাব ফেলবে বলে মন্তব্য করেছেন অনেকে।

সুন্দরবন সংলগ্ন শরণখোলা উপজেলার সোনাতলা গ্রামের রহিম, আবুল নকিবসহ কয়েকজন বলেন, করোনা ভাইরাসের জন্য হয়ত ফরেস্ট ও বনের পাহারাদাররা একটু কম আছে। যার কারণে চোরা শিকারিরা বৃদ্ধি পেয়েছে।

সুন্দরবনের পর্যটন শিল্পের সঙ্গে জড়িত শহিদুল ইসলাম ও হাবিবুর রহমান বলেন, সুন্দরবনের মূল সৌন্দর্য্য হরিণ। সেই হরিণ এখন প্রায়ই অবৈধভাবে শিকার করছে চোরা শিকারিরা। এভাবে যদি দিনের পর দিন চলতে থাকে তাহলে সুন্দরবনের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্য নষ্ট হয়ে যাবে। যত দ্রুত সম্ভব সুন্দরবন থেকে হরিণ শিকার বন্ধ করা প্রয়োজন। হরিণ শিকারিদের কঠোর শাস্তির আওতায় আনার দাবি জানান তারা।

হরিণ শিকারিসহ চোরাকারবারীদের ধরতে রাত দিন দায়িত্ব পালনের কথা উল্লেখ করে সুন্দরবন করমজল কৃত্রিম প্রজনন কেন্দ্রের ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা আজাদ কবির  বলেন, আমরা বন বিভাগের প্রতিটা কর্মী বন্যপ্রাণী ও বনকে সংরক্ষণের জন্য ২৪ ঘণ্টা দায়িত্ব পালন করি। তারপরও করোনা ও রোজার জন্য যে কোনো অসাধু ব্যক্তি যখন তখন বনে ঢুকতে পারে মনে করে আমরা আরও বেশি তৎপর হয়েছি। যখন যেখানে খবর পাচ্ছি আমরা ছুটে যাচ্ছি।

সেভ দ্যা সুন্দরবন ফাউন্ডেশনের চেয়ারম্যান ড. ফরিদুল ইসলাম বলেন, করোনা আক্রান্ত মানুষ যখন গৃহবন্দি। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি তখন উন্মুক্ত উল্লসিত এবং অবারিত। বাঘ-হরিণসহ বিভিন্ন প্রজাতির বন্যপ্রাণী সুন্দরবনে নির্বিঘ্নে বিচরণ করছে। ঠিক এমন সময় একটি অসাধু চক্র সুন্দরবনে হরিণ শিকারে মেতে উঠেছে। সুন্দরবনের কয়েকটি রেঞ্জে ইতোমধ্যে হরিণ শিকারের ঘটনা ঘটেছে। আইন-শৃঙ্খলা বাহিনীর কাছে আমাদের আবেদন এখনই চোরা শিকারিদের বিরুদ্ধে কঠোর পদক্ষেপ নিন। তা না হলে সুন্দরবন তার সৌন্দর্য্য হারাবে। আমরা হারাবো অপার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য্যের আধার সুন্দরবনকে।

পূর্ব সুন্দরবন বিভাগের বিভাগীয় বন কর্মকর্তা মোহাম্মদ বেলায়েত হোসেন বলেন, করোনা পরিস্থিতিতে সুন্দরবনে পর্যটকদের প্রবেশাধিকার নিষিদ্ধ করা হয়েছে। ফলে সুন্দরবন নতুন প্রাণ ফিরে পেয়েছে। হরিণ শিকারিরা মনে করেছিল করোনা পরিস্থিতির কারণে বনবিভাগ নজরদারি ও টহল কমিয়েছে। এই চিন্তায় কিছু হরিণ শিকারি বনে প্রবেশ করেছিল। আমরা তাদের যথাসময়ে আটক করেছি। আমরা সব সসময় টহল জোরদার রেখেছি। সুন্দরবনের প্রাণ-প্রকৃতি রক্ষার্থে বনবিভাগের সদস্যরা সবসময় তৎপর রয়েছে বলে দাবি করেন তিনি।

বাংলাদেশ সময়: ১১১৭ ঘণ্টা, ১৩ মে, ২০২০
আরএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।