ঢাকা, মঙ্গলবার, ১১ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২৬ নভেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

জাতীয়

শেষবারের মতো লিবিয়ায় নিহত লালচাঁদের মুখ দেখতে চায় বাবা-মা

ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৬৪৩ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২০
শেষবারের মতো লিবিয়ায় নিহত লালচাঁদের মুখ দেখতে চায় বাবা-মা

মাগুরা: সাত-আট মাস আগে ভাগ্যের সন্ধানে ধার-দেনা করে দালাল ধরে বিদেশে পাড়ি জমান মাগুরার লালচাঁদ শেখ। কিন্তু ভাগ্যের কী নির্মম পরিহাস, সম্প্রতি লিবিয়ায় মানব পাচারকারীদের গুলিতে প্রাণ হারাতে হয় এ যুবককে। একদিকে ছেলে হারানোর শোক, অন্যদিকে বিশাল অংকের দেনা মাথায় নিয়ে এখন পাগলপ্রায় দশা লালচাঁদের পরিবারের। 

শনিবার (৩০ মে) সরেজমিনে লালচাঁদের বাড়ি গিয়ে দেখা যায়, পুত্রশোকে বিলাপ করছেন তার বাবা-মা। তাদের ঘিরে আছে গ্রামবাসী।

শেষবারের মতো ছেলের মুখ দেখার আকুতি জানিয়ে একটানা কেঁদেই চলেছেন লালচাঁদের বাবা-মা।

জানা যায়, বছরখানেক আগে আর্থিক সচ্ছলতার আশায় ছেলে লালচাঁদকে বিদেশে পাঠানোর সিদ্ধান্ত নেন মাগুরার মহম্মদপুর উপজেলার নারায়ণপুর গ্রামের দরিদ্র কৃষক ইউসুফ শেখ। টাইলস মিস্ত্রীর কাজের সূত্রে লালচাঁদের পরিচয় হয় কুষ্টিয়ার আলচারা গ্রামের দালাল হাজী কামালের সঙ্গে। অবৈধ পথে বিদেশে পাঠানোর কথা লালচাঁদ ও আরও এক যুবক তরিকুলের কাছ থেকে মোট অংকের টাকা নেন হাজী কামাল।  

লালচাঁদের পরিবারের দাবি, সঞ্চিত টাকা না থাকায় তারা নিজেদের সব জমি বন্ধকির টাকা, গরু বিক্রির টাকা ও ধারদেনা করে মোট পাঁচ লাখ টাকা দেন হাজী কামালের হাতে। এ ব্যাপারে জানতে যোগাযোগের চেষ্টা করা হলে হাজি কামালের ফোন বন্ধ পাওয়া যায়।

লালচাদের ছোট ভাই নাসিরুল জানান, চার ভাই, তিন বোনের মধ্যে লালচাঁদ ছিল সবার বড়। বাবা অনেক কষ্ট করে তিন বোনের বিয়ে দিলেও ধারদেনা করে কোনো মতে সংসার চালান। এ অবস্থায় তাদের বড় ভাই সচ্ছলতার আশায় বিদেশে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নেন। এক পর্যায়ে বিশাল অংকের টাকা ধার করে ও জমি বন্ধকির মাধ্যমে দালাল ধরে তাকে লিবিয়া পাঠানো হয়। কিন্তু সেখানে যাওয়ার পর গত সাত-আট মাসে লালাচাঁদ পরিবারে একটি টাকাও পাঠাতে পারেননি।  

শোকগ্রস্ত নাসিরুল বলেন, এরই মাঝে কয়েকদিন আগে দালালের মাধ্যমেই আমরা জানতে পারি যে, ভাই আর নেই। এদিকে আমাদের ধারের টাকার সুদ দিন দিন বেড়ে যাচ্ছে, ওদিকে ভাইও নেই। আমরা এখন সবদিক দিয়েই নিঃস্ব।

গ্রামবাসীর সূত্রে জানা যায়, গত বছরের ১ সেপ্টেম্বর টাইলস মিস্ত্রীর কাজের ঠিকাদার হাজি কামালের মাধ্যমে লিবিয়ায় পাড়ি জমান যুবক লালচাঁদ ও তরিকুল। লিবিয়ায় পাচারকারীদের গুলিতে লালচাঁদ নিহত হলেও ভাগ্যক্রমে বেঁচে গেছেন তরিকুল। গুলিবিদ্ধ হলেও তিনি এখন সুস্থ।  

তরিকুলের বোন জামাই জিনারুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, ঈদের আগের দিন তরিকুল আমাকে ভয়েস ম্যাসেজ পাঠিয়ে বলে- ভাই, আমারে বাঁচান, আমারে মেরে ফেললো। ওরা (জিম্মিকারী) কারেন্ট শক দিচ্ছে। আপনি হাজী কামালরে বলে আমারে বাঁচান। পরে মাফিয়ারা আমাকে ফোন দিয়ে টাকা চায়। তারা বলে, টাকা পাঠাবি কখন? টাকা ডলার করে ইতালি বা দুবাইয়ে যদি কেউ থাকে তার মাধ্যমে ব্যাংকে পাঠাবি। দেরি হলে তরিকুলদের ওপর নানাভাবে নির্যাতন শুরু হয়।

লিবিয়ায় লালচাঁদের নিহত হওয়া প্রসঙ্গে মহম্মদপুর থানার ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা (ওসি) তারক বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, লিবিয়ার ওই ঘটনায় নারায়ণপুর গ্রামের এক যুবক নিহত ও একজন আহত হয়েছেন। তারা দালালের মাধ্যমে লিবিয়া যান। সেখানে মানবপাচারকারীদের গুলিতে নিহত হয়েছেন এমন খবর পেয়েছি। তবে আমরা এখনো সুনির্দিষ্টভাবে কিছু বলতে পারছি না। তদন্ত করে পরবর্তী সময়ে জানাতে পারবো।

উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মোঃ মিজানুর রহমান বলেন, আমি নিহতের বাড়িতে গিয়ে খোঁজখবর নিয়েছি। এ বিষ জেলা প্রশাসককে বিস্তারিত জানাবো। উনি সেই মোতাবেক প্রয়োজনীয় পদক্ষেপ নেবেন।

গত ২৮ মে লিবিয়ায় মানবপাচারকারীদের হাতে নিহত হন ২৬ বাংলাদেশি। একই ঘটনায় আরও ১১ বাংলাদেশি আহত হন। এছাড়া পালিয়ে বেঁচেছেন এক বাংলাদেশি। আহত বাংলাদেশিরা বর্তমানে ত্রিপোলির হাসপাতালে চিকিৎসাধীন।  

যুদ্ধবিদ্ধস্ত লিবিয়া ও করোনা মহামারিসহ সার্বিক পরিস্থিতিতে নিহতদের মরদেহ বাংলাদেশে ফিরিয়ে আনা সম্ভব হয়নি, ফলে তাদের সেখানেই দাফন করা হয়েছে বলে জানিয়েছে লিবিয়াস্থ বাংলাদেশ দূতাবাস।    

বাংলাদেশ সময়: ১৮৩৯ ঘণ্টা, মে ৩১, ২০২০  
জেজে/এইচজে

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।