এক কথায় তিনি ছিলেন সিলেটের ‘ম্যাজিকম্যান’। রাজনীতির মঞ্চে দরাজ কন্ঠে যেমন বক্তৃতা, তেমনি তার সুরেলা কন্ঠে গান শুনে মুগ্ধ হয়েছেন খোদ প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনাও।
সিলেটের বড় ধরনের কোনো সংকট মানেই হাল ধরতে হাজির বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। নগর পিতা হয়ে বিগত দিনগুলোতে নগরবাসীকে সব ধরনের সংকট থেকে আগলে রেখেছেন। তার উপস্থিতি মানেই সংকট নিরসন নিশ্চিত। আর নির্বাচনে পরাজিত হয়েও ছিলেন নগরবাসীর সুখ-দুঃখের সারথি।
আর সংসদ নির্বাচন থেকে গ্রামগঞ্জে চেয়ারম্যান-মেম্বারদের নির্বাচন। সবখানে থাকতো তার সরব উপস্থিতি। কামরানের উপস্থিতি যেন প্রার্থীর ভোটের পাল্লা ভারি করে দিতো। আওয়ামী লীগের প্রার্থীকে বিজয়ী করতে কেবল সিলেটের মধ্যেই নয়, চট্রলার বীর মহিউদ্দিনের পাশেও হাড় খাটুনি দিতে দেখা গেছে তাকে।
চার দলীয় জোট সরকারের সময় জনপ্রিয়তার কারণে বিএনপি-জামায়াতের চোখের বালি ছিলেন কামরান। তখন আওয়ামী লীগ বিরোধীদলে। সিলেটের রাজপথে আন্দোলনে কামরান না থাকলে যেন সাহস হারিয়ে যেতো নেতাকর্মীর। যে কারণে বিএনপি-জামায়াতের গ্রেনেডের নিশানা থেকে দুই দফায় প্রাণে বেঁচে যান তিনি।
সিলেট রাজনীতিবিদ ও জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুর্দান্ত পারফর্মন্সের কারণে সিলেট আওয়ামী লীগের ‘নিওক্লিয়াস’ বা ‘প্রাণ ভোমরা’ ছিলেন বদর উদ্দিন আহমদ কামরান। কিন্তু পর পর দুইবার সিলেট সিটি করপোরেশনের নির্বাচনে তাকে বিএনপির প্রার্থী বর্তমান মেয়র আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজয় বরণ করতে হয়। এছাড়া আওয়ামী লীগের সম্মেলনে মহানগর সভাপতি পদ হারালেও কেন্দ্রীয় কার্যনির্বাহী সদস্য পদে টিকে থাকেন।
অবশেষে করোনা ভাইরাসের সঙ্গে যুদ্ধ করে পৃথিবীর মোহ ছাড়তে হলো তাকে। সেই সঙ্গে সিলেটবাসী হারালো তাদের প্রাণপ্রিয় নেতাকে। আক্ষরিক অর্থে সিলেটের আকাশ থেকে খসে পড়লো নক্ষত্র। ‘এ ক্ষতি পূরণ হওয়ার নয়, সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে এমন মন্তব্য সাবেক সংসদ সদস্য আমাতুল কিবরিয়া কেয়া চৌধুরীর।
রোববার (১৪ জুন) ভোর পৌনে ৩টার দিকে সম্মিলিত সামরিক হাসপাতাল (সিএমএইচ) থেকে আসা মৃত্যুর খবর যেনো সিলেটের ঘুমন্ত মানুষকে নাড়িয়ে দিলো। সুবেহ সাদেকের সময় অনেকে উঠে নামাজ পড়ে প্রিয় নেতার জন্য দোয়া করেছেন।
সিলেট আওয়ামী রাজনীতির দীর্ঘদিনের সহযোদ্ধা মহানগর আওয়ামী লীগের সাবেক সাধারণ সম্পাদক আসাদ উদ্দিন বলেন, তিনি ছিলেন সিলেটের মানুষের নয়নের মনি। মহানগর কমিটিতে তিনি ছিলেন সভাপতি, আমি সেক্রেটারি। সে হিসেবে কামরান-আসাদ জুটি মানুষের মুখে মুখে ছিল। দলের অনেকেও এই জুটিকে গ্রহণ করেছিলেন। এছাড়া তার বর্ণাঢ্য রাজনীনৈতিক ইতিহাসের পাশাপাশি জনপ্রতিনিধি হিসেবে দুই যুগের উপরে (প্রায় ৩০ বছর) পার করেছেন। সে সুবাদে তিনি মানুষের মনে জায়গা করে নিয়েছেন।
জীবদ্দশায় বাংলানিউজের সঙ্গে এক সাক্ষাৎকারে কামরান বলেছিলেন, ১৯৬৯ সালের গণঅভ্যুত্থানের সময়ে ছাত্র রাজনীতিতে 'হাতেখড়ি' তার। ওই সময় সিলেট সরকারি পাইলট উচ্চ বিদ্যালয়ের ছাত্র থাকাবস্থায় পাকিস্তান সরকার একটি বই ছাপা করে ‘পাকিস্তান দেশ অব হিস্ট্রি’। সে সময় এই বইয়ের প্রতিবাদ করতে গিয়ে ছাত্র আন্দোলনে বিভিন্ন স্কুল-কলেজ মিলে প্রতিবাদ মুখর হন তারা। আন্দোলনের মুখে পাকিস্তান সরকারও বইটি বাতিল করতে বাধ্য হয়। সে সময় ছাত্রলীগের নেতারা মকসুদ ইবনে আজিজ লামা, সদরউদ্দিন, দেওয়ান গৌস সুলতান, সৈয়দ আশরাফ আলী, টিলাগড়ের শফিকুর রহমানসহ অনেকে পেছন থেকে আন্দোলন বেগবানে উৎসাহ যুগিয়েছিলেন।
১৯৭২ সালে ছড়ারপাড় ও কালিঘাট নিয়ে গঠিত আঞ্চলিক শাখার সভাপতি ছিলেন মো. মতছিন, সাধারণ সম্পদকের দায়িত্বে ছিলেন কামরান নিজে। এরপর সদর থানা ছাত্রলীগের সভাপতি ছিলেন গিয়াস উদ্দিন দেশি এবং তিনি ছিলেন সেক্রেটারি। পরে শহর যুবলীগের নেতৃত্ব দেন।
১৯৭৩ সালে তিনি পৌর কাউন্সিলর নির্বাচিত হন। ১৯৭৫ সালে বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের পর শহর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। পরবর্তীতে মহানগর আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক এবং বর্তমানে মহানগরের সভাপতির দায়িত্ব পালন করছেন। মৃত্যুর আগ পর্যন্ত তিনি কেন্দ্রীয় কার্যনিবার্হী কমিটির সদস্য ছিলেন।
জনশ্রুতি রয়েছে, জনপ্রিয়তার র্শীষে থাকা বদর উদ্দিন আহমদ কামরান গত দুই বারের নির্বাচনে দলের কতিপয় নেতার বিরোধীতার কারণে বিএনপির আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ধরাশায়ী হন। ২০১৩ সালে ৩৫ হাজার ১শ ভোটের ব্যবধানে আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে পরাজিত হন। ২০১৮ সালের ৩০ জুলাই সিটি নির্বাচনে ফের আরিফুল হক চৌধুরীর কাছে ৫৫ হাজার ১০০ ভোটে পরাজিত হন তিনি। অথচ ২০০৩ সালের জুন মাসে প্রথম সিটি নির্বাচনে প্রায় ৮৪ হাজার ভোটের ব্যবধানে বিজয়ী হন তিনি।
এর আগে ২০০১ সালে ২৬ দশমিক ৫০ বর্গকিলোমিটার আয়তন নিয়ে সিলেট সিটি করপোরেশন প্রতিষ্ঠিত হলে প্রথম মেয়র (ভারপ্রাপ্ত) হিসেবে ইতিহাসে নাম লেখান তৎকালীন পৌরসভার কমিশনার থেকে চেয়ারম্যান হওয়া কামরান।
বাংলাদেশ সময়: ০৮১৮ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২০
এনইউ/এএটি