ঢাকা, শুক্রবার, ১৫ চৈত্র ১৪৩০, ২৯ মার্চ ২০২৪, ১৮ রমজান ১৪৪৫

মুক্তমত

বাঙালিমুক্ত শাসন, বাংলামুক্ত ভাষণ, তাই টেকেনি পাকিস্তান

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৮২৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭
বাঙালিমুক্ত শাসন, বাংলামুক্ত ভাষণ, তাই টেকেনি পাকিস্তান

আধুনিক জাতি-রাষ্ট্রে নাগরিকদের সঙ্গে ভাষার সম্পর্ক ‘রাষ্ট্র’ ধারণার মতোই পুরনো। গ্রীসের নগর রাষ্ট্রেও আমরা নাগরিকদের একই ভাষায় কথা বলতে দেখি। বর্তমানে প্রচলিত জাতি-রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ভাষা অন্যতম উপাদান। কোনো কোনো ক্ষেত্রে জাতি-রাষ্ট্র গঠনের পেছনে মূল নিয়ামক হিসেবেও ভাষার উপস্থিতি লক্ষ্য করি।

লাহোর প্রস্তাবের বাইরে গিয়ে দ্বি-জাতি তত্ত্বের ভিত্তিতে পাকিস্তান রাষ্ট্র গঠিত হলেও পাকিস্তানের দুই যুগের শাসন-অভিজ্ঞতা বাঙালি ভুলে যায়নি। বরং অবিভক্ত ব্রিটিশ ভারতের রক্তাক্ত ও অবিশ্বাসের ক্ষত আরো দগদগে হয়েছে।

বাঙালি তাই প্রথম থেকেই স্বকীয়তার সংগ্রামে সদা জাগ্রত।

ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র ভাঙতে পারে (যেমন অবিভক্ত ভারত ভেঙেছে)। কিন্তু আধুনিক রাষ্ট্র ব্যবস্থায় ধর্মের ভিত্তিতে রাষ্ট্র গঠিত হতে পারে না। আর যা গঠনই হতে পারে না তা টিকে থাকার তো প্রশ্নই নাই। পাকিস্তানও তাই টেকেনি।  

যে মূল মন্ত্রের ভিত্তিতে পাকিস্তানের সৃষ্টি, যদি পাকিস্তানকে টিকিয়ে রাখতে হয় তবে বাঙালি বা প্রাকৃতজনের স্বকীয়তা ও বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তিমূলেই আঘাত করতে হবে। পাকিস্তানি শাসকগোষ্ঠি ভেবে চিন্তেই তাই আমাদের ভাষার ওপরই প্রথম আঘাতটি করে।  
 
পাকিস্তান গঠিত হয়েছে ধর্মের ভিত্তিতে। তাই পাকিস্তান টিকিয়ে রাখতে হলে অপরাপর বৃহত্তর ঐক্যের ভিত্তি যেমন-ভাষা ও সংস্কৃতির ওপর আঘাত হানতে হবে। তবেই রাষ্ট্র গঠনের অবাস্তব দর্শনকে জিইয়ে রাখা যাবে। আর ভাষা যদি কেড়ে নেওয়া যায়, তবে সংস্কৃতি আপনা-আপনিই ‘সহিহ’ হবে। টিকে থাকবে পাকিস্তান। কিন্তু পাকিস্তানি শাসকচক্র ‘বিসমিল্লায়ই গলদ’ করে ফেললো। মুখের ভাষা কেড়ে নেওয়ার মতো গলদ কাজ পৃথিবীতে একমাত্র পাকিস্তানই করেছিল।  

ব্রিটিশদের ডিভাইড অ্যান্ড রুল বুঝতে ভারতবাসীর দুইশ’ বছর লেগেছিল। তবে পাকিস্তানি শাসকদের ‘ভাষাতত্ত্ব’ বুঝতে আমাদের মোটেও সময় লাগেনি। বরং বাঙালি পাকিস্তান হওয়ার আগে থেকেই বাংলাকে রাষ্ট্র ভাষার মর্যাদা দেওয়ার দাবি করে আসছিল।

১৯৪৭-এ ভারত ভাগ হয়ে পাকিস্তান হয়। পাকিস্তান হওয়ার আগেই আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য ড. জিয়াউদ্দিন তার একটি প্রবন্ধে উর্দুকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা করার প্রস্তাব করেন। তিনি হিন্দি যেমন ভারতের রাষ্ট্রভাষা উর্দুও তেমনি পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হবে বলে প্রস্তাব করেন।

আসলে পূর্ব পাকিস্তানকে তারা ‘আসল পাকিস্তান’ মনে করতো না। পশ্চিম পাকিস্তানকেই কেবল চৌধুরী রহমত আলী গংরা ‘পবিত্রদের দেশ’ বা পাকিস্তান (পাক-ই-স্থান) মনে করতো। সে বয়ান পাকিস্তানিদের বিভিন্ন গ্রন্থেও পাওয়া যায়। এমনকি নিয়াজির বইতেও বাঙালিকে মুসলমান বলতে তারা নারাজ। তাই পাকিস্তানের জন্য উর্দুকেই ‘সহিহ’ ভাষা নির্ধারণ করা হলো।

ভাষা তো চাপিয়ে দেওয়ার বিষয় নয়। ভাষা আসে হৃদয়ের গভীর থেকে যেখানে কারো অনুপ্রবেশ নিষেধ-সম্ভবও না। ভাষা মানব জন্মের সঙ্গে সঙ্গেই নির্ধারিত হয়ে যায়। কিন্তু জিন্নাহ তা চাপিয়ে দিতে চাইলেন পাকিস্তান জন্মের সঙ্গে সঙ্গে। রাতারাতি একটি ভূখণ্ডের নাগরিকদের তিনি বলে দিলেন, ‘আগামীকাল থেকে তোমরা উর্দুতে কথা বলবে’।

কার্জন হলে জিন্নাহর সমাবেশে উর্দুর বিরুদ্ধে অনেকেই সেদিন ‘নো’ নো’ বলেছিলেন। কিন্তু জিন্নাহ তাতে দমে যাননি। বরং তিনি পাকিস্তান গিয়ে উর্দুকে আরো পোক্ত করে বাঙালির ওপর চাপিয়ে দেওয়ার কৌশল গবেষণায় মত্ত হলেন। কিন্তু বাঙালি তা মানবে কেন?

জিন্নাহ’র সমাবেশে প্রতিবাদের ঘটনাটি পাকিস্তান সৃষ্টির পরের ঘটনা। কিন্তু পাকিস্তান সৃষ্টির আগেই জিয়াউদ্দিনের বিরুদ্ধে প্রতিবাদ করেছিলেন একজন। তিনি আমাদের ড. মুহম্মদ শহীদুল্লাহ। আমরা তাকে বহু ভাষাবিদ হিসেবেই জানি। ১৯৫২’র ভাষা আন্দোলনের আগেই বাঙলির ভাষার জন্য যে আন্দোলন শুরু হয়ে গিয়েছিল, তিনি সে আন্দোলনের পুরোধা ব্যক্তিত্ব। তিনি সেদিন প্রতিবাদ করে বলেছিলেন, এটি বৈজ্ঞানিক শিক্ষা ও নীতিবিরোধী ও শায়ত্তশাসন ও আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকার নীতিরও পরিপন্থি। তিনি প্রাদেশিক ভাষার পরিবর্তে এ রকম চাপিয়ে দেওয়া ভাষারও তীব্র প্রতিবাদ করেছিলেন।

ড. শহীদুল্লাহ একজন ভাষাবিদই নন, তিনি একজন ভাষা দার্শনিক, প্রথম সারির ভাষাসৈনিক। পাকিস্তানিরাতো ভাষা কেড়ে নেওয়ার মাধ্যমে প্রকৃতপক্ষে বাঙালির আত্ম নিয়ন্ত্রণাধিকার ও স্বায়ত্ত্বশাসন কেড়ে নিতে চায়। সেটি উপলব্ধি করেই তিনি সেদিন প্রতিবাদ করেছিলেন।

যদি আরো একটু আগে ফিরে যাই, সেখানেও ড. শহীদুল্লাহর পদচারণা দেখি। ১৯২০ সালে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে শান্তি নিকেতনে সভা হচ্ছিল। ভারতের সাধারণ ভাষা কী হতে পারে তা নিয়ে নানা জন নানা মত দিচ্ছেন। ওই সভায় ৩৫ বছরের এক যুবক শহীদুল্লাহ্ সেদিনও তার এক দীর্ঘ প্রবন্ধে প্রমাণ করে দিলেন যে, পুরো ভারতের সাধারণ ভাষা হতে পারে বাংলা। তিনি ভাষা বিজ্ঞানের যুক্তিতেই তা প্রমাণ করলেন।

দেশ ভাগের ঠিক আগে-আগে ১৯৪৭ সালের ০৩ আগস্ট ড. শহীদুল্লাহ সে সময়ের ‘কমরেড’ পত্রিকায় ‘ল্যাঙ্গুয়েজ প্রবলেম’ শিরোনামে প্রবন্ধ লেখেন। সেখানে তিনি বাংলাকে পাকিস্তানের রাষ্ট্রভাষা হিসেবে যুক্তি তুলে ধরেন। কিন্তু চোরে না শোনে ধর্মের কাহিনী। উল্টো দেশ ভাগের পর উর্দুকেই করতে চায় পুরো পাকিস্তানের রাষ্ট্র ভাষা।  

 

যাই হোক। পাকিস্তান প্রতিষ্ঠিত হলো। কিন্তু যে বাঙালি পাকিস্তান আন্দোলনের ঝাণ্ডা ধারণ করে রক্ত পর্যন্ত দিলো, পাকিস্তান প্রতিষ্ঠার পর ক্ষমতার সেই ঝাণ্ডা গিয়ে পড়লো জিন্নাহ’র হাতে। তিনি জিন্নাহ থেকে হয়ে গেলেন কায়েদে আযম।  

ক্ষমতা তখন জিন্নাহ’র হাতে। তাই তার অমাত্যবর্গও সব লাহোর আর করাচির হোমরা-চোমরারা। সেখানে বাঙালি নেই। নেই শেরে বাংলা, সোহরাওয়ার্দী, আবুল কালাম আজাদ, মওলানা ভাসানী অথবা আবুল হাশিমরা। সে যায়গায় স্থান করে নিয়েছেন নবাগত নবাবজাদা পীরজাদারা যেমন- নাজিমুদ্দিন, মওলানা আকরাম খাঁ, মোহন মিঞা, নুরুল আমিন ও তমিজুদ্দিনরা।  
 
শাসনযন্ত্রে বাঙালি নেই, তাই বাংলাও নেই। বাঙালির ক্ষমতাতো অনেক পরের কথা, মুসলিম লীগের টিকিট পাওয়াও যেনো সোনার হরিণ। ক্ষমতার মঞ্চে যারা বসে আছেন, মুখে তাদের উর্দু জবান। গদির আশপাশেও বাঙালি নেই। সবার মুখেই উর্দু ভাষণ।  

তাই পাকিস্তানের শেষরক্ষাও হলো না।

বাংলাদেশ সময়: ১৪২০ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৫, ২০১৭
এএসআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।