ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

মুক্তমত

বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকার ও জনগণের বিপরীত অবস্থান

এরশাদুল আলম প্রিন্স, ল’ এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৭২৩ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকার ও জনগণের বিপরীত অবস্থান বাংলাদেশ প্রশ্নে মার্কিন সরকার ও জনগণের বিপরীত অবস্থান

ইয়াহিয়া খান বাঙালির ওপর সশস্ত্র যুদ্ধ চাপিয়ে দিলে বাঙালিও যার যা আছে তাই নিয়ে যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। সামরিক ও আধা-সামরিক বাহিনী ও পুলিশ সদস্যরা তাদের ইউনিট, অস্ত্রশস্ত্র, গোলাবারুদ, সাজ-সরঞ্জাম ও পরিবহন নিয়ে মুক্তিবাহিনীতে যোগ দেয়। এ যুদ্ধ ধীরে ধীরে শহর থেকে গ্রামে ও পুরো দেশে ছড়িয়ে পড়ে। যুদ্ধের এক পর্যায়ে আমাদের সঙ্গে যোগ দেয় ভারতীয় মিত্র-সেনারা। তারা মুক্তিযুদ্ধে আমাদের সহযোগী শক্তি হিসেবে যোগ দেয়।

মুক্তিযুদ্ধের সময় বাংলাদেশ সম্পর্কে বিভিন্ন দেশে ইতিবাচক প্রতিবেদন ও সংবাদ প্রকাশিত হয়। সংবাদপত্র, বুদ্ধিজীবী, রাজনীতিবিদ ও আমলাসহ অনেকেই সেদিন পূর্ব পাকিস্তান কর্তৃক বাঙালি নিধনযজ্ঞ সম্পর্কে সচেতন হয়েছিলেন।

বিশেষ করে ‘নিউইয়র্ক টাইমস’, ‘ওয়াশিংটন পোস্ট’ ‘ক্রিশ্চিয়ান সায়েন্স মনিটর’ প্রভৃতি সংবাদপত্র বাংলাদেশের ঘটনাবলী সম্পর্কে বিস্তারিত সংবাদ পরিবেশন করে। এর মাধ্যমে সারাবিশ্বেই বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে জনমত গড়ে ওঠে।
 
মুক্তিযুদ্ধের শুরুতেই ‘নিউইয়র্ক টাইমস’ মন্তব্য করেছিল, ‘এই গৃহযুদ্ধ পাকিস্তানের অভ্যন্তরীণ ব্যাপার হলেও গিরিলা যুদ্ধের রূপ পরিগ্রহ করলে বিপদজনক আন্তর্জাতিক পরিণতির সৃষ্টি করবে। এই পরিস্থিতিতে বিশ্বের রাষ্ট্রবর্গের উচিত তারা প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়াকে আহবান জানাবেন যেন মানবতা ও শুভ বুদ্ধির ভিত্তিতে তিনি রক্তপাত বন্ধ করেন এবং জনগণের নির্বাচিত নেতা শেখ মুজিবুরের হাতে ক্ষমতা ফিরিয়ে দেন। ’ পত্রিকাটি মুক্তিযুদ্ধে আমেরিকান নীতি সম্পর্কেও কিছু বক্তব্য দেয়। তারা পাকিস্তানে সবরকম সামরিক সাহায্য বন্ধ করার দাবি জানায়। সেইসঙ্গে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ পুর্নবাসন অব্যাহত রাখারও দাবি জানায়।
 
ওয়াশিংটন পোস্টও প্রায় একইভাবে পাকিস্তানি হানাদারদের সমালোচনা করে। তারা সম্পাদকীয়তে স্বদেশের নাগরিক হত্যার জন্য ইয়াহিয়াকে দায়ী করে। মার্কিন সংবাদমাধ্যমগুলো প্রধানত মানবতার দৃষ্টিভঙ্গি থেকে বিচার করে একটি সন্তোষজনক রাজনৈতিক সমাধানের স্বপক্ষে বক্তব্য দিতে থাকে।
 
সাংবাদিকদের মতো মার্কিন বুদ্ধজীবিরাও একটি সক্রিয় ভূমিকা গ্রহণের জন্য প্রেসিডেন্ট রিচার্ড নিক্সনের প্রশাসনের ওপর চাপ সৃষ্টি করতে থাকেন। মার্চে অ্যাসিয়েশন ফর এশিয়ান স্টাডিজ সম্মেলনে প্রায় দুই হাজার শিক্ষাবিদ ও গবেষক অনতিবিলম্বে পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা অবসানের আহবান জানান। এই সম্মেলনে পূর্ব পাকিস্তানে জরুরি ত্রাণ সামগ্রী পাঠানের জন্য যুক্তরাষ্ট্র ও কানাডাকে অনুরোধ জানানো হয়।
 
তবে হাভার্ড ইউনিভার্সিটির অর্থনীতিবিদ এডওয়ার্ড ম্যাসন, রবার্ট ডর্ফম্যান, স্টিফেন মার্গোলিন আরও স্পষ্ট ও জোরালো বক্তব্য রাখেন। তারা এ বিষয়ে নিশ্চিত ছিলেন যে, ইয়াহিয়া সামরিকচক্রের যাবতীয় দমননীতি সত্ত্বেও বাংলাদেশের অভ্যুদয় অবধারিত। কাজেই নিক্সন প্রশাসনের উচিত রাওয়ালপিন্ডির অনুকূলে আর্থিক ও সামরিক সাহায্য স্থগিত রেখে পূর্ব পাকিস্তান থেকে ইয়াহিয়াকে সৈন্য প্রত্যাহারে বাধ্য করা।
 
প্রায় ৩০ জন বুদ্ধিজীবী সম্মিলিতভাবে ঘোষণা দেন, পূর্ব পাকিস্তানের ন্যায়সঙ্গত দাবিকে শক্তি প্রয়োগের মাধ্যমে উপেক্ষা করার কোনো অধিকার পাকিস্তানের নেই। বলা যায়, সংবাদপত্রের চেয়েও বুদ্ধিজীবীরা বাঙালি স্বার্থের পক্ষে বেশি সোচ্চার ছিলেন।

মার্কিন রাজনীতিবিদ বিশেষ করে কয়েকজন সিনেটর ও কংগ্রেস সদস্য সরকারি নির্লিপ্ততার কঠোর সমালোচনা করেন। সিনেটর এডওয়ার্ড কেনেডি মার্কিন সরকারকে শান্তি প্রতিষ্ঠার উদ্যোগ নেওয়ার জন্য সক্রিয় হতে বলেন, কারণ মার্কিন অস্ত্র ও অন্যান্য সমর উপকরণ দ্বারাই পূর্ব পাকিস্তানে গণহত্যা হচ্ছিল। সিনেটররা তাই পূর্ব পাকিস্তানে সব ধরনের মার্কিন সামরিক সাহায্য বন্ধ করার জন্য আহবান জানান।

একই কারণে সিনেটর স্যাক্সবেও বিক্ষুব্ধ হন। সিনেটর মাসকী, ওয়ালটার মনডেল ও এডওয়ার্ড ব্রুক সম্মিলিতভাবে পররাষ্ট্রমন্ত্রীর কাছে জানতে চান, পূর্ব পাকিস্তানে পরিস্থিতি স্বাভাবিক করার জন্যে নিক্সন প্রশাসন কোনো ভূমিকা পালন করবে কিনা। তারা এজন্য সরকারকে বারবার চাপ প্রয়োগও করতে থাকেন।  
 
অপরদিকে দশজন সিনেটর অনতিবিলম্বে পাকিস্তানের জন্য আর্থিক ও সামরিক সাহায্য বন্ধ করে দিয়ে পূর্ব পাকিস্তানে ত্রাণ সামগ্রী পাঠানোর অনুরোধ জানান। তবে এডওয়ার্ড কেনেডিই নিক্সন প্রশাসনের সবচেয়ে কঠোর সমালোচকের ভূমিকা অবতীর্ণ হন। কংগ্রেস সদস্য কর্নেলিয়াস ই গ্যালোয়ারও (যিনি সাব কমিটি অন এশিয়া অ্যান্ড প্যাসিফিক অ্যাফেয়ার্সের সভাপতি ছিলেন) পাকিস্তানকে অস্ত্র সরবরাহের জন্য মার্কিন সরকারের সমালোচনা করেন। রাজনীতিবিদরা মানবাধিকার লঙ্ঘন ও মার্কিন সমরাস্ত্রের অবাঞ্ছিত ব্যবহারের জন্য কড়া সমালোচনা করেন।
 
যদিও যুক্তরাষ্ট্রের জাতীয় নিরাপত্তা পরিষদে ‘স্পেশাল অ্যাকশন গ্রুপ’র সিদ্ধান্ত মোতাবেক জেনারেল ইয়াহিয়া খান ও জুলফিকার আলী ভুট্টোর কাছে একই মর্মে গোপন নির্দেশ দেওয়া হয়, তারা যে কোনো আক্রমণের পূর্ণাঙ্গ প্রস্তুতি গ্রহণ করে ও বিশ্বজনমত তাদের পক্ষে আনার জন্য যেন কার্যকর পদক্ষেপ নেন।  
 
তবে শেষতক যুক্তরাষ্ট্রের জনগণ, রাজনীতিবিদ, সাংবাদিক ও বুদ্ধিজীবীরা সবসময়ই পূর্ব পাকিস্তানের জনগণের পক্ষে অবস্থান করেন। তারা সবসময় নিজ দেশে (আমেরিকায়) ও দেশের বাইরে পূর্ব পাকিস্তানে সব ধরনের সামরিক হামলা ও অস্ত্র প্রয়োগের বিরোধিতা করেন। ফলে, এ যুদ্ধ বাঙালির পক্ষে একটি সফল পরিণতির দিকে অগ্রসর হতে থাকে।
 
বিশ্বে বাঙালির পক্ষে জনমত গড়ে ওঠার ফলে বাঙালি একটি সর্বোত যুদ্ধে ঝাঁপিয়ে পড়ে। তৎকালীন সামরিক বাহিনীর পূর্বাঞ্চলীয় কমান্ডার জেনারেল আমির আব্দুল্লাহ খান নিয়াজী তার বইয়ে লেখেন, ‘২৫ মার্চের সামরিক অভিযানের পর পুলিশ, রাইফেলস, আনসার, ইস্টবেঙ্গল ব্যাটালিয়ন, নেভি, এয়ারফোর্স পাকিস্তানের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ ঘোষণা করে। এরাই পরবর্তীকালে মুক্তিবাহিনীর নিউক্লিয়াস হিসেবে কাজ করে। ফলে বাঙালির যুদ্ধ একটি গণযুদ্ধে পরিণত হয়। ’
 
এরই মধ্যে ইয়াহিয়া ভারতে আক্রমণ করেন। ফলে, ভারত এ যুদ্ধে সরাসরি অংশ নেয়। এর আগ থেকেই অবশ্য দিল্লি অস্ত্র, প্রশিক্ষণ ও আশ্রয় দিয়ে বাঙালি সাহায্য করতে থাকে।
 
একাত্তরের ডিসেম্বরে ভারতের প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধী কলকাতায় এক বিশাল জনসভায় বক্তৃতা করছিলেন। তখনই তার কাছে একটি চিরকুট আসে। জনসভাতে বসেই জানতে পারলেন যে ইয়াহিয়া খান ভারতের বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষণা করেছেন এবং ভারতের যুদ্ধবিমান ঘাঁটি অমৃতসর, পাঠানকোট, শ্রীনগর, অবন্তিপুর, বোধপুর, আমবালা, আগ্রা , জম্মু, পাঞ্জাব ও রাজস্থানে হামলা চালিয়েছে। একইসঙ্গে পাকিস্তানি সেনাবাহিনী সোলায়মানকি, খেমকারান, পুঞ্চ এবং অন্যান্য সেক্টরেও স্থলপথে আক্রমণ চালায়।  

এ বিষয়ে তখন ইন্দিরা গান্ধীর বক্তব্য ছিল, ‘The fool has done exactly what one had expected.’ এর আগে ২৫ নভেম্বর ইয়াহিয়া খান বলেন, ‘In ten days, I might not be here in Rawalpindi. I will be fighting a war.’ ইয়াহিয়া খান তার কথা মতো ভারতে আক্রমণ করেন। ফলে ভারত ৩ তারিখ থেকেই পাকিস্তানের বিরুদ্ধে পূর্ণাঙ্গ যুদ্ধে অবতীর্ণ হয়। মিত্রবাহিনীর অংশগ্রহণের ফলে মুক্তিযুদ্ধ আরও গতি পায়। বাঙালি বিজয়ের পথে আরও দ্রুত অগ্রসর হতে থাকে।

বাংলাদেশ সময়: ১৩১২ ঘণ্টা, মার্চ ২৪, ২০১৭
এইচএ/

আরও পড়ুন

** ‘স্বাধীন বাংলাদেশ’ আগেই বুঝে যায় যুক্তরাষ্ট্র-চীন

** নিক্সন-কিসিঞ্জারের ‘ড্রেস রিহার্সেল’​

** ইন্দিরা গান্ধীকে সাফল্যের নিশ্চয়তা জেনারেল মানেক শ’র
** নিক্সনের কাছে ইয়াহিয়ার নালিশ

** টিক্কা বললেন, আমরা আগে গুলি চালাইনি
** ‘টাইগার নিয়াজী’ হয়ে গেলেন ‘বাংলার শৃগাল’
** ইয়াহিয়াকে নিকোলাইয়ের হুমকি, সমর্থন চৌ এনলাইয়ের
** ভারতীয় সংসদে বাংলাদেশ নিয়ে উদ্বেগ​
** স্বাধীনতার রক্ত-কথন
** ২৫ মার্চ অধিবেশন! অন্তরালে অপারেশন সার্চ লাইট
** ‘পাকিস্তান রক্ষা’র জন্য হানাদারদের ভুট্টোর আগাম অভিনন্দন
** শক্তির ভারসাম্য খেলায় দৃষ্টি যখন বাংলাদেশে
** স্বাধীনতার পথের বন্ধুরা

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।