বাংলাদেশের ফুটবলে তখন আবাহনী-মোহামেডান দু’পক্ষ। দুই চির প্রতিদ্বন্দ্বী ক্লাবের খেলা দেখতে স্টেডিয়ামে ভিড় জমাতো হাজার হাজার দর্শক।
কুয়ালালামপুরে ১৯৭৩ সালে প্রথম আন্তর্জাতিক ম্যাচ খেলতে নেমেই থাইল্যান্ডের সঙ্গে ২-২ গোলে ড্র করে লাল-সবুজরা। আশির দশকে মালদ্বীপকে ৮-০ উড়িয়ে দিয়েছিল বাংলাদেশ। সেসময় দক্ষিণ এশিয়ার অন্যতম ফুটবল পরাশক্তি হয়ে ওঠেছিল এই ছোট্ট বদ্বীপ। কিন্তু এখন প্রায় শোনা যায়, বাংলাদেশের ফুটবলের সেই স্বর্ণযুগ কোথায় গেল? যারা কিনা টানা তিনবার সাফ চ্যাম্পিয়নশিপের ফাইনালে খেলেছে। ২০০৩ সালে ভারতকে হারিয়ে জিতেছে শিরোপা, সেই বাংলার ফুটবল হারাল কীভাবে?
মানুষ স্বাভাবিকভাবে বলবে, ক্রিকেটের জোয়ার বাংলাদেশের ফুটবলের জনপ্রিয়তা কেড়ে নিয়েছে। শিশু-কিশোররা এখন ফুটবলার নয় মাশরাফি বিন মতুর্জা-সাকিব আল হাসান-তামিম ইকবাল হয়ে ওঠতে চায়। অবশ্য ব্যাপারটা সত্যিও বটে। তবে সেই সঙ্গে এটাও যোগ করা যায়, গোছানো ফুটবলে ঢুকে পড়েছিল দুর্নীতি। বাংলাদেশ ফুটবল ফেডারেশন (বাফুফে) হয়ে পড়েছিল স্রেফ এক অকেজো প্রতিষ্ঠান। কিন্তু আদৌ কি বাংলার ফুটবলের জনপ্রিয়তা ঢাকা পড়েছিল ক্রিকেটের সাফল্যের চাদরে? ব্যাপারটা কতটুক সত্য-মিথ্যা তা বলার চেয়ে এতটুকু বলা যায়, বাংলাদেশে ফুটবলের জনপ্রিয়তা এখনো কমেনি। টুর্নামেন্ট কমে গেছে। অব্যবস্থাপনা বেড়েছে। নইলে চার বছর পরপর যখন বিশ্বকাপের হাওয়া বয়ে যায় তখন কেন বাংলার মানুষ আর্জেন্টিনা-ব্রাজিল দুই গ্রুপের সমর্থক হয়ে লড়াই করে! আর হা-হুতাশ করে, বাংলাদেশ কবে বিশ্বকাপে খেলবে?’
বাংলাদেশ বিশ্বকাপে এখনো সুযোগ পায়নি বটে, তবে এই প্রথমবার বিশ্বকাপের বাছাইপর্বে খেলেছে। এই তো কয়দিন আগে ভারতকে তাদের মাটি সল্টলেকে নাস্তানাবুদ করেছে জামাল ভূঁইয়ারা। জয়টাও প্রায় হাতের মুঠোই চলে এসেছিল বাংলাদেশের। কিন্তু শেষ মুহুর্তে ব্যবধানটা ধরে রাখতে পারেনি জেমি ডে’র দল। তার আগে একই মঞ্চের লড়াইয়ে বঙ্গবন্ধু স্টেডিয়ামে ২০২২ বিশ্বকাপের আয়োজক কাতারের বিপক্ষে হারলেও দুর্দান্ত ফুটবল উপহার দিয়েছিল বাংলাদেশ। এর কিছুদিন আগে ভুটানকে টানা দুই ম্যাচে হারায় জামালরা। ম্যাচগুলোতে স্টেডিয়াম ছিল কানায় কানায় ভর্তি। বাংলাদেশের মানুষ যে এখনো ফুটবল ভালোবাসে এটা তারই প্রমাণ।
সমর্থকদের ফুটবলমুখী করার জন্য লাল-সবুজদের দরকার কেবল ভালো খেলা। এর বেশি কিছু নয়। তাতেই খুশি বাংলার ফুটবলপ্রেমীরা। টানা চার ম্যাচে ভালো খেলার পুরস্কারও পেয়েছে বাংলাদেশ। ফিফা র্যাংকিংয়েও তিন ধাপ এগিয়েছে তারা। ৯২০ পয়েন্ট নিয়ে জেমি ডে’র শিষ্যরা ১৮৭ থেকে উঠে এসেছে। যেখানে দুই ধাপ পিছিয়ে ভারতের অবস্থান ১০৬। অথচ ১৯৯৬ সালে ১১০ নাম্বারে থাকা বাংলাদেশ গত বছর সবাইকে হতাশ করে দিয়ে নেমে যায় ১৯৭-তে। এমন অবনতি বাংলার ফুটবল সমর্থকদের কাছে কতটুকু যন্ত্রণার ছিল তা বুঝানো অসম্ভব।
তবে আশার কথা, বাংলাদেশ আবারও সামনের দিকে এগোচ্ছে। মাঠে আবারও দর্শকের আনাগোনা বাড়ছে। বাংলাদেশ এখন পেয়েছে জামাল ভূঁইয়ার মতো অধিনায়ক-মিডফিল্ডার এবং জেমি ডে’র মতো কোচ। বিপলু, সাদ, ইব্রাহিম, ইয়াসিনদের মতো লড়াকু ফুটবলার। বাংলাদেশের ফুটবল জাগাতে হলে নিয়মিত আয়োজন করতে হবে ঘরোয়া ও আন্তর্জাতিক টুর্নামেন্ট।
বর্তমানে চট্টগ্রামে এম এ আজিজ স্টেডিয়ামে চলছে শেখ কামাল আন্তর্জাতিক ক্লাব কাপ। যেখানে অংশ নিয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, মালেয়শিয়া, মালদ্বীপ ও লাওসের আটি ক্লাব। খেলছে ২০ দেশের ফুটবলার। ইতোমধ্যে জমে ওঠেছে টুর্নামেন্টটি। দর্শকের উপস্থিতিও চোখে পড়ার মতো। তেমনি ধারাবাহিকভাবে আয়োজন করতে হবে বাংলাদেশ প্রিমিয়ার লিগ। বিপিএলে দল সংখ্যা বেড়েছে। আসছেন বিদেশি খেলোয়াড়রা। তাদের পাশাপাশি সুযোগ দিতে হবে স্থানীয় খেলোয়াড়দের। তবেই তৈরি হবে ভালো ফুটবলার।
বিপিএলের গত আসরে চ্যাম্পিয়ন হয়েছে নবাগত দল বসুন্ধরা কিংস। তারা নিয়ে এসেছে স্প্যানিশ কোচ অস্কার ব্রুজন ও কোস্টারিকার হয়ে বিশ্বকাপে খেলা তারকা দেনিয়েল কলিন্দ্রেসকে। তার দেখাদেখি চট্টগ্রাম আবাহনী লিমিটেডে এসেছেন ঘানার হয়ে ২০১০ বিশ্বকাপ মাতানো ফরোয়ার্ড প্রিন্স ট্যাগো। বাংলাদেশে খেলছেন লেবাননের জাতীয় দলের তারকা জালাল। আছেন কিরগিজস্থানের বখতিয়ার। এছাড়াও পৃথিবীর নানা প্রান্ত থেকে বাংলাদেশে খেলতে ছুটে আসছে অনেক তারকা ফুটবলার।
সার্বিকভাবে ঘরোয়া ফুটবলের মান ও প্রতিদ্বন্দ্বিতা বাড়লে বাংলাদেশের ফুটবল আবারও স্বর্ণযুগে ফিরবে। তার সঙ্গে বাড়াতে হবে স্কুল-কলেজে ফুটবল টুর্নামেন্ট। মাদক-অপরাধ থেকে কিশোর-তরুণদের বাঁচাতে পারে খেলাধুলাই। তার জন্য মাঠে আসার সুযোগ করে দিতে হবে তাদের।
বাংলাদেশ সময়: ১৪৪৮ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৫, ২০১৯
এমএইচএম