ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ক্ষমা করো রূপমুহুরী

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ২০১৭ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৬
ক্ষমা করো রূপমুহুরী ছবি: সোহেল সরওয়ার

আলীকদম (বান্দরবান) থেকে ফিরে: সাত সকাল। এ সময়টায় এখানে সকাল থাকে শিশিরে মোড়া।

কিন্তু এরই মধ্যে আড়মোড়া ভেঙে উধাও হয়েছে কুয়াশার দল। রাতের শিশিরে ধুলো ধোয়া সকালে তাই বেশ দূর পর্যন্ত দৃষ্টি চল‍ার কথা। কিন্তু চারিপাশের সুউচ্চ পাহাড় ঠেকিয়ে দিয়েছে দৃষ্টিসীমা। পুবের উঁচু পাহাড় শ্রেণির ওপাশ থেকে সূর্যটা উঁকি দিতে সময় নেবে আরো।  

আকাশের গায়ে হেলান দিয়ে দাঁড়িয়ে থাকা পাহাড়ের পা ছুঁয়ে বয়ে চলা মাতামুহুরীর বুকজুড়ে শরীর জুড়ানো শীতল বাতাস। বাংলাদেশের আর সব নদীর মতো এ নদীর উজান উত্তরে নয়, দক্ষিণে। আলীকদম ঘাট থেকে তাই পূর্ব ঘুরে দক্ষিণেই ছুটলো ইঞ্জিন নৌকা।  

একটা রঙিন মাছরাঙা পানির বড়জোর ফুটখানেক ওপর দিয়ে ক্ষিপ্র গতিতে ছুটছে। কিন্তু কপাল খারাপ তার। বহুক্ষণ ছুটেও কোনো শিকার পেলো না। প্রাতরাশটা বুঝি আজ দেরিতেই হবে তার।  

বর্ষা শেষ হওয়ায় স্রোতের তেজ কমেছে মাতামুহুরীতে। নদীপাড়ে আকাশ পানে উঠে যাওয়া পাথুরে পাহাড়গুলো থেকে বেরিয়ে আসা ঝরনা আর ঝিরিগুলোতে জল গড়ানোর দাগ থাকলেও প্রবাহ নেই। উজানের উৎস্যমুখে নিশ্চয়ই পাহাড় গড়িয়ে পানি নামার মৌসুম শেষ। মাঝ নদীতে বড়জোর ফুট তিনেক গভীরতা এখন। রিজার্ভ ফরেস্ট থেকে কেটে নদীতে ভাসিয়ে দেওয়া বাঁশের ভেলাগুলো তাই আটকে গেছে চরপড়া পাড়ে। আগামী বর্ষার আগে আর ফুঁসে উঠবে না মাতামুহুরী।  

পলিজমা পাড়ে শীতের সবজি চাষের আয়োজন। যন্ত্রের যুগে মাতামুহুরীর বুক চষছে হালের গরু। কোদাল দিয়ে কুপিয়ে সমতল করা হচ্ছে উঁচু-নিচু পাড়। বাদাম আর সবজি ক্ষেতে কীটনাশক স্প্রে করছে চাষী। মাতামুহুরীর হাঁটুজলে বেঁচে থাকা বাকি মাছ ক’টার ভাগ্যে বিপদ আনবে এই কীটনাশকই।

অশ্বখুরের মতো ফুলে থাকা বাঁকে পানির কিনারা ছুঁয়ে দাঁড়িয়ে আছে এক ঝাঁক বক, মানুষের উপস্থিতিতে একটু বুঝি বিরক্ত। পাহাড়ি জনপদের নারীরা বাসি বাসন ধুয়ে নিচ্ছে ঘোলা জলে। একটু পর পর জলপরীরা জলকেলীতে মত্ত। বিদেশ-বিভূঁইয়ের মানুষগুলোকে খুব একটা পাত্তা দিলো না তারা।  
পানি কম থাকলেও এই নদীই উজান পানে একমাত্র যাতায়াত পথ। নয়তো পাহাড় ডিঙ্গোতে হবে পায়ে। এদিককার পাহাড়গুলোও বেশ খাড়া। তাই ভরা মৌসুমের মাতামুহুরী ছাড়া আলীকদমের দক্ষিণ-পূর্ব দিকটা দুর্গমই বটে।  

বান্দরবানের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের যে পাহাড়শ্রেণি আরাকান ও পার্বত্য চট্টগ্রামকে আলাদা করে রেখেছে, সেই পাহাড় শ্রেণীতেই মাতামুহুরী নদীর উৎপত্তি। স্থানীয় ভাষায় যাকে বলা হয় মুরী খ্যং। সাঙ্গু নদীও ওই পাহাড় শ্রেণিরই নদী।

সাঙ্গুর সঙ্গে সমান্তরালে প্রবাহিত হয়ে লামা পেরিয়ে চকোরিয়ায় কয়েকটি ভাগে বিভক্ত হয়ে সাগরে পতিত হয়েছে মাতামুহুরী। অনেক উপনদী আছে এর উপরের দিকে। আছে ছোট ছোট মৌসুমী ঝরনা। আলীকদমের কাছে আলীর পাহাড়ের কোল ঘেঁষে বয়ে আসা টুইন খ্যং বা টোয়াইন খ‍ালও এ নদীর ‍অন্যতম এক উপনদী।

ঢিমেতালে বয়ে চলা ঘোলা স্রোত বেয়ে আরো কিছুটা উজানে ভাসতেই বদলে গেলো দু’পাশের দৃশ্যপট। নদীর ওপর ঝুঁকে আসা খাড়া পাহাড়ের গা থেকে মাথার ওপর ঝুলে ‍আছে অতিকায় ফার্নের অরণ্য। গর্জন গাছের শাখাহীন গুড়ি থামের মতো উঠে গেছে উপরে। এক জায়গায় তো লতার ঝোপ হাতির আদল নিয়েই নুয়ে এসেছে পানির ওপর। বন্য কলাপাতা আর বয়সী গাছের উপস্থিতিও নেহায়েত কম নয়। ঘন সবুজ অরণ্যের দেওয়ালে বিভিন্ন প্রজাতির ফড়িং আর প্রজাপতির মেলা।  

শিকলের মতো দক্ষিণ থেকে উত্তরে সমান্তরালভাবে বিস্তৃত পর্বতশ্রেণির ফাঁকে বহমান মাতামুহুরী পাড়ের মাটি উর্বর দোঁআশ। তবে পাহাড়গুলোতে শিলামাটির দাপট। গাঢ় বাদামি রঙের পাথরগুলো নিশ্চিতভাবে আগ্নেয় শিলা থেকে উৎপন্ন।

এই উজ্জ্বল চিরসবুজ বনাঞ্চলের সঙ্গে মালয়েশিয়ার বনাঞ্চলের অনেক মিল আছে। দেশি বৃক্ষ না হলেও এ এলাকায় ভালো জন্মে সেগুন। দু’পাড়ের সবুজ বনে জংলী আলুর আধিক্য আছে বলে শোনা যায় এদিকটায়। আরো আছে নানা প্রজাতির ওষুধি গাছ। কিছু গাছের শেকড় ও পাতা থেকে তৈরি হয় রঙ। কিছু লতা দিয়ে ধরা হয় মাছ।  

কিন্তু এসবকে সাক্ষী রেখে আর খুব বেশি উজানে এগোনো গেলো না। যাওয়া হলো না পোয়ামুহুরী বাজারের বিখ্যাত দুই ঝরনার পাদদেশে। ওখানে রূপমুহুরী নামে যে ঝরনাটা দেখে ১৮৬০ এর দশকে উদ্বেলিত হয়েছিলেন অবিভক্ত পার্বত্য রাঙামাটির প্রথম জেলা প্রশাসক টিএইচ লুইন, তার নাম এখন রূপমুহুরী। সভ্য সমাজের আয়ত্বের অনেক আড়ালে পড়ে থাকা ওই ঝরনার রূপ সুধা পান করতেই তো মাতামুহুরীর উজান বাওয়া। কিন্তু জানালী পাড়া থেকে ফিরে যেতে হচ্ছে আলীকদমে।  

তাই এ যাত্রায় আর রূপমুহুরীর কাছে যাওয়া হলো না। দেখা হলো না তার মেলে থাকা রূপ। গায়ে মাখা হলো না উঁচু থেকে পড়া পানির জলীয় সুখ। রূপমুহুরী নিশ্চয়ই পরিস্থিতিটা বুঝে ক্ষমা করে দেবে।  

আরও পড়ুন:

** গিরিখাদ পেরিয়ে রহস্যময় আলীর সুড়ঙ্গে

** সবচেয়ে উঁচু রাস্তায় হাতের মুঠোয় প্রাণ
** পায়ের নিচে ছবির মতো বলি পাড়া
** পাহাড়ের উপরে দেবতার পুকুর 
** পাহাড়ের খাদে রাম-সীতার ধুমনিঘাটে
** বাঁশের রাজবাড়িতে এক চক্কর
** বাংলাদেশে জন্ম নেওয়া ভারতীয় বাঁকে
** বয়সী বটের নিচে বিশ্বাসের বাসা

** গিরিখাদের হাজারছড়ায় সীমাহীন বিস্ময়

** দুর্গম বন-পাহাড়ের সুন্দর ঝরনায়
** আলীর রহস্য গুহা আর আলীকদমের যতো কথা

বাংলাদেশ সময়: ২০১৩ ঘণ্টা, অক্টোবর ২৬, ২০১৬
এইচএ/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।