ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

জলে ভাসা রকেট কাহিনী

জাকারিয়া মন্ডল, সিনিয়র আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১২১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
জলে ভাসা রকেট কাহিনী ছবি: শুভ্রনীল সাগর-বাংলানিউজ

এমভি মধুমতি থেকে: ডাকাতিয়া নদীর মুখে এসে ভেরি হাই ফ্রিকোয়েন্সি (ভিএইচএস) ওয়্যারলেস সেট ওপেন করলেন মীর আব্দুল খলিল।চাঁদপুর বন্দরের নিজস্ব ঘাটে ভেড়ানোর পথে গোটা চার জাহাজকে সতর্ক করলেন রকেট সার্ভিস এমভি মধুমতির এই থার্ড অফিসার।

একটু পরই সরু চ্যানেলে ঢুকে পড়লো মধুমতি। চাঁদপুর জেটিতে ভেড়ানোর মুখে ব্যস্ততা আরো বেড়ে গেলো তার।

একটু আগেই ১১ দশমিক ২ নটিক্যাল মাইল গতিতে ছুটছিলো অভ্যন্তরীণ রুটের সবচেয়ে অত্যাধুনিক জাহাজ মধুমতি।

আজদাহা শরীরটাকে ঘাট ভেড়াতে তাই বেশ কসরত করতে হলো ক্রুদের। আর সারাটা সময়ই ওয়াকিটকি হাতে অপারেশনের পুরোভাগে রইলেন মীর খলিল। জাহাজের মাস্টার মাসুদ পারভেজ তখন নৈশভোজের কথা বলে মাস্টার ব্রিজ থেকে বিদায় নিয়েছেন।

ছবি: বাংলানিউজঘাটে থিতু হবার পর মাস্টার ব্রিজে জ্বলে ওঠা আলোয় এবার ইক্যুইপমেন্টগুলো ভালো করে দেখে নেওয়ার সুযোগ হলো। সবার ডানে ইকো সাউন্ডার। পানি কোথায় কতোটা গভীর হলো, পানির নিচে কোথায় কি নড়ছে সবই ধরা পড়বে এ যন্ত্রে। এমনকি আশপাশ দিয়ে কোনো মাছ গেলেও তার দৈর্ঘ্য ধরা পড়বে এতে। এর পর আছে আধুনিক রাডার আর জিপিএস সিস্টেম। তার পাশে ভিএইচএস দিয়ে ৫০ থেকে ১শ’ কিলোমিটার ফ্রিকোয়েন্সির মধ্যে অন্য কোনো জাহাজের সঙ্গে কথা বলা যাবে।

এরপর আছে ম্যাগনেটিক আর জাইরো কম্পাস, তারপর পর‌্যায়ক্রমে স্পিড লগ, উইন্ড ট্র্যাকার, গ্লোবাল মেরিটাইম ডিসট্রেন্স সিগন্যাল সিস্টেম (জিএমডিএসএস)। এটা হলো অন্য কোনো জাহাজের সঙ্গে কথা বলার বিশেষ ব্যবস্থা। আর ম্যাগনেটিক কম্পাস সেই কলম্বাসের সময় থেকেই নাবিকদের পথ দেখালেও তাতে ইরর কিছু থাকেই। সে বিবেচনায় জাইরো ইলেকট্রিক কম্পাস রিডিং দেয় নির্ভুল। এটা অটো পাইলটিং এর কাজে লাগে।

এটা মূলত নো-ম্যান ওপারেশনাল (এনএমও) ডিভাইস। যেমন, কোনো নির্দিষ্ট কোর্স সেট করে ২০ নটিক্যাল মাইল হয়তো অটো পাইলটের হাতে ছেড়ে দেওয়া হলো। তাহলে জাহাজটা কোনো মানুষের নির্দেশনা ছাড়াই ওই ২০ নটিক্যাল মাইল একই গতিতে এগুবে। যদিও আমাদের নৌপথে অটো পাইলটিংয়ের সুযোগ নেই বললেই চলে।

এতো এতো যন্ত্র থাকলেও সতর্কতায় তিল পরিমাণ ঢিল দেওয়া হয় না ক্রুদের। ঝড়-জলোচ্ছ্বাসের কবলে পড়লে যাত্রীদের কথাই ভাবতে হয় সবার আগে।

ছবি: বাংলানিউজচাঁদপুরে জাহাজটা থাকতেই হন্তদন্ত হয়ে মাস্টার ব্রিজে এলেন মাস্টার মাসুদ রানা। বছর চারেক হলো বিআইডব্লিউটিসিতে চাকরি করছেন তিনি। ২৮ বছরের নাবিক জীবনের অভিজ্ঞতা থাকলেও নিজের ইঞ্জিন রুমটাই এখনো ঠিকঠাক চেনা হয়নি তার! কিছুক্ষণ সাইরেনের সুইচ খুঁজে গলদঘর্ম হলেন। থার্ড অফিসারের সহায়তায় সেটা খুঁজে পেতে সময় লাগলো বেশ। জাহাজটা ঘাটে ভেড়ানো অবস্থাতেই তিনি পরীক্ষা করতে শুরু করলেন সাইরেনের আওয়াজ। ঠিক যেনো বাচ্চাদের খেলনা হাতে পেয়েছেন।

সাইরেনের আওয়াজে তখন ঘাট আর জাহাজ যাত্রীদের কানে তালা লাগার দশা। একটু আগে এই মাস্টারই তার সঙ্গে কথা বলার জন্য দু’টো বিদিক কিসিমের শর্ত দিয়েছেন। প্রথমত, মন্ত্রণালয়ে দরখাস্ত করে তার সঙ্গে কথা বলার অনুমতি নিতে হবে। দ্বিতীয়ত, যেহেতু তিনি জাহাজের ক্যাপ্টেন তাই আর একজন ক্যাপ্টেন পদমর‌্যাদার লোক ধরে আনতে হবে।

এ দুই শর্ত ছাড়াও চরম অসহযোগিতামূলক আচরণ করেন মাস্টার মাসুদ। কথাবার্তাও কেমন যেনো অসংলগ্ন। যাত্রা শুরুর আগে নয়, মাঝপথে এই সাইরেন চেক করার ভেতরেও কি একটু অসংলগ্নতার ছোঁয়া খুঁজে পাওয়া গেলো?

ডাকাতিয়া চ্যানেল থেকে বেরিয়ে ফের মেঘনায় পড়লো জাহাজ। হিজলার কাছটায় আজ মাঝ ধরা নৌকার দেখা পাওয়াই দুষ্কর হয়ে পড়লো। এবার ভরা জোয়ার ঠেলে এগুতে হচ্ছে জাহাজটাকে। জোয়ারের স্রোতে উজান বাইছে কচুরিপানার দঙ্গল। জাহাজের আওয়াজ একটু বেড়ে গেছে আগের চেয়ে।

বরিশালের কীর্ত্তনখোলায় এসে খানিকটা বিশ্রাম নিলো জাহাজটা। তারপর লোহালিয়ার মুখ হয়ে সুগন্ধা নদীতে যখন ঝালকাঠি জেটিতে ভিড়লো- তখন রুপালি পানিতে সকালের চিকচিকে রোদ। মিথিক্যাল রিভার বিষখালী আর জীবনানন্দের মরা ধানসিঁড়িকে বাঁয়ে রেখে ব্রিটিশদের কাটা বাংলার সুয়েজ খাল খ্যাত গাবখান চ্যানেলে ঢুকে পড়লো জাহাজ। চ্যানেল থেকে বেরিয়ে সন্ধ্যা নদীকে ডানে রেখে দক্ষিণে ছুটলো কচা নদীর বুক বেয়ে।

দিনের আলোয় ব্যস্ততা কমে গেছে মাস্টার ব্রিজে। মাস্টার আর থার্ড অফিসার গেছেন বিশ্রামে। জাহাজের হাল এখন তাই সহকারীদের হাতে।

বলেশ্বর হয়ে আরো দক্ষিণে সাগরের দিকে ছোটার পর বাগেরহাটের শরণখোলায় ভিড়লো মধুমতি। তারপর উল্টো ঘুরে উজানে ছুটলো ফের। কিছু দূর উজান বেয়ে বলেশ্বর ছেড়ে পশ্চিমে মধুমতি ছুটলো মোড়েলগঞ্জের দিকে। মোড়েলগঞ্জ ছাড়ার পর নিচের ক্যান্টিনের পাশে দেখা গেলো মাস্টার মাসুদ পারভেজকে। পরনে গতরাতের ইউনিফর্মটা নেই। ওয়াকিটকি হাতে যাত্রীদের তদারকি করছেন। মাস্টার ব্রিজ ছেড়ে নিচের ডেকে কি বিশেষ ডিউটি পড়লো তার!

জাহাজ ততোক্ষণে ব্রিটিশদের কাটা ঘষিয়াখালী চ্যানেলের মুখে। সকালে পেরিয়ে আসা গাবখান আর এই ঘষিয়াখালী চ্যানেল কেটে জলপথে চট্টগ্রামের সঙ্গে খুলনার দূরত্ব অন্তত ৫শ’ কিলোমিটার কমিয়ে দিয়েছে ব্রিটিশরা। তবে পূর্বে বলেশ্বর আর পশ্চিমে পশুর থেকে আসা উভয় মুখী জোয়ারে অনেকটাই থিতু থাকে ঘষিয়াখালীর পানি। এখানকার পানিতে মিশে থাকা প্রচুর পলি তাই বছরভরই জমা হতে থাকে চ্যানেলের তলায়। এ কারণেই নৌ-চলাচল ঠিক রাখতে নিচের পলি অপসারণে নিয়মিত ড্রেজিং দরকার হয় ঘষিয়াখালীতে।

পৌষের শুরুতেও এ চ্যানেলটার অর্ধেকটা কেবল নৌ-চলাচলের উপযোগী বলে চিহ্নিত করা আছে সারি সারি বয়ায়। পরিত্যক্ত অংশটায় অসংখ্য মাছ ধরার জাল পেতে রাখা। পাড়ে সারি সারি চিংড়ি ঘের।

ঘষিয়াখালী চ্যানেল পার হলে রামপাল ছুঁয়ে বিকেল নাগাদ মংলায় নোঙর ফেললো মধুমতি। শেষ হলো প্রায় ২৪ ঘণ্টার টানা জল অভিযান। মধুমতির শেষ গন্তব্য অবশ্য খুলনা।

** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি

বাংলাদেশ সময়: ১৭১১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৬, ২০১৬
জেডএম/এটি/

সহযোগিতায়

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।