ঢাকা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে: সপ্তাহখানেক আগেই ঢাকা থেকে বাগেরহাট যাবেন ঠিক করেন বেসরকারি চাকরিজীবী নেয়ামত উল্লাহ। কিন্তু বাসের জন্য যে টিকিট কাটবেন সে ফুসরতই পাচ্ছিলেন না।
কর্মদিবসে টিকিটটা কাটতে গেলে যানজটে পড়ে জীবনের খাতা থেকে পাক্কা ৩-৪ ঘণ্টা খরচা করতে হবে। আবার যে উপস্থিত টিকিট কাটবেন সে ভরসাও পাচ্ছিলেন না, সরকারি ছুটি থাকায় তার ভ্রমণের দিন যাত্রীর চাপ বাড়তে পারে বলে। কাকে দিয়ে টিকিটটা কাটাবেন-ভাবনায় পড়ে গেলেন তা নিয়ে।
পরে এক সহকর্মীই উপায় বাতলে দিলেন, অনলাইনে একটি টিকিট বুকিং সাইটে গিয়ে সিট কিনে রাখতে। যাবতীয় প্রক্রিয়া অনলাইনেই হবে, এমনকি অর্থশোধও হবে অনলাইন ব্যাংকিংয়ে।
নেয়ামত সহকর্মীর কথা মতো, টিকিট বুক করে এমন একটি ওয়েবসাইটে ঢুকলেন, কয়েকটি ধাপ পেরিয়ে সহজেই নিজের পছন্দমতো সিট বুক করে রাখলেন।
শুক্রবার (১৭ ডিসেম্বর) ঢাকার কল্যাণপুর থেকে রয়্যাল বেঙ্গল টাইগারের রাজত্ব সুন্দরবনের উদ্দেশে বাগেরহাট যাত্রায় এই নেয়ামত হলেন সহযাত্রী।
অনলাইনে টিকিট কেনে তার স্পষ্ট আর উচ্ছ্বসিত মূল্যায়ন, “ভাই, দেশে এই ইন্টারনেট আর কিছু দিক না দিক, মানুষের অন্তত সময় বাঁচানোর কিছু উপায় তৈরি করে দিয়েছে। আমি অফিস আর ব্যক্তিগত কাজ ছাড়া একটুও বাইরে বেরুনোর সময় পাচ্ছিলাম না। এই বাসের টিকিট যদি আমাকে কাউন্টারে এসে কিনতে হতো, তবে সময়ের টানেপড়ে যেতাম, কিন্তু অনলাইন সিস্টেমটা এই টান থেকে আলগা হওয়ার সুযোগ দিয়েছে। ”
শুক্রবার যে বাসে যাত্রা হয়েছে, তাতে এমন মোট ৪ চার যাত্রী অনলাইনে টিকিট কিনেছেন। তাদেরও জীবনের খাতা থেকে অন্তত ২-৩ ঘণ্টা বেঁচে গিয়েছে ধরে নেওয়া যায়। চার জনের এভাবে ২-৩ ঘণ্টা করে বেঁচে গেলে হিসাবে দেখা যায়, একজন মানুষের একটি কর্মদিবসেরও বেশি সময় বাঁচিয়ে দিয়েছে এই ইন্টারনেট।
এতো গেলো শুক্রবার রাত ১০টার কোচের হিসাব। সুপারভাইজার শহীদের ভাষ্য অনুযায়ী, এখন প্রতি বাসেই এমন অনলাইনে টিকিট কেনা অনেক যাত্রী থাকেন। এমনকি কোনো কোনো সময় সে সংখ্যাটা ৩৫-৩০ পর্যন্ত ছুঁয়ে ফেলে। চূড়ান্ত হিসাবে তাহলে কতোটা সময় বেঁচে যায়, সে হিসাব কষার কি আর দরকার আছে?
দেশে এখন অনেক অনলাইন টিকিট বুকিং সাইট রয়েছে, যারা বাস-ট্রেনের টিকিট অনলাইনেই নিশ্চিত করে দেয়। তথ্যপ্রযুক্তি অন্তত এক্ষেত্রে আশীর্বাদ ঢেলে দিয়েছে বলে মনে করেন সহযাত্রী নেয়ামত।
পাটুরিয়া পেরিয়ে দৌলতদিয়ায় উঠতে ফেরিঘাটে অপেক্ষারত বাস থেকে নেমে কমলা কিনছিলেন তিনি। রাজধানীর সহনীয় হাওয়া এখানে চাদর টানতে বাধ্য করছে। কমলা বিক্রেতাকে জিজ্ঞেস করছিলেন কতোক্ষণ লাগতে পারে? বেরসিক বিক্রেতা যেই না বললেন, “ …২-৩ ঘণ্টাও লাগতে পারে”, অমনি মুখটাতে বিরক্তি প্রকাশ পেলো নেয়ামতউল্লাহর।
কমলা কিনতে গিয়েও রেখে দিলেন। বললেন, “ভাই, তাহলে আমি ঢাকায় ২-৩ ঘণ্টা সময় বাঁচিয়ে কী লাভটা করলাম? সময় সেখানে আমার লস হয়নি, এখন এখানে তো পুষিয়ে নিচ্ছে। কী হবে বলেন তো?”
নেয়ামতের ‘কী হবে বলেন’ এর মতো সময় নষ্টে বিরক্তি আর ক্ষোভ প্রকাশ করতে দেখা গেলো বাসের অন্য সহযাত্রীদেরও।
সুন্দরবন দেখতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাইক্রোবায়োলজি ডিপার্টমেন্টের ৮ জন শিক্ষার্থী-বন্ধু মংলা যাচ্ছেন। পাটুরিয়া ফেরিঘাটে আসার আগ পর্যন্ত তারা বেশ উচ্ছ্বাসে-আনন্দে কাটাচ্ছিলেন। কী খেয়ে কোথায় কী ধরনের ছবি তুলে ফেসবুকে পোস্ট দিয়ে কোন বন্ধুকে ট্যাগ করে ‘জ্বালিয়ে মারবেন’ সে শলাপরামর্শে হাসাহাসি করছিলেন। কিন্তু ফেরিঘাটের লম্বা লাইন তাদের সেই উচ্ছ্বাসকে যেন দমিয়ে দিতে চাইছিলো।
একজন বলেও উঠলেন, “দেরিতে পৌঁছালে দেখো পরিকল্পনা ‘মাঠে মারা’ যায় কিনা। ” তার সে মন্তব্যে স্বভাবতই প্রশ্ন ঠেকলো, এমন কতোজনের পরিকল্পনা ‘মাঠে মেরেছে’ পাটুরিয়া-দৌলতদিয়া ফেরিঘাট?
বাংলাদেশ সময়: ০৭৩৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৬
এইচএ/জেডএস