ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর!

হুসাইন আজাদ, অ্যাসিস্ট্যান্ট আউটপুট এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০২২৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৯, ২০১৬
ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর! ছবি: আসিফ আজিজ-বাংলানিউজ

বাগেরহাট: পৌষের বিকেলে মগরা গ্রামের ঢিবিটার দক্ষিণ প্রান্তের জমিতে একটা শিংছাড়া গরু চরে বেড়াচ্ছিলো। তাকে ঘিরে দস্যিপনা দেখাচ্ছিলো দু’টো বাছুর। একবার পাঁচ হাত লাফিয়ে সামনে চলে আসে তো, আরেকবার দেয় পেছনে ছুটে। পেরিয়ে যায় ১৫-২০ ফুট দূরত্বে বাশঝাঁড় পর্যন্ত।

অদূরে বসে গল্পে মগ্ন রোদ পোহাচ্ছিলেন ক’জন মধ্যবয়সী নর-নারী। এই প্রান্তের উল্টোদিকে ডিবিটা বেশ উঁচু, সেই উঁচু জায়গা ঘে‍ঁষেই ক্রিকেট ব্যাট আর বল নিয়ে হইচই করে খেলছিলো দুরন্ত কিশোরের দল।

চিত্রটা অন্য দশটা গ্রামের মতোই বটে।

অথচ মধ্যযুগে মগরার এই জায়গাটায় ছিলো রাজ্যের কর্মব্যস্ততা। নাগরিক কোলাহল। হয়তো ছিলো সৈন্যদলের ঢাল-তলোয়ারের ঝনঝনানি, এমনকি প্রশাসক মহলের সভা-আলোচনার হাঁক-ডাকও। কিন্তু সময় আর প্রকৃতি মিলে সেই নগরকে বিস্মৃত করে রেখে দিয়েছে কতো-শতো বছর!

প্রায় ছশ’ বছর আগে গড়ে ওঠা এই নগরের নাম খলিফাতাবাদ। গৌড়ের সুলতান নাসিরুদ্দীন মাহমুদ শাহের আমলে (১৪৩৬-৫৯) বাগেরহাট এলাকা অধিকার করেন তার অনুসারী প্রখ্যাত সুফিসাধক খান জাহান। মনে করা হয়, এই সময়টায় গড়ে উঠেছিলো খলিফাতাবাদ নগর। এই খলিফাতাবাদের অংশবিশেষ সম্প্রতি মাটি খুঁড়ে আবিষ্কার করা হয়। যেটাকে বলা হচ্ছে ‘হাবেলি খলিফাতাবাদ’। এই হাবেলি খলিফাতাবাদের পুরোটাই পাকা কাঠামোর ওপর গড়ে ওঠে।

১৯৮৫ সালে বিস্মৃত নগরীর কয়েকটি স্থাপত্য নিদর্শন বিবেচনায় ইউনেস্কো ১৯৮৫ সালে ‘মসজিদের শহর বাগেরহাট’কে বিশ্ব সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত করে। এই সম্মাননা গায়ে নিয়ে থাকলেও এতোদিন কয়েকটি মসজিদই কেবল বাগেরহাটের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের প্রতিনিধিত্ব করেছে। মাটি খুঁড়ে ধ্বংসপ্রাপ্ত ও বিস্মৃত খলিফাতাবাদের অংশবিশেষ উদ্ধার করায় এখন মধ্যযুগের এ শহরের নগর পরিকল্পনার নানা দিক সম্পর্কেও ধারণা পাওয়া যাচ্ছে। ছবি- আসিফ আজিজ-বাংলানিউজ
এই খনন কার্যের পর প্রত্নতত্ত্ববিদরা বলছেন, অসংখ্য মসজিদ, জলাধার, সড়ক ও সেতু নির্মাণ করে খলিফাতাবাদকে বাসোপযোগী এক নগরে পরিণত করেছিলেন খান জাহান।

খলিফাতাবাদ নগর আনুমানিক উত্তর-দক্ষিণে ৬ কিলোমিটার এবং পূর্ব-পশ্চিমে আড়াই কিলোমিটার জায়গাজুড়ে ছিলো। বর্তমান মাটি খুঁড়ে আবিষ্কৃত হাবেলি খলিফাতাবাদ রয়েছে ১০ একর জায়গায়।

প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের অধীনস্থ বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ানের কার্যালয়ের তথ্য মতে, ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় সাড়ে তিনশো মিটার দূরে হাবেলি খলিফাতাবাদের অবস্থান। খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে এটি ৫০০ মিটার উত্তরে।

মরগা ও নিকটস্থ সুন্দরঘোনা গ্রামের মাঝামাঝি কোনো স্থানে খান জাহানের বসতভিটে আছে সেটা বহুকাল আগে থেকেই লোকমুখে ছিলো। কিন্তু ঠিক স্থানটা কোনোভাবে নির্ধারণ করা যাচ্ছিলো না। কিন্তু ১৯৯৬-৯৭ সালের দিকে মরগার এই ঢিবি থেকে ইট, স্থাপনায় ব্যবহৃত অন্যান্য সরঞ্জামের খণ্ড খণ্ড বেরিয়ে আসতে থাকায় স্থানীয়রা প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের দৃষ্টি আকর্ষণ করেন। এরপর সমীক্ষা চালিয়ে বোঝা যায়, এখানেই ছিলো খান জাহানের বসত ভিটে। ছবি- আসিফ আজিজ-বাংলানিউজ
নানা প্রক্রিয়ার পর ২০০১ সালে প্রথম এখানে খনন কাজ শুরু হয়। এরপর ২০০৮ সাল থেকে প্রতিবছর কাজ চলতে থাকে। প্রতিবারই খনন করে নতুন নতুন দ্রব্য-সরঞ্জাম উদ্ধার করা হতে থাকে।

এই হাবেলি খলিফাতাবাদে ঘুরে দেখা যায়, ঢিবি খুঁড়ে দালান বা পাকা ঘরের কাঠামো চিহ্নিত করলেও সেগুলো আবার পলিথিনের ওপর মাটি দিয়ে ঢেকে রাখা হয়েছে, স্থানীয়দের উৎপাতে স্থাপনা নষ্ট হওয়ার শঙ্কায় এই পদ্ধতি অবলম্বন করা হচ্ছে।

হাবেলি খলিফাতাবাদের দক্ষিণ দিকে রয়েছে আন্ধির পুকুর, আর উত্তর-পূর্ব কোণে রয়েছে বিষ পুকুর নামে আরেকটি জলাশয়। আবিষ্কৃত হাবেলি লাগোয়া একটি শান বাঁধানো ঘাটের আকার দেখা যায় আন্ধির পুকর ঘেঁষে। আন্ধির পুকুরের তিন পাশেই ঘন গাছপালা, তবে খান জাহানের নির্মিত প্রাচীন সড়ক ঘেঁষা বিষ পুকুরের আশপাশে দুয়েকটা নারিকেল গাছ ছাড়া কিছু চোখে পড়লো না।

খনন করেও ফের সংরক্ষণেরই লক্ষ্যে ঢিবি ঢেকে দেওয়ায় এই হাবেলি খলিফাতাবাদে কী আছে তা স্পষ্ট বোঝা না গেলেও সংশ্লিষ্ট প্রত্নতত্ত্ববিদরা জানালেন, এখানে এখন পর্যন্ত সুলতানি যুগের ব্যবহৃত বিভিন্ন ধরনের সৌখিন তৈজসপত্র, মৃৎশিল্প, চুন দিয়ে তৈরি স্টোন ওয়্যার পাওয়া গেছে। এছাড়া ধ্বংসাবশেষের মধ্যে একটি সেফটিক ট্যাংকসহ পাকা শৌচাগার, পানি সরবরাহের কাজে ব্যবহৃত ১৭ মিটার পোড়া মাটির তৈরি পাইপ, পানি নিষ্কাশন নালা ও ইটের তৈরি কার্ভাড নালা উদ্ধার করা হয়েছে। ছবি- আসিফ আজিজ-বাংলানিউজ
এসব তথ্য আনুষ্ঠানিকভাবে এখনও জানানো হচ্ছে না, পুরো খনন কাজ শেষে চূড়ান্ত ফলাফলে আসবে। অবশ্য এরই মধ্যে খবর পেয়ে এখানে আসতে শুরু করেছেন পর্যটকরা।

খলিফাতাবাদের অস্তিত্ব হারিয়ে যাওয়ার বিষয়ে প্রত্নতত্ত্ববিদরা মনে করেন, প্রত্নস্থলে শঙ্খসহ এমন কিছু জিনিস পাওয়া গেছে, যাতে মনে হচ্ছে বড় কোনো জলোচ্ছ্বাসের ফলে খলিফাতাবাদ পুরো ধ্বংসের কবলে পড়ে যায়। খান জাহান নিঃসন্তান ছিলেন বলে পরে তার বসত-ভিটের খোঁজও কেউ রাখেনি।

এসব বিষয়ে আলাপ করলে বাগেরহাট যাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌস বলেন,“পুরো স্থানটায় খনন কাজ সেরে এই প্রত্নতত্ত্বস্থলের বিষয়ে সিদ্ধান্ত নেওয়া হবে। যেভাবে খনন কাজ চলছে, তাতে ২০ বছর পর্যন্ত লেগে যেতে পারে পুরো কাজ শেষ করতে। ”

“পর্যটন শিল্পের প্রসারে প্রত্নতত্ত্বকে জাগতে হয়। বাগেরহাটের প্রত্নতত্ত্ব সেই কাজটিই করছে। খান জাহানের বসতভিটের খনন কাজ শেষ হয়ে গেলে এটিও হয়ে উঠবে পর্যটকদের অন্যতম শ্রেষ্ঠ গন্তব্য। ” বলেন ফেরদৌস।
সহযোগিতায়
আরও পড়ুন

** শতভাগ বৃক্ষশোভিত বেতাগার সবুজছায়
** রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন
 

বাংলাদেশ সময়: ০৮২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০,২০১৬
এইচএ/এএ/এটি

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।