বাগেরহাট ঘুরে: সড়কটির দৈর্ঘ্যের আলোচনা পরে আসুক। প্রস্থ ৪.৮৭ মিটার।
আপাতদৃষ্টিতে এই সড়ক প্রায় এক কিলোমিটার। বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদের অদূরে ষাট গম্বুজ ইউনিয়নের মগরা গ্রামে হযরত খান জাহানের (র.) বসতভিটার সামনে থেকে সুন্দরঘোনা গ্রামের কাঁঠালতলা পর্যন্ত এ সড়ক।
ঐতিহাসিক ষাট গম্বুজ মসজিদ থেকে প্রায় সাড়ে ৩শ মিটার এবং খুলনা-বাগেরহাট মহাসড়ক থেকে ৫শ মিটার উত্তরে অবস্থিত এ সড়কের অস্তিত্ব সম্পর্কে বছর ছয়-সাতেক আগেও একেবারে অন্ধকারে ছিলেন স্থানীয় বাসিন্দা এমনকি অনেক বিশেষজ্ঞও। কিন্তু ২০১১ সালের আগে এই রাস্তাটি ‘আবিষ্কার’ করে বছর পাঁচ-ছয় গবেষণা ও খননের পর এখন প্রত্নত্ত্ববিদরা বলছেন, আসলে কেবল মগরা গ্রাম থেকে কাঁঠালতলা পর্যন্ত নয়, এই সড়কটি ছিল বাগেরহাটের এই অঞ্চল থেকে বরিশাল-চাঁদপুর হয়ে একেবারে চট্টগ্রাম পর্যন্ত।
প্রত্নতত্ত্ববিদদের মতে, অনন্য নির্মাণশৈলীতে এতো প্রশস্ত এ সড়কটি বানিয়েছিলেন বাগেরহাটে তৎকালীন ‘খলিফাতাবাদ’ নগর রাজ্যের প্রতিষ্ঠাতা খান-উল-আযম উলুঘ খান-ই-জাহান (খান জাহান)। এজন্য সড়কটিকে এখন পরিচিত করানো হচ্ছে ‘খান জাহানের প্রাচীন রাস্তা’ হিসেবে।
চিশতিয়া তরিকার সুফিসাধক হিসেবে অন্য স্থাপত্যকর্মের মতো এ নির্মাণশৈলীর বিষয়েও কিছু লিপিবদ্ধ করে যাননি খান জাহান, লিখে যাননি এর নির্মাণকালও। তবে ধারণা করা হয়, ৬শ বছর আগে অর্থাৎ পঞ্চদশ শতকের কোনো এক সময় এটি নির্মাণ করেন খলিফাতাবাদ রাজ্যের এ প্রধান।
এই বিবেচনায় ষোড়শ শতকে বাংলার সুলতান শের শাহ সুরির নির্মিত সোনারগাঁও থেকে পাঞ্জাব পর্যন্ত সুদীর্ঘ ‘গ্র্যান্ড ট্রাংক রোড’-কে যে এতোদিন ধরে দেশের সবচেয়ে প্রাচীন সড়ক বলা হচ্ছিল, এখন তার বদলে খান জাহানের এই রাস্তাকেই সবচেয়ে প্রাচীন বিবেচনা করছেন প্রত্নতত্ত্ববিদরা।
প্রাচীন এ রাস্তা খুঁজে বের করা প্রত্নতাত্ত্বিকদের মতে, খান জাহানের প্রতিষ্ঠিত মধ্যযুগের শহর খলিফাতাবাদের নাগরিক সুবিধা ও নগরের শোভা বাড়ানোর লক্ষ্যে রাস্তাটি নির্মিত হয়। স্থাপত্যকলার মতো সড়ক নির্মাণেও খান জাহানের অত্যন্ত দক্ষতা ও নির্মাণশৈলীর প্রকাশ পেয়েছে।
তারা ধারণা করেন, জমজমাট বন্দর নগরী চট্টগ্রামের সঙ্গে যোগাযোগের পাশাপাশি এ সড়ক নির্মাণের অন্যতম কারণ ছিলো, ভৈরব নদের আগ্রাসী থাবা থেকে খলিফাতাবাদ নগরকে রক্ষা করা।
আলোচনায় আসার আগে মগরা থেকে সুন্দরঘোনার কাঁঠালতলা পর্যন্ত সড়কটি কাঁচা বলেই সবার জানা ছিলো। কিন্তু ২০১১ সালের আগে এ সড়ক থেকে ভাঙা ইটখণ্ড বেরোতে থাকে। তখন স্থানীয়দের মাধ্যমে খবর পেয়ে এখানে সমীক্ষা চালায় প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতর। এরপর ২০১১ সালে দেশের একমাত্র প্রাচীন সড়ক নিদর্শনটিকে সরকার সংরক্ষিত পুরাকীর্তি ঘোষণা করে।
তারপর ২০১৫ সাল থেকে শুরু হয় খনন কাজ। প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের তৎকালীন মহাপরিচালক ড. মো. শফিকুল আলমের নেতৃত্বে খনন করে দেখা যায়, এ সড়কের স্থাপত্য কাঠামোর মধ্যে প্রাচীন কালভার্ট, নিরাপত্তা চৌকি, প্রবেশ দ্বারসহ বেশকিছু গুরুত্বপূর্ণ প্রত্নবস্তু ও কৌতুহলোদ্দীপক ধ্বংসাবশেষ রয়েছে।
এগুলোকে সংস্কারের জন্য ১৫ মাস ইন্টারন্যাশনাল কনজারভেশন স্পেশালিস্ট হিসেবে কর্মরত ছিলেন শ্রীলঙ্কার প্রখ্যাত কনজারভেশন আর্কিটেক্ট ড. নিলান কুরে। সঙ্গে কাজ করেন তার স্বদেশী আরও ছয় দক্ষ কর্মী। তারা সংস্কারের সময় ঠিক ষোড়শ শতকের গড়নই রাখতে সর্বোচ্চ চেষ্টা করেছেন। ব্যবহার করেছেন সমান আকার-রঙের ইট, রেখেছেন ঘোড়ার গাড়ি চলার ফলে কোথাও তৈরি হয়ে যাওয়া উঁচু-নিচু গড়ন।
তাদের প্রয়াসে মগরায় খান জাহানের বসতভিটা থেকে কাঁঠালতলা পর্যন্ত প্রাচীন সড়কটি এখন সবাই দেখতে পারছে। যদিও স্থানীয়রা মনে করেন, আরও কয়েকটি এলাকায় এই রাস্তার অস্তিত্ব রয়েছে। যেমন, মগরা থেকে কাঁঠালতলা পর্যন্ত বর্তমানে দৃশ্যমান প্রাচীন রাস্তাটি। এই রাস্তা থেকে সোজা গেলে রণবিজয়পুর হয়ে বাগেরহাট শহর, আর হাতের ডান দিকে খান জাহানের দরগাহ মোড়। রণবিজয়পুর পর্যন্ত বর্তমানে যে পিচের রাস্তা রয়েছে, এর নিচে টিকে রয়েছে খান জাহানের রাস্তা। এরপক্ষে প্রমাণ হলো, এ রাস্তার দু’পাশেও এখন প্রাচীন ইট বেরিয়ে আসে।
এই রাস্তা নিয়ে কথা হয় পুরাকীর্তি গবেষক ও প্রত্নতত্ত্ব অধিদফতরের বাগেরহাট যাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌসের সঙ্গে।
তিনি বাংলানিউজকে বলেন, ইউনেস্কোর সাংস্কৃতিক বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত ‘ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাট’র অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ স্থাপনা এ প্রাচীন রাস্তা। এটি সম্ভবত বিশ্বেরও সবচেয়ে প্রাচীন সড়কগুলোর শীর্ষে। আপাতত মগরা-কাঁঠালতলা পর্যন্ত সড়কটির অস্তিত্ব দৃশ্যমান হলেও এটি সম্পর্কে তথ্য পাওয়া যায় ‘বেঙ্গল ডিস্ট্রিক্ট গেজেটিয়ার, যশোর’ গ্রন্থে।
সেখানে যশোরের কেশবপুরের বিদ্যানন্দকাঠী, যশোরের বারবাজার ও বাগেরহাটের খলিফাতাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত খাঞ্জালীর (খানজাহান + আলী) রাস্তার উল্লেখ রয়েছে। খলিফাতাবাদ থেকে চট্টগ্রাম পর্যন্ত এ রাস্তার অবস্থান নিয়ে ইতিহাসবিদ সতীশ চন্দ্র মিত্র বলেছিলেন, ‘এই রাস্তাটি ষাটগম্বুজ থেকে পূর্ব দিকে বাগেরহাট শহর অতিক্রম করে কাড়াপাড়া, বাসাবাটি গ্রামের মধ্য দিয়ে ভৈরবকূল অতিক্রম করে বলেশ্বরের অন্তবর্তী প্রদেশ পার হয়ে বৈটপুর, কচুয়া, চিংড়াখালী গ্রামের মধ্য দিয়ে অগ্রসর হয়ে হোগলা বুনিয়ার নিকট বলেশ্বর পার হয়ে বরিশাল জেলায় প্রবেশ করে’।
গোলাম ফেরদৌস তাদের গবেষণা-সমীক্ষার বরাত দিয়ে জানান, ষোড়শ শতাব্দীর পর বরিশাল থেকে চাঁদপুর পর্যন্ত এ রাস্তার অস্তিত্বের কথা আর জানা যায়নি। ধারণা করা হয়, শক্তিশালী ভূমিকম্পের ফলে প্রমত্তা কীর্তিনাশা পদ্মার গতিপথ পরিবর্তিত হয়ে নদীতে বিলীন হয়ে যাওয়া অনেক নগর-জনপদের মতো এ রাস্তাও বিলীন হয়ে যায়।
আপাতত এ সড়কের দু’পাশে পাতাবাহারসহ বেশ কিছু গাছ লাগানো হয়েছে। কিছু কিছু জায়গায় কাঁটাতারের দেখাও মিলছে। এ নিয়ে আরও বিস্তর কাজ চলছে এবং পুরোপুরি ফলাফল বেরোলে দেশের প্রত্নতত্ত্ব বিভাগের জন্য বড় অর্জন হবে বলে মনে করেন ফেরদৌস।
আরও পড়ুন
** ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর!
** শতভাগ বৃক্ষশোভিত বেতাগার সবুজছায়
** রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন
বাংলাদেশ সময়: ০৯১০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এইচএ/এএ/এসএনএস