ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন সারাদেশে

মানসুরা চামেলী, স্টাফ করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন সারাদেশে বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন যাচ্ছে সারাদেশে। ছবি: আবু বকর

পৌষের সকালে মিষ্টি রোদের ওম নিতে নিতে যাত্রা শুরু। সবুজ গাছ-পালা, মাছের ঘেরে ঘেরা বাগেরহাটের তালেশ্বর গ্রাম।

বাগেরহাট থেকে: পৌষের সকালে মিষ্টি রোদের ওম নিতে নিতে যাত্রা শুরু। সবুজ গাছ-পালা, মাছের ঘেরে ঘেরা বাগেরহাটের তালেশ্বর গ্রাম।

গ্রামের মাঠ ভরা পাকা ধান। হয়তো কিছু দিনের মধ্যেই এই ধানে গোলা ভরবে চাষির।

মৃতপ্রায় তালেশ্বর-ভাষা নদী তীরে অবস্থিত প্রায় দু’শো বছরের পুরোনো মৃৎশিল্পীদের আবাসস্থল পালপাড়া। বাজার থেকে ইটের সুরকি বিছানো, এবড়ো-থেবড়ো পথে পালপাড়ায় প্রবেশ।

তালেশ্বর বাজার পার হলে পরপর কয়েকটি বাড়ি উঠানে মাটির তৈরি নানা ধরনের তৈজসপত্র। যা জানান দিলো আশ-পাশে পালপাড়ার অস্তিত্বকে। আধা কিলোমিটার পার হতেই মিললো পালপাড়ার দেখা। এখানে ২৫ থেকে ৩০ ঘর কুমোর পরিবারের বাস। কুমোরদের থাকার ঘরগুলোতে ঐতিহ্যের নিদর্শন। দেখে বোঝা যায়, এক সময় সচ্ছল জীবন-যাপন ছিলো তাদের। বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন যাচ্ছে সারাদেশে।  ছবি: আবু বকর

পালপাড়ায় ঢুকতেই চোখে পড়ে বাড়ির আঙিনায় সুনিপুণভাবে হাত ঘুরিয়ে পিঠা বানানোর সাঁজ (ছাঁচ) তৈরি করছেন চল্লিশোর্ধ্ব এক নারী। হাতের কারিশমা দেখিয়ে একের পর এক সাঁজ বানিয়ে ফেলছেন এই নারী। সময়টা শীতকাল, তার ওপর পৌষের কনকনে শীত। পিঠা-পুলি খাওয়ার উৎকৃষ্ট সময়। কদর এখন ভাপা, পুলি ও চিতই পিঠার। পিঠা তৈরি সাঁজ বানাতেই ব্যস্ত এই নির্মাতা বধূ।

কয়েক হাত এগোলে দেখা যায়, গরুর গাড়ির চাকার মতো একটি চাকা বসিয়ে তার ওপর আঁঠালো মাটির (এঁটেল মাটি) দলা বসিয়ে কয়েকপাক ঘুরিয়ে তৈরি করে চলছেন সাঁজ, ফুলের টব, জলকান্দাসহ বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র।

স্থানীয়দের মতে, বাগেরহাটের এই পালপাড়া দু’শো বছরের পুরোনো। একটা সময় এ অঞ্চলে কুমোরদের মাটির তৈরি হাড়ি-পাতিল, বাসন-কোসন, কলস, ঢিলা, বদনার ব্যবহার ছিলো অপরিহার্য। সময়ের ঘূর্ণিপাকে এখন আর নেই বললেই চলে। এ কারণে কুমোর বাড়ির সেই চাকা এখন আর তেমন ঘোরে না। তবে মাটির তৈরি কিছু জিনিসের কদর আজও রয়েছে।

৩০ বছর আগেও এখানে ৮০টি কুমোর পরিবার ছিলো। মৃৎশিল্পের কদর কমায় কমতে কমতে তা এসে দাঁড়িয়েছে ৩০-এ। কয়েকবছর আগেও নৌকা ও ট্রলার বোঝাই করে খুলনা, বরিশাল, ঝালকাঠি, গোপালগঞ্জসহ বিভিন্ন জেলায় পাঠানো হতো কুমোরদের তৈরি জিনিসপত্র। পরিমান কমলেও  এখনও পাঠানো হয়।
পালপাড়ায় অবস্থিত কুমোরদের তৈরি জিনিসপত্র বাইরে পাঠানোর অন্যতম মাধ্যম তালেশ্বর-ভাষা নদী। নদীটি এক সময় দক্ষিণাঞ্চলে বিভিন্ন জেলার সঙ্গে যোগাযোগের মাধ্যম ছিলো। বর্তমানে শুকিয়ে খালে পরিণত হওয়ায় বড় নৌকার চলাচল নেই। তাই ছোট নৌকা ও ট্রলারে করে মাটির জিনিসপত্র আনা-নেওয়া করা হয়।
 
গৃহস্থালীতে মাটির জিনিসের ব্যবহার কমে যাওয়ায় পালপাড়ার কুমোররা নার্সারি রোপনের বা কলম তৈরির ঢালি, জলকান্দা, ফুলের টপ, হালিমের বাটি তৈরি দিকে জোর দিয়েছেন। এখানকার কলমের ঢালি ও পিঠার তৈরির সাঁজ বেশ জনপ্রিয়। যা দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে পাঠানো হয়। এর মধ্যে কেউ কেউ নানা প্রতিমাও বানাচ্ছেন।

বংশানুক্রমে কেশবচন্দ্র পাল ২৫ বছর ধরে এ পেশায় জড়িত। বাপ-দাদার পেশাকে আঁকড়ে জীবিকা চালাচ্ছেন তিনি।

কিভাবে মাটির দলা থেকে তৈরি হয় মাটির পাত্র, তিনি জানালেন সে কাহিনী, “দু’ফুট নিচে গর্ত করে বাঁশ ও কাঠের সাহায্যে বসানো হয় চাকা। চাকার ওপর এঁটেল মাটির দলা বসিয়ে দেড় মিনিটের মত চাকা ঘুরিয়ে তৈরি হয় মাটির জিনিসপত্র। এরপর সেই পাত্র রোদে শুকিয়ে দেওয়া হয় চুল্লিতে। কাঠ ও খেঁজুরের চাটা পুড়িয়ে দিলে মাটির জিনিসগুলোতে পরিপূর্ণতা আসে। ”বাগেরহাটের পালপাড়ার বাসনকোসন যাচ্ছে সারাদেশে।  ছবি: আবু বকর

একটা সময় বাগেরহাটে কেউ বেড়াতে এলে পালপাড়ায় এসে বিভিন্ন ধরনের মাটির পাত্র কিনে নিয়ে যেতেন বলে জানান কেশবচন্দ্র পাল।

স্থানীয়রা জানান, ঐহিত্যবাহী মৃৎশিল্পকে বাঁচাতে এবং দেশ-বিদেশে এ শিল্পকে তুলে ধরতে চাইলে পালপাড়ার কুমোরদের জীবনের উন্নতির কোনো বিকল্প নেই। এজন্য তাদের আধুনিকতার সঙ্গে তাল মিলিয়ে নবতর আঙ্গিকে মাটির জিনিস বানানোর প্রশিক্ষণের প্রয়োজনীয়তা তুলে ধরেন তারা।

আরো পড়ুন...

**সপ্তদশ শতকের বিস্ময় ‘অযোধ্যা মঠ’

**‘এখানে বড়-ছোট নাই, যাই করেন দশ টাকা’!

**বিমানবন্দর রেলস্টেশনে অকেজো মাইক!

ছবি: আবু বকর

বাংলাদেশ সময়: ০৯৩২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এমসি/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।