ঢাকা: ঐতিহাসিক মসজিদের শহর বাগেরহাটের ষাট গম্বুজ মসজিদ নিয়ে গবেষণা, অনুসন্ধান, বিশ্লেষণ কম হয়নি। তারপরও প্রতিনিয়ত তৈরি হয় নতুন গল্প, মেলে নতুন সব তথ্য।
চিশতীয়া তরিকা অনুযায়ী, এর অনুসারীরা কোনো অবদানের কথা কোথাও লিখে রাখেন না। এর ব্যতিক্রম ঘটেনি খান জাহান আলীর ক্ষেত্রেও। কথিত রয়েছে, যশোর, খুলনা, বাগেরহাটে তিনি ৩৬০টি মসজিদের পাশাপাশি সমসংখ্যক দীঘি কেটেছিলেন। কিন্তু কোনো মসজিদেই তার শিলালিপি পাওয়া যায় না। বলছিলেন, বাগেরহাট জাদুঘরের কাস্টোডিয়ান মো. গোলাম ফেরদৌস।
মসজিদটির নাম আদতে কী ছিলো তা ঠিকভাবে জানা যায় না। পণ্ডিত ও গবেষকদের আবার দু’টি মত পাওয়া যায়, ষাট গম্বুজ মসজিদে আসসে গম্বুজ রয়েছে ৭০টি। ৭টি রয়েছে চৌচালা গম্বুজ, যা গম্বুজের যথাযথ সংজ্ঞার মধ্যে পড়ে না। চার কোণায় রয়েছে চারটি মিনার। যা ইসলামে বিজয়ের প্রতীক। এর মাথায় যে চারটি গম্বুজ রয়েছে একে গম্বুজ না বলে অনুগম্বুজ বলা যায়। সে হিসেবে প্রকৃত গম্বুজ ৭০টি। আর সব ধরলে ৮১টি।
গম্বুজগুলোর মাঝ বরাবর সাতটি বাংলার স্থাপত্য ধারণার চৌচালা গম্বুজ রয়েছে। অনেকের ধারণা, এই সাত চৌচালা গম্বুজ বা সাত গম্বুজ বিবর্তিত হয়ে ক্রমে ষাট গম্বুজ হয়ে গেছে।
আরও একটি মতে পাওয়া যায়, মসজিদটি যে ষাটটি পাথরের স্তম্ভের উপর দাঁড়িয়ে রয়েছে, ফারসি ভাষায় তাকে বলা হয় খামবাজ। আর এ খামবাজ শব্দটি বিবর্তিত বা রূপান্তরিত হয়ে নাম ধারণ করেছে গম্বুজ। অর্থাৎ ৬০টি খাম্বার উপর দাঁড়িয়ে থাকা মসজিদটির নাম ষাট খামবাজ থেকে ষাট গম্বুজ।
তবে সবকিছু ছাপিয়ে মজার বিষয়, এ মসজিদের কোনো ছাদ নেই। অবাক হওয়ার কিছু নেই। ছাদ নেই মানে, আমরা সাধারণত প্রচলিত সমান যে ছাদ দেখি তা কিন্তু এখানে অনুপস্থিত। অর্ধডিম্বাকার ও আয়তাকার গম্বুজগুলোই এর ছাদ। বলা যায়, গম্বুজ আচ্ছাদিত ছাদ।
প্রায় ৬শ বছর বয়সী এ মসজিদের নামকরণ সম্পর্কে কারও কারও ধারণা, গম্বুজ ছাড়া আলাদা কোনো ছাদ নেই বলে একে ‘ছাদ গম্বুজ’ মসজিদ বলা হতো। একসময় ছাদ গম্বুজ রূপান্তরিত হয়ে ষাট গম্বুজ হয়েছে।
বাগেরহাট শহর থেকে সাত কিলোমিটার দূরের এ মসজিদে ৩০ বছর ধরে খাদেমের দায়িত্ব পালন করা মো. এসএম ফজলুল হক জানান, সাত সারির ২১টি কাতারে একসঙ্গে প্রায় তিন হাজার মুসল্লি নামাজ পড়তে পারেন। নারীদের জন্য রয়েছে আলাদা সংরক্ষিত জায়গা।
বিশাল এ মসজিদে আলো-বাতাসের কোনো অভাব হয় না। উত্তর ও দক্ষিণ পাশে রয়েছে ৬টি করে ছোট ও একটি করে বড় খিলান। পূর্বপাশে একটি বড় ও তার দু’পাশে ৫টি করে ছোট খিলান। দৈর্ঘ্যে ১৬৮ ফুট ও প্রস্থে ১০৮ ফুটের এ মসজিদের দেয়ালগুলো আট ফুট করে চওড়া।
এ স্থাপত্যকলায় তুঘলকি স্থাপত্যের বিশেষ মিল রয়েছে বলে ধারণা বিশেষজ্ঞদের। মূলত চুন, সুরকি, কালো পাথর ও ছোট ইটের তৈরি এ মসজিদটির মেহরাব ১০টি। এর মধ্যে মূল মেহরাবটি পাথরের। বাকি ৯টিতে টেরাকোটার কাজ লক্ষ্য করা যায়, যা মধ্যযুগে পালদের মধ্যে ছিলো। ইন্টেরিয়রে বৌদ্ধ স্থাপত্যশিল্পের ছোঁয়া রয়েছে। মেহরাবের নকশায় দেখা যায় গোলাপ, পদ্ম পাপড়ির টেরাকোটা নকশা। আর চৌচালা ভল্ট রীতি বাংলার চৌচালা কুঁড়েঘরের। টার্কিশ স্থাপত্যের মিশ্রণ রয়েছে তাতে।
এখনও অনেকের কাছে বিস্ময় এ ষাটগম্বুজ সম্পর্কে। সিরাজগঞ্জ থেকে ঘুরতে আসা ইতিহাসের শিক্ষক আসাদুল্লাহ আল আমীন বলেন, ইতিহাস পড়ে এখানে এসেছি। কিন্তু এসে ধারণা আরও বদলেছে। এতোদিন যা পড়েছি তা দেখে আরও ভালো লেগেছে। এর প্রতিটি কর্ম আধুনিকতাকে হার মানায়।
মসজিদটির মোয়াজ্জেম মো. মজিবুর রহমান জানান, মদীনার মসজিদ-ই নববীর আদলে খান জাহান আলী ষাটগম্বুজ মসজিদ নির্মাণ করেন বলে ধারণা করা হয়।
ইউনেস্কো ঘোষিত বিশ্ব ঐতিহ্যের তালিকাভুক্ত এ মসজিদটি দেখতে দেশ-বিদেশের পর্যটকরা ভিড় জমান। ডিসেম্বর থেকে মার্চ সবচেয়ে বেশি পর্যটক এখানে আসেন। গতবছর এ মসজিদ কমপ্লেক্স থেকে রেভিনিউ এসেছে প্রায় ৬০ লাখ টাকা। পর্যটক এসেছেন লাখের বেশি। দক্ষিণ এশীয় পর্যটন অবকাঠামো উন্নয়ন প্রকল্পের কাজে পুরো মসজিদ কমপ্লেক্স ও পাশের ঘোড়া দীঘি নতুন সৌন্দর্যে সেজেছে বলে জানান ফেরদৌস।
তাল, খেজুরের গাছ ঘেরা মসজিদটির সামনে দু’পাশে রয়েছে দু’টি শতবর্ষী রেইন ট্রি। জানা যায়, ১৯১৩ সালে ব্রিটিশ শাসনামলে এক বাঙালি সাইট পরিচালক কেনাট মাতব্বর গাছ দু’টি লাগান। সম্প্রতি মসজিদের চারপাশে স্পট লাইট দেওয়ায় রাতের মসজিদটি দেখাও নতুন আকর্ষণে পরিণত হয়েচে। যদিও ভিতরে ঢুকে দেখার সুযোগ নেই।
** ট্যাংরা-পারসের ছটফটানি বাগেরহাট বাজারে (ভিডিও)
**‘উলুঘ খানের’ ঘোড়া দীঘি টানছে পর্যটক (ভিডিও)
** বাগেরহাটের মিনি কুয়েত!
** পরিযায়ী পাখি যাচ্ছে পর্যটক-ব্যবসায়ীর পেটে
** সুন্দরে এতো হিংসে কেন!
বাংলাদেশ সময়: ০৯২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এএ/এইচএ/এসএনএস