বাগেরহাট থেকে: ভোলা নদী উত্তর দিক থেকে এসে ধনুকের মতো বাঁক নিয়ে সুন্দরবনের ভেতর দিয়ে বলেশ্বরে গিয়ে মিশেছে। শরণখোলায় ভোলার এই বাঁক থেকে বলেশ্বরের সঙ্গে সংযোগ স্থাপন করেছে বগি খাল।
এতে তৈরি হয়েছে বিশাল আকারের ব-দ্বীপ। যার আয়তন প্রায় ৩০ হাজার একর। ঘন অরণ্যে ঢাকা এই ব-দ্বীপে রয়েছে বিভিন্ন প্রজাতির পাখির কলকাকলি। হরহামেশাই মিলবে চিত্রা হরিণের সাক্ষাৎ। এমনকি খুব কাছ থেকে বাঘের সাক্ষাৎ পাওয়ার ঘটনা নাকি বিরল নয়, এমনটাই দাবি করেছেন সুন্দরবন বন বিভাগের শরণখোলা স্টেশনের কর্মকর্তারা।
বোটম্যান লিয়াকত হোসেন বাংলানিউজকে বলেন, তারা অনেকেই নাকি বাঘ দেখেছেন। গত সপ্তাহেও অফিসে বসেই বাঘের গর্জন শুনতে পেয়েছেন। তিনি বলেন, ঘটনাটি দুপুর দু’টার দিকে হবে। তখন পুকুর থেকে গোসল করে সবেমাত্র রুমে ফিরেছেন। আর ঠিক তখনেই বাঘের গর্জন শুনতে পান। লিয়াকত হোসেনের ধারণা স্টেশন অফিসের খুব কাছাকাছি এসেছিল বাঘটি। ঝোপ ঝাড়ের কারণে দেখতে পাননি। সুন্দরবন দেখার সাধ যাদের প্রখর কিন্তু দীর্ঘ নৌকা যাত্রাকে ভয় পান তাদের জন্য এটা মোক্ষম স্পট হিসেবে বিবেচিত হতে পারে। সুন্দরবনের অন্যান্য স্পটগুলোতে যাতায়াত করতে নৌকায় কমপক্ষে বারো থেকে চৌদ্দ ঘণ্টা (হিরণ পয়েন্ট) সময়ের প্রয়োজন। এ সময়ের সঙ্গে যুক্ত হয় জোয়ার-ভাটার হিসেব নিকেশ। যে কারণে ট্যুর কোম্পানিগুলো সাধারণত দু’দিন-একরাত প্যাকেজ নির্ধারণ করে থাকেন।
এতে একদিকে যেমন ব্যয় বেড়ে যায় অন্যদিকে বাড়তি সময়ের প্রয়োজন হয়। আবার সঙ্গে যুক্ত থাকে নৌকা ভ্রমণের ভীতি। এ কারণে সুন্দরবন দেখার সাধ থাকলেও অনেকে সাধ-সাধ্যের মধ্যে সমন্বয় করতে পারেন না। এ রকম দোটানায় যারা রয়েছেন তারা সোজা চলে যেতে পারেন শরণখোলায়।
এখানে যাওয়ার জন্য আপনাকে শুধু বগি খাল পাড়ি দিতে হবে। যা দাঁড়টানা নৌকায় পার হতে সময় লাগে মাত্র ৫ মিনিট। আর উত্তাল ঢেউ না থাকায় খেয়া পারাপার সব সময়েই নিরাপদ হিসেবে বিবেচিত হয়ে আসছে।
এখানে সড়কপথে খুব সহজেই পৌঁছে যাওয়া যায়। সবচেয়ে সহজ রুটটি হচ্ছে বাগেরহাট ঘুরে যাওয়া। ঢাকা থেকে বাসযোগে বাগেরহাট অথবা সরাসরি শরণখোলা কিংবা মোড়েলগঞ্জের বাসে চেপে বসা। শরণখোলা বাজার থেকে নৌকায় পাঁচ মিনিটে খেয়া পাড়ি দিয়ে সোজা সুন্দরবন। আর মোড়েলগঞ্জ নেমে গেলে সেখান থেকে লোকাল বাস অথবা ইজিবাইকে বিশ মিনিটের পথ শরণখোলা।
খেয়া ঘাটে এলেই আপনি রোমাঞ্চিত হতে বাধ্য। এপার থেকেই দৃষ্টিগোচর হবে ঘন কেওড়া, সুন্দরী বৃক্ষের সমারোহ। কানে এসে ধ্বনিত হবে ঘু-ঘু পাখির বিরামহীন ডাক, শালিকের কলকাকলি। টিয়ের দূরন্তপনা। দেখতে পাবেন লবণাক্ত পানির দুর্লভ প্রজাতির ভোঁদড়ের ঝাঁকের আয়েশী বিশ্রাম।
চোখে পড়বে উদবিড়ালের কসরত। সঙ্গে বানরের বাদরামীতো থাকছেই। আরও রয়েছে নাম না জানা অনেক প্রজাতির পাখির ডাক।
শরণখোলা রেঞ্জের এ কম্পার্টমেন্টের বন বিভাগের বেশ কিছু অফিস রয়েছে। মিঠাপানির পুকুর রয়েছে দু’টি রয়েছে মসজিদও। বগি খালের ঘাট থেকে একটি ইট বিছানো পায়ে হাঁটার সোজা চলে গছে দক্ষিণ দিকে বনের ভেতরে। সেই পথ ধরে হাঁটলেই সামনে সুন্দরী বৃক্ষ আপনাকে স্বাগত জানাবে।
পথটি সামনে গিয়ে বাঁক নিয়ে ভোলা নদীতে গিয়ে মিশেছে। এই পথের মুখে রয়েছে কংক্রিটের জেটি। যেখানে ভোলা-সুন্দরবন মিশে একাকার হয়ে গেছে। মুগ্ধ হওয়ার মতো এই পরিবেশে আপনাতেই হাত চলে যাবে ক্যামেরার ট্রিগারে। সেলফিতে আসক্তি থাকলেতো কথাই নেই।
এখানে এলে এই ব-দ্বীপে ঘোরাফেরার পাশাপাশি সড়ক থেকেই দেখতে পাবেন সুন্দরবনের মোহনীয় সৌন্দর্য। বাড়তি হিসেবে থাকছে কুয়াশা ঢাকা ভোরে টাটকা খেজুর রস। হোটেলেই বসে পরখ করতে পারেন খেজুর রসের পায়েস-পিঠা।
পাতে জুটবে স্বল্পমূল্যে নানান প্রজাতির দেশীয় মাছ। যার দাম শুনলে অনেকে বিশ্বাসেই করতে চাইবেন না। একবাটি টেংরা মাছ মাত্র ৫০ টাকা। যা দিয়ে দু’জন মানুষ দিব্যি চালিয়ে নেওয়া যায়।
বাগেরহাট-শরণখোলা সড়ক সম্প্রতি সংস্কার করা হয়েছে। তেল চিকচিকে এই রাস্তায় যে বাহনেই সওয়ার হন না কেন আয়েশ করে চলতে খুব অসুবিধা হবে না। সেদিক বিবেচনা করলে এখনই মোক্ষম সময় বাগেরহাট দিয়ে সুন্দরবন যাওয়ার।
** গ্রাম-সুন্দরবনের সেফগার্ড ভোলা নদী (ভিডিও)
** খেজুর রসের গন্ধে মাতাল!
** কুসংস্কারে ভরা দীঘি সম্ভাবনায় ঠাসা
** বাগেরহাট ডিসির কষ্ট ও বাস্তবতা
** চিত্রায় প্লেনের ছোঁয়া
বাংলাদেশ সময়: ১০৪৫ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এসআই/জেডএস