হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র, চাঁদপাই রেঞ্জ, সুন্দরবন থেকে: শুরুতেই টহল ফাঁড়ির ভারপ্রাপ্ত কর্মকর্তা কামরুল হাসান বললেন, ‘ভেতরে যান- বাঘের দেখা মিলুক বা না মিলুক পায়ের ছাপ দেখতে পাবেন। আজ সকালেও দেখেছি’।
রীতিটা এমন, শিকারি না হলেও বনে প্রবেশ করা মাত্র যে-কারও শিকারের নেশায় পেয়ে বসে! নেশাটা দ্বিপাক্ষিক হওয়া সমীচিন, তাই হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রের কাঠের ওয়াকওয়েতে উঠতেই একটি সাইনবোর্ড চোখে পড়বে- তাতে লেখা রয়েছে ‘বাঘ হতে সাবধান, সতর্কভাবে চলাফেরা করুন। একাকী না ঘুরে দলবদ্ধভাবে ভ্রমণ করুন’। ট্যুরিজম কেন্দ্রের ঠিক মাঝখানে রয়েছে একটি পদ্মরঙা শাপলা ভর্তি পুকুর, তার চারপাশ দিয়ে চার ফুট উঁচু ওয়াকওয়ে। যেখান থেকে বনের ভেতরে যাওয়া শুরু হবে- সেখানে এসেই শেষ হয়েছে ওয়াকওয়ের আরেক মাথা।
মূলত বন কর্মচারী, জনসাধারণ ও বন্য প্রাণীদের জন্য বীর শ্রেষ্ঠ সিপাহী মোস্তফা কামাল স্মরণে পানীয় জলের পুকুরটি খননের উদ্যোগ নিয়েছিলেন পরিকল্পনা কমিশনের তৎকালীন সচিব ড. শাহ্ মুহাম্মদ ফরিদ। বন বিভাগের অপারেশনাল দক্ষতা বৃদ্ধির প্রকল্পের আওতায় ১৯৯৭-৯৮ অর্থবছরে পুকুরটি খনন করা হয়।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সকাল সাড়ে ১০টায় গাঙচিল পৌঁছালো সুন্দরবনের চাঁদপাই রেঞ্জ হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে। জেটিতে দাঁড়াতেই অভ্যর্থনা জানালো একদল বাঁদর।
শ্যালা নদীতে প্রবেশ করার পরে জাহাজ (মাদার ভেসেল-এম.ভি.), লাইটারেজ জাহাজ, লঞ্চ, ইঞ্জিনচালিত নৌকার শব্দ ছাড়া আর কিছুই শোনা যায় না। বনের ভেতরে নদী-শাখা নদীর কূল সংলগ্ন অংশ এর সঙ্গে কিছু পাখির ডাক কানে আসে। গেট দিয়ে প্রবেশ করার পরে নাক বরাবর ওয়াকওয়ে ধরে হাঁটতে শুরু করলেই শোনা যাবে নানা জীব-জন্তুর ডাক। সুন্দরী গাছের শাখায় বন-বাঁদরের দেখা হরহামেশাই মেলে এখানে। তবে বাঘের ভয়ে নয়, বন্যপ্রাণী দেখতেও সতর্ক হয়ে চলতে হয়! প্রায় ১০০০ বর্গ হেক্টর জমিজুড়ে রয়েছে ছোট ছোট গর্ত, পর্যটকদের পায়ের শব্দ পাওয়া মাত্র লুকিয়ে পরে ছোট ছোট লাল কাঁকড়া। আরেক প্রজাতি সন্ন্যাসী-কাঁকড়াও চোখে পড়লো- কাদারঙা হওয়া মনোযোগী না হলে ধরা যাবে না। প্রচ্ছেদনের কারণে বনের অধিকাংশ মাটিই ভেজা থাকে সব সময়, কোথাও কোথাও জমে থাকে পানি। ফলে বন্যপ্রাণী হেঁটে গেলে পায়ের ছাপ থেকে যায়।
গজ খানেক এগুতেই চোখে পড়লো ‘জলের টিকটিকি’। উভচর এই প্রাণী কখনও মাটিতে- কখনও পানিতে ছোটাছুটি করছে।
আমাদের চোখ তখনও বাঘের পায়ের ছাপ খুঁজতে ব্যস্ত।
এক পাল নয়, বোঝা যাচ্ছে খুব সকালে অল্প কিছু হরিণ খাবারের খোঁজে ঘুরে গেছে এ পথে। বাঁদর আর হরিণের ভীষণ মিতালী, দু’টি কারণে এদের ভাব হয়ে থাকে। উঁচু শাখায় বসা বাঁদরের হাত ফোসকে পড়ে যাওয়া কচি ডাল, নরম পাতা, বিভিন্ন ফল বিনা পরিশ্রমে কুড়িয়ে খায় এরা। অন্যদেক বাঘ এলে দলের নিরাপত্তার সংকেত দিতে হাঁক ছাড়ে বাঁদর, এতে রক্ষা পায় হরিণও। যদিও বাঘের উপস্থিতি টের পেতে ঢেড় ঢেড় পাকা শিকারিরা নির্ভর করে কাঁকড় হরিণের ওপর! বাঘ কাছাকাছি এলে এরাই প্রথম টের পায় এবং সংকেত দেয়। সুন্দরবনের বাঘদের যাতায়াতের নিজস্ব পথ রয়েছে। এরা যে পথে যায়, আবার সেই পথেই ফিরে আসে। মূলত শিকারের উদ্দেশ্যেই এরা বন থেকে বনান্তরে ঘুরে বেড়ায়। বাঁদর এবং হরিণ বাঘের প্রিয় খাবার।
সব বাঘ মানুষখেঁকো (ম্যান ইটার) হয় না। বুড়ো হয়ে গেলে, আহত হলে এরা বন্যপ্রাণী শিকার ছেড়ে সহজ শিকার মানুষ ধরতে শুরু করে। আবার মানুষের রক্তে হিমগ্লবিনের মাত্রা বেশি হওয়া স্বাদ তুলনামূলক বেশি লবণাক্ত, ফলে একবার কোনো বাঘ মানুষের স্বাদ পেলে ম্যান ইটার হয়ে যায়।
হাফ কিলোমিটার পরে পাকা করা হয়েছে ওয়াকওয়ের রেলিং। কেবল পাটাতন কাঠের। এখান থেকে পথটা ডান দিকে ঘুরে গেছে। বনের অন্য অংশকে আলাদা করেছে সরু খাল। পর্যটকদের গভীর বনের আমেজ দিতে মাঝে তৈরি করা হয়েছে বসার জায়গা। তবে বনরক্ষীকে চোখ-কান খোলা রাখতে হয়। আরও কিছু পথ যাওয়ার পরে ওয়াকওয়েটা ফের ডান দিকে মোড় নিয়েছে। সেখানেই পাওয়া গেলো বাঘের পায়ের ছাপ। একটি নয়, দু’দুটি। পাশাপাশি দু’টি পায়ের ছাপ বলে দিচ্ছে, মা বাঘ তার সন্তানকে নিয়ে শিকারে বের হয়েছিলো। এ পথের শেষে রয়েছে ওয়াচ টাওয়ার। কাঠের হওয়ায়, একসঙ্গে ছয়জনের বেশি ওঠা যায় না। বনের গাছগুলো টাওয়ারের চেয়ে বড় হওয়ায় এখান থেকে পুরো অংশটা দেখা যায় না, তবু মন্দের ভালো!
এরপর ফেরার পালা। এ অংশে আবারও দেখা গেলো বাঘার পায়ের ছাপ। ওয়াচ টাওয়ারকে একটি বিন্দু ধরলে বাঘ যেভাবে হেঁটে গেছে তাতে ত্রিভূজ আকৃতি তৈরি হয়।
ফরেস্টার এবং নয়জন বনরক্ষী ছাড়া হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্রে পর্যটক থাকার ব্যবস্থা না থাকায় বাঘ ফেরার অপেক্ষা করা গেলো না। পর্যটকদের আগ্রহ থাকলেও নিরাপত্তার কথা ভেবে তাদের রাখা হয় না। এক সরকারি প্রতিবেদন থেকে জানা যায়, ১৯০৫-০৬ সালে কমপক্ষে ১০১ জন এবং পরের বছর ১৯০৬-০৭ সালে ৮৩ জন বাঘের কবলে প্রাণ হারান। সে সময় বাঘ শিকারের জন্য সরকার পশুর নদীর পূর্ব দিকে বাঘ প্রতি ৫০ টাকা, পশ্চিম দিকে ১০০ টাকা পুরস্কার ঘোষণা করে। পরবর্তীতে পুরস্কারের টাকা বাড়িয়ে ৫০০ পর্যন্ত করা হয়। তবে আদেশপত্র না নিয়ে কেউ বন্যপ্রাণী শিকার করলে ফৌজদারি আইন অনুযায়ী তার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া হতো।
১৯৭১ সালের জানুয়ারি মাসের দ্বিতীয় ও তৃতীয় সপ্তাহে ৫৫ জন কাঠুরিয়াকে মানুষখেঁকো মেরে ফেলে। তাদের সঙ্গীরা তাড়া করে দুই কাঠুরিয়ার মরদেহ উদ্ধার করে পরিবারের কাছে হস্তান্তর করতে পারে। পরবর্তীতে বাংলাদেশ অংশে সুন্দরবনে বিচ্ছিন্ন ঘটনা অনেক ঘটেছে, তবে চাঁদপাই, সরনখোলা, খুলনা রেঞ্জের চেয়ে বুড়ি গোয়ালিনী রেঞ্জে হতাহতের খবর বেশি শোনা যায়।
** মংলা পোর্টে এক রাত
** বিস্মৃতির অতলে বরিশালের উপকথা
**‘জোনাকি’ ভরা বুড়িগঙ্গা
বাংলাদেশ সময়: ১২৫৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২০, ২০১৬
এটি/