সুন্দরবন থেকে: এরইমধ্যে জোয়ার এসেছে সাগরে। পশুরের উজান বেয়ে বইছে উল্টোমুখী স্রোত।
তারওপর কিছু দূর এগিয়ে বিগড়াতে শুরু করলো লঞ্চের ইঞ্জিন। নোঙর ফেলতে বাধ্য হলো গাঙচিল। উছলে ওঠা জোয়ারের পানিতে টালমাটাল লঞ্চটা যেনো ছোটবেলায় পুকুরে ভাসানো কাগজের খেলনা। বাঁয়ের পাড়টা এখন কয়েক হাত মাত্র দূরে। এই বুঝি লাফ দিয়ে এলো রয়েল বেঙ্গল।
ইঞ্জিন ঠিক করে ফের ছুটতে শুরু করলো গাঙচিল। একটা ধাড়ি ইঁদুর কি করে যেনো ঢুকে পড়েছিলো তেলের টাংকিতে। বের করে ফেলে দেওয়া হয়েছে ডিজেলে চুবে মরা ইঁদুরটাকে। লঞ্চটা এবার বাম তীর ছেড়ে ডান তীর ঘেঁষে ছুটতে শুরু করলো।
কিন্তু কি মুশকিল রে বাপ। সূর্যটা তো এবার ডানে তীরের গরান আর গেউয়া বনের ওপর ঝুলে রয়েছে। পূর্বের আকাশ থেকে সরে এসে ঢলতে শুরু করেছে পশ্চিমের আকাশে। সঙ্গে সুন্দরী বনের নিচের অন্ধকারটাও এনে যেনো বসিয়ে দিয়েছে গেওয়া-গরানের গোড়ায়।
এরইমধ্যে ফের ভাটার টান শুরু হওয়ায় আগের গতি ফিরে পেলো লঞ্চটা। তীরের গেওয়া আর গরান গাছের সারি এবার দ্রুত পেছনে ছুটতে শুরু করেছে। নিউজপ্রিন্টের কাঁচামাল গরান ঝোপগুলোর গোড়া থেকে সরে যেতে শুরু করেছে জোয়ারের পানি। কর্কট ক্রান্তির দক্ষিণে বঙ্গোপসাগরের উত্তর সীমান পর্যন্ত বিস্তৃত হওয়ায় এ বনটাকে উষ্ণমণ্ডলীয় আদ্র বনভূমির ভাগে ফেলেছেন বিশেষজ্ঞরা।
বনের ফাঁকে ফাঁকে কখনো দর্শন দিলো হরিণ, কখনো বুনো শুয়োর। পাড় ছুঁয়ে কখনো পিঠ তুললো ইরাবতী ডলফিন। কখনোবা মাঝ নদীতে শুশুককে দেখা গেলো পানি থেকে মুখ তুলে শ্বাস নিতে।
বিকেল নাগাদ ডলফিনের পিঠে গাঙচিলকে ঠোকর মারতে দেখা গেলো শিবসা নদীর মোহনায়। খুলনার দাকোপে কপোতাক্ষ থেকে বেরিয়ে শত কিলোমিটার পথ পাড়ি দিয়ে শিবসা এশে পশুরে মিশেছে এখানটায়। এই শিবসা আর পশুর বেয়েই তো মিষ্টি পানি নামে নোনা সাগরের বুকে।
গভীরতা বেশী হওয়ায় এক সময় গভীর সমুদ্র বন্দরের জন্যও বিবেচনায় আনা হয়েছিলো জায়গাটাকে্। এখন এ চ্যানেলটায় পাতা বয়াগুলোর একেবারেই বেহাল দশা। বাল্ব, ব্যাটারি, চাতকি আর সোলার প্যানেল হারিয়ে কোটি টাকা মূল্যের প্রতিটি বয়া যেনো পানির ওপরে ধুঁকছে।
তিনকোণা দ্বীপের কাছাকাছি আসতেই পশ্চিম আকাশে নিস্তেজ হয়ে পড়লো সূর্যটা। ঘোলা পানির আর লেশমাত্রও নেই এদিকটায়। এরইমধ্যে সবুজাভ নীল রঙ নিয়েছে সাগরের পানি। স্রোতহীন সাগরে লঞ্চে এখন আর দুলুনিও নেই। যেনো বদ্ধ বিলের বিস্তরঙ্গ জল বেয়ে ছুটছে লঞ্চ। খানিক সময় লাল চাঁদ হয়ে হিরণ পয়েন্টের আকাশে ঝুলে থাকলো সূর্যটা। তারপর ডুবে গেলো টুপ করে।
সূর্যটাকে আর দেখা না গেলেও তার আভার প্রতিফলন অন্যরকম এক আবহ তৈরি করলো পশুরের মোহনায়। সাগরটা এবার সূর্য থেকে কয়েক ধরনের রঙ মেখেছে যেনো। কোথাও সুবজ নীল, কোথাটও বা মরীচিকার মতো চিকচিকে সাগরের পানি। একটু পর এ রূপটাও আর রইলো না।
এরই মধ্যে সাগরের বুক বেয়ে দুবলার চরকে বাঁয়ে রেখে এগুতে শুরু করেছে লঞ্চটা। আলোর কোলে পৌঁছুতে পৌঁছুতে অন্ধকার জেঁকে বসলো সাগরে। গাঙচিল নোঙর ফেললো আলোর কোলের কাছে।
দ্বীপের এ অংশটার নাম কানার মাথা কেনো কে জানে। এরই মধ্যে সেখানে জ্বলে উঠেছে সোলার বাতি। বঙ্গোপসাগরে ফের জোয়ার শুরু হতে ঘণ্টা দুই বাঁকি। এই রাতটা এখানেই কাটবে গাঙচিলের। সাগরের বুকে আজ যাত্রীদের ভাসমান রাত।
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল
বাংলাদেশ সময়: ১৭৪৮ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ১৭, ২০১৬
জেডএম/