দুবলার চর (সুন্দরবন) থেকে: বালুতে মুখ গুঁজে কী করছে কচ্ছপটা? ডিম দিচ্ছে কি? কিন্তু কচ্ছপ তো ডিম পাড়ে ঝরঝরে শুকনো বালুতে। এই জোয়ারধোয়া ভেজা বালুতে তো তার ডিম পাড়ার কথা নয়! তাহলে? এখানে কী করছে ওটা? এতো মানুষের কোলাহলে কই নড়ছে না তো!
খোলের রঙটাও তো বেশ জ্বলে গেছে মনে হচ্ছে।
আর একটু ভালো করে দেখতে পেছন থেকে সামনে আসতেই বিস্ময়ে বিমুঢ় হওয়ার জোগাড়! বালির উপর সটান পড়ে থাকা লম্বা গলাটা নিথর। মুখের বাঁ পাশ বেয়ে গড়িয়ে নামা রক্ত শুকিয়ে রয়েছে। বেঁচে নেই কচ্ছপটা। বয়সী ধড়টা কেবল পড়ে রয়েছে রাতের বেলাভূমিতে। অন্ধকারে হাঁটতে হাঁটতে হঠাৎ নিচে টর্চের আলো ফেলাতেই এমন মর্মান্তিকতার মুখোমুখি। মৃত কচ্ছপের অতৃপ্ত আত্মাই কি তবে দেখিয়ে দিলো তার অসহায়ত্ব!
মনের ভেতর নানামুখী প্রশ্নের জন্ম দেওয়ার জন্য এই একটা কচ্ছপই যদিও যথেষ্ট ছিলো। কিন্তু সামনে যে সৈকতজুড়ে বিস্ময়ের পর বিস্ময় পড়ে নীরবে হাহাকার ছড়াচ্ছে তা বুঝে উঠতে সময় লাগলো না। মৃত কচ্ছপটিকে পেছনে ফেলে একটু এগুতেই আর একটা কচ্ছপ। তারপর আরও একটা। মাত্র কয়েক মিনিট হেঁটেই এরকম দশ দশটা কচ্ছপ মরে পড়ে থাকতে দেখা গেলো দুবলার চরের দক্ষিণ-পশ্চিমমুখী সৈকতে। ফাঁকে ফাঁকে দলা পাকানো নাম না জানা সামুদ্রিক সাপের ধড়।
চরের কানার মাথা থেকে হাঁটা শুরু করার সময়েও কিন্তু রহস্যময় এই কচ্ছপ আর সাপ ট্র্যাজেডির বিন্দুমাত্র আভাস দেয়নি কেউ। ট্যুরিস্ট দলগুলো গাইডের পেছন পেছন হরদম ছুটলেও নিচের দিকে নজর নেই কারোরই। পাঁচ মাসের জন্য দ্বীপে বসতি গাঁড়া মৌসুমী জেলেদেরও খুব একটা খেয়াল নেই এদিকে। কচ্ছপগুলো তাই দিনের পর দিন রোদে শুকিয়ে সৈকতের বালুতে মিশে যেতে বসেছে। কোনো কোনোটার শরীরের নিচের অংশ কয়েক ইঞ্চি সেঁধিয়ে গেছে বালুতে। কোনোটাকে কেবল গ্রাস করতে শুরু করেছে সাগরের জোয়ারে মিশে ভেসে আসা সাদা আর কালো বালু। তবে প্রথমে দেখা মরা কচ্ছপ এখনও বালিতে গাঁথতে শুরু করেনি। রক্তের লাল দাগ এখনও নেয়নি কালো বর্ণ।
তবে সব ক’টি কচ্ছপের অবস্থানই একই সরলরেখায়। সাগরের সঙ্গে সমান্তরালে এগিয়ে যেনো রূপ নিয়েছে শব মিছিলে। হয়তো গভীর সাগরে জেলেদের পাতা জালে বাঁধা পড়ে জীবন গেছে সেগুলোর। তারপর সাগর সেগুলোকে ভাসিয়ে ঠেলে দিয়েছে তীরের দিকে। ওরা ঠিক তীরের বাসিন্দা নয়, তবু ওদের তীরেই পাঠিয়ে দিয়েছে প্রমত্ত সাগর।
দক্ষিণ-পশ্চিমে থেকে বেশ খানিকটা দূরে এসে ফিরে যাচ্ছে সাগরের ঢেউ। ভাটার টান থাকায় সে ঢেউয়ে এখন জোর নেই ঠিকই, কিন্তু জোয়ার এলেই প্রতিটি ঢেউ এসে আছড়ে পড়বে কচ্ছপ সারির কাছাকাছি। ফের ফিরে যাবে সাগরের বুকে। সেই ঢেউয়ের ডগা কচ্ছপগুলোকে অনবরত ভিজিয়ে দেবে হয়তো। কিন্তু তীরে ঠেলে দেওয়া মরদেহগুলোকে আর আর ফিরিয়ে নেবে না সাগর। ওদের জীবন তো শেষই, সেই সঙ্গে শেষ সাগর অধ্যায়।
প্রতিদিন এভাবে গভীর সাগরে আরও কতো কচ্ছপ মারা পড়ছে কে জানে! এসব কচ্ছপ আর সাপের মৃত্যুর কারণ হিসেবে মাছ ধরার জালে আটকে পড়াকেই চিহ্নিত করলেন স্থানীয় জেলেরা।
একটা কচ্ছপকে উল্টিয়ে দেখা গেলো, পেট ফাঁড়া নেই কচ্ছপটার। তার মানে, পেট চিরে ডিম বের করার কারণে মৃত্যু হয়নি তার। তাহলে কি জেলেদের ব্যাখ্যাটাই ঠিক? মাছ ধরার জন্য গভীরে সাগরে পাতা জালই তাহলে কচ্ছপ আর সাপের মৃত্যুর কারণ!
এভাবে প্রতিদিন আর কতো প্রাণী মারা পড়ছে সাগরে? এ হিসাব কি কেউ দিতে পারবে? শুক্লপক্ষের চতুর্থ তিথির চাঁদটা বুঝি সে কষ্টেই খোয়াতে থাকা শরীর নিয়ে আকাশের গায়ে বিবর্ণ। বঙ্গোপসাগরের এই দ্বীপের উপরে ঝুলে সপ্তর্ষি মণ্ডল কি তাদের মিথিক্যাল শব যাত্রার সঙ্গে কচ্ছপের এই শব মিছিলের প্রতীকী কোনো মিল দেখিয়ে দিচ্ছে আজ! স্থির হয়ে আকাশে ঝুলে থাকা জ্বলজ্বলে ধ্রুব তারা থেকে কি অবিবেচক মানুষের উদাসীনতাকে কটাক্ষ করা বিদ্রুপ ঠিকরে বেরুচ্ছে!
সন্ধ্যা রাতের নিকষ কালো চিরে ছুটে আসা সাগরের ঢেউয়ে কী চাপা আর্তনাদের আওয়াজ? নিজের গর্ভ থেকে সন্তানতুল্য কচ্ছপগুলো হারিয়ে কতোটা বিহবল আজ পৃথিবীর বৃহত্তম এই উপসাগর!
যদিও সাগরের গুমরে মরার রেশ নেই বাঁয়ের বালুকাবেলায় গড়ে তোলা শুঁটকি পল্লী আর মাছের আড়তগুলোতে। বাতি জ্বালিয়ে সারি সারি বাঁশের বেড়ায় কাঁচা লইট্যা গাঁথতে ব্যস্ত সাগর ফেরত জেলেরা। বৃষ্টি না হলে রোদে শুকিয়ে দু’দিনেই শুটকি হয়ে যাবে এসব মাছ। তাদের চিন্তায় এখন এই শুঁটকি শুকিয়ে ভালো দামে বিক্রির স্বপ্ন। যে সাগর থেকে তারা এই মাছ পেলেন, তারই সন্তান কচ্ছপ তো এখন আর কোনো কাজে লাগছে না তাদের। বরং ওই কচ্ছপ জড়িয়ে জাল ছিঁড়ে যায় বলে খানিকটা বিরক্তও তারা। তাই জালে জড়িয়ে পেঁচিয়ে যাওয়া কচ্ছপগুলোকে তো প্রায়শ তারাই পিটিয়ে মারেন। বালুতটে দেখা প্রথম কচ্ছপটার মুখ বেয়ে গড়িয়ে পড়া রক্তে তো সেই আঘাতেরই উপহাস।
** সাগরের বুকে ভাসমান রাত
** জলে ভাসা রকেট কাহিনী
** দ্বিতীয়ার চাঁদে মেঘনার হাসি
** সুন্দরী ছুঁয়ে পশুরে ভাসে গাঙচিল
বাংলাদেশ সময়: ১১০২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
জেডএম/জিপি/এসএনএস