দুবলার চর, শরনখোলা রেঞ্জ, সুন্দরবন থেকে: জোয়ারের সময় চারদিক থেকে হঠাৎ গজরাতে গজরাতে এখানে যেমন উঠে আসে বঙ্গোপসাগরের নোনা জল, একইভাবে ঝুপ করে নেমে আসে রাত। চারপাশে তখন শুধুই ইঞ্জিনচালিত নৌকা, ট্রলার, জাহাজ চলার আর বাতাসের শো শো শব্দ।
জোয়ারের সঙ্গে সঙ্গে মাছ ধরতে নৌকা নিয়ে বেরিয়ে পরে জেলেরা, ভাটি শেষে ফের জোয়ারে ফিরে আসে ঘাটে। কিন্তু একবার আলো নিভে গেলে ভোর হওয়া পর্যন্ত দুবলার চরের শুঁটকির আড়তে কাজ করা শ্রমিকদের বৈচিত্র্যহীন জীবন। কাজের বাইরে তাদের সময় কাটে অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা বাজারে আড্ডায় বসে কিংবা মন্দির-মসজিদে।
দুবলার চরকে লোকে দুবলার ট্যাকও বলে থাকে। এ দেশের লোকে বলে ‘এই মানুষ বনে গেলে বনমানুষ হয়’! গ্রামের মানুষ যখন সুন্দরবনের নদীনালা ও জঙ্গলে অবস্থান করে তখন তারা বন্যজীবনে অভ্যস্ত হয়ে যায়। বনের গাছপালা, নদীনালা, ভূচর, খেচর ও জলচর তাদের নিত্য সহচর হয়ে দাঁড়ায়। বাঘের ভয় তারা পরোয়া করে না।
মূলত অগ্রহায়ন মাসের ১৫ তারিখে এই চরে বসতি গড়ে ওঠে। থাকে চৈত্র মাসের ২ তারিখ পর্যন্ত। ইলিশ ধরার মৌসুমে আসে অন্য দল। দুবলা দ্বীপের পূর্ব পাশে পশুর নদীর শেষ সীমানা থেকে শুরু হয়ে বঙ্গোপসাগরে পড়েছে মানিকদিয়া নদী। চট্টগ্রাম থেকে ইলিশ ধরতে আসা জেলেরা এই নদীর দু’পাশে বসতি গাঁড়ে।
আলোর কোল, কানার মাথা থেকে দুবলার সমুদ্র সৈকত ধরে পশ্চিম দিকে ঘূর্ণিঝড় আশ্রয় কেন্দ্রের দিকে হাঁটলে হাতের বাঁয়ে পড়বে নিউ মার্কেট। আরও রয়েছে শিব বাবুর মার্কেট, মেহের আলী, অফিস কেল্লা। বনবিভাগের কর পরিশোধ করে লাখ লাখ টাকা শুঁটকি মাছ দেশের বাজার এবং বিদেশে রফতানি করে এরা।
শনিবার (১৭ ডিসেম্বর) সন্ধ্যায় নিউমার্কেট এলাকায় রামপালের গাউসের হোটেলের গরম সিংগারা আর জিলাপি খেতে খেতে কানে আসে ঢাকের আওয়াজ। ফের পশ্চিমে এগিয়ে আমরা তখন বাজারের প্রায় শেষ প্রান্তে- অস্থায়ী মন্দিরের পাশে চাটাই ঘেরা দো’তলা একটি ঘর থেকে আসছে ঢাক, হারমোনিয়াম, কর্তালের আওয়াজ।
প্রকাশের কণ্ঠ তখন তার সপ্তকে চড়েছে ‘কেন বানধো দালান ঘর...’। খোলে টোকা দিচ্ছেন সঞ্জয় আর কর্তাল ধরেছেন দেবাশীষ।
সাগর উপকূলীয় মৎসজীবী সমবায় সমিতির তালিকাভুক্ত এই শ্রমিকরা পাঁচ মাস দুবলার চরে শুঁটকির আড়তে কাজ করবে। দেবাশীষ দেব এসেছেন সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলা থেকে, সঞ্জয় বিশ্বাস খুলনার পাইকগাছা আর প্রকাশ নন্দী এসেছেন ডুমুরিয়া উপজেলা থেকে।
প্রতি রাতে কাজ শেষে এখানে বসে গানের আসর। পালা করে সবাই গান গায়, যন্ত্র সংগত করে। প্রতি মঙ্গলবার নাম সংকীর্ত্তন আর ভাবগীত গেয়ে কেটে যায় সময়।
‘অবুঝ নাবিক বলে হইল সংশয়/ বুঝিলাম আজ আর প্রাণ-নাহি রয়। । কুলেতে উঠিলে বাঘে লৈয়া যে পালায়/ জলেতে পড়িলে যে কুমীরে ধরে খায়। । নিরন্তর এ পানিতে ডাকাইত ফিরে/ পাইলেক ধনপ্রাণ দুই নাশ করে। । এতেক যাবৎ না উড়িয়া দেশ পাই/ তাবৎ নীরব হও সকল গোসাই’
চৈতন্য ভাগবৎ-এ বলা আছে, শ্রীচৈতন্য একবার কয়েকজন শিষ্য সঙ্গে নিয়ে সুন্দরবনের গহীন জঙ্গলের ভেতর দিয়ে পশ্চিম দিকে উড়িষ্যা ভ্রমণ করেন। সে প্রায় পাঁচশ’ বছর আগের কথা। তার প্রিয় শিষ্য মুকুন্দ এই কীর্তন বেঁধে গাইতে শুরু করেন।
সেই আদিকাল থেকেই সুন্দরবনে রয়েছে সর্বধর্মপ্রাণ বাদ। অন্যান্য ধর্মের পাশাপাশি এখানকার মানুষ সুন্দরবনের লৌকিক দেব-দেবী বনবিবি, দক্ষিণ রায়, জঙ্গলি শাহ, পঞ্চানন্দ, আটেশ্বর, পেঁচো-খেঁচো, ষষ্ঠী, শেতলা, ওলা বিবি, মড়ি বিবি, আসান বিবি, বহেড়া বিবি, ঝোলা দেবীর পূজা দেয়।
দুবলার চরেও মিলে মিশে এক হয়ে গেছে সব ধর্মবিশ্বাস। অস্থায়ী মন্দিরের পাশেই গড়ে উঠেছে মসজিদ। ইসলাম ধর্মাবলম্বীরা এশার নামাজ শেষে যেমন কীর্তনের আসরে বসেন, একইভাবে নামাজের সময় সূচি হিসেবে করে পড়ে ঢাকে কাঠি।
প্রকাশদের আসরে লোকগীতি, লালন, ভাবগীত, নাম সংকীর্তন সব ধারার গানই হয়। একদিকে এটি যেমন বিনোদন, অন্যদিকে সুরের মধ্য দিয়ে স্রষ্টাকে স্মরণ করার চেষ্টা।
অস্থায়ীভাবে গড়ে ওঠা মন্দিরেও দেখা গেলো সর্বধর্মপ্রাণ বাদ। মন্দিরে কোনো বিগ্রহ নেই, রয়েছে ছবি। শিব, কালী, হাতি মুখো গণেশ, পাগল গণেশ এবং মুসলিম ঘরানার মারফতি পাগল ও বাউলদের ছবিতে পূজা দেন দুবলার জেলেরা।
** বাঘের পায়ের ছাপ সন্ধানে ওয়াকওয়ে ধরে দেড় কিলোমিটার
** মংলা পোর্টে এক রাত
** বিস্মৃতির অতলে বরিশালের উপকথা
**‘জোনাকি’ ভরা বুড়িগঙ্গা
বাংলাদেশ সময়: ১২৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২১, ২০১৬
এটি/জিপি