ঢাকা, রবিবার, ৭ পৌষ ১৪৩১, ২২ ডিসেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

বাঘের খোঁজে কটকার টাইগার পয়েন্ট

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৫৪০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
বাঘের খোঁজে কটকার টাইগার পয়েন্ট কটকা টাইগার পয়েন্ট / ছবি: শুভ্রনীল সাগর

একদম টু শব্দটি করা যাবে না। আওয়াজ পেয়ে বাঘমামা লুকিয়ে পড়বেন কিংবা অবস্থান বুঝে চুপিসারে এসে বসাবেন দশাসই থাবা! ঘন কেওড়ার বন। হরিণের খুরের দাগে এমন অবস্থা, যেনো কোনো মৌসুমী আবাদের বীজতলা- একটু পরই বীজ বা চারা লাগানো হবে।

কটকা (সুন্দরবন) থেকে: একদম টু শব্দটি করা যাবে না। আওয়াজ পেয়ে বাঘমামা লুকিয়ে পড়বেন কিংবা অবস্থান বুঝে চুপিসারে এসে বসাবেন দশাসই থাবা!

 

ঘন কেওড়ার বন।

হরিণের খুরের দাগে এমন অবস্থা, যেনো কোনো মৌসুমী আবাদের বীজতলা- একটু পরই বীজ বা চারা লাগানো হবে। জোয়ারের পানি কটকার দক্ষিণ সৈকত ছাপিয়ে এদিকটাও চলে আসে। ভাটা নেমে গেলেও পায়ের ছাপের গর্তের ভেতর পানি জমে থাকে।
 কাঠের ওয়াক ওয়ে পা দিলেই কোনো শব্দ ছাড়া গোড়ালি অব্দি ডুবে যায় কিন্তু তুলতে গেলেই ফচ করে ওঠে। প্যাচপেচে কাদা যাকে বলে। সঙ্গে কাদামাখা শ্বাসমূল। কাদার ভেতর এমনভাবে চুপটি করে লুকিয়ে থাকে, ঠাহর করা মুশকিল। অসাবধানে একবার পায়ে ঢুকলেই এ যাত্রা ভ্রমণ শেষ!

কটকা, মানে- কটকা বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য পড়েছে পূর্ব সুন্দরবনের শরণখোলা রেঞ্জে। সংক্ষেপে কটকা নামেই বেশি পরিচিত। কাঠবাঁধাই জেটি ধরে এগুলে রেঞ্জ অফিস। ডান দিকে ওয়াক ওয়ে। খানিকটা সিমেন্ট ইটবিছানো পথ, বাকিটা এঁকেবেঁকে বনের মধ্যে ঢুকে যাওয়া কাঠের পাটাতন। শেষ হয়েছে একেবারে কটকা দক্ষিণ সৈকতের ঠিক আগে।
হরিণের খুরের দাগ পথচলতে বানরের সঙ্গে দেখা হয়। মানুষ দেখলে ওদের হুটোপুটি বেড়ে যায়। বন্যশূকরের এসবের বালাই নেই। আপন মনে হেঁটে চলে যায়। কোনোদিকে মুখ তুলে তাকানোর সামান্য মর্জি বা রুচিটুকু যেনো তার নেই। এ বনে হরিণের বিচরণ অনেক বেশি। মানুষ দেখলে দৌড়ে পালায় না, দূর থেকে মুখ তুলে তাকিয়ে থাকে। কেউ কেওড়ার ডাল ভেঙে খেতে দিলে দলধরে খেতে আসে।

এ বনের কেওড়া গাছের সবচেয়ে নিচু ডালটিও সাড়ে পাঁচ-ছয় ফুট উচ্চতায়। এতোটা লাফিয়ে পাতা পেড়ে খাওয়া হরিণের পক্ষে বেশ কষ্টই হয়ে পড়ে। সে যাই হোক, বাঘ দেখতে হবে!
টাইগার পয়েন্টের পথে অভিজ্ঞ সহযাত্রী পরামর্শ দেন, আমরা একদম শব্দ করবো না। নিজেদের মধ্যে কথা আপতত  বন্ধ। এতে বাঘ টের পয়ে বনে লুকিয়ে পড়বে।

কিন্তু হাঁটতে গিয়ে ওয়াক ওয়ের ঢপ ঢপ শব্দ থামে না। কাঠের তক্তাগুলো অধিকাংশই খুলে গেছে। এ পথ ধরে হেঁটে যাওয়া আর সাইরেন বাজিয়ে নিস্তব্ধ বনে ঢোকা সমান।
 সুর‌্যোদয় ওয়াক ওয়ের শেষমাথা গিয়ে শরণখোলা রেঞ্জের বনরক্ষী বিদায় নেন। আঙুল তুলে দক্ষিণ পূর্ব দিক নির্দেশ করেন, ঢাইগার পয়েন্ট যেতে হলে এদিক দিয়েই যেতে হবে। জুতো পরে হাঁটতে পারবেন না, এখানে খুলে রেখে যাওয়া ভালো। তবে বানর নিয়ে যেতে পারে!

বাঘ দেখার লোভে জুতোজোড়া বিসর্জন দিতে রাজি সবাই। সূর ‌মুখ দেখিয়েছে, কিন্তু পুরোপুরি বিছানা ছাড়েনি। যেকোনো সময় কুয়াশার লেপ একটানে খুলে বলবে, উঠে গেছি! পৌষের তীব্র কুয়াশা, কেওড়া বন, জলকাদা- সব মিলিয়ে বাঘ দেখার চিত্রনাট্যে ভয়ের মাত্রা বাড়িয়ে দিয়েছে অনেকটা। শুরুতে ঠাট্টা-তামাশা চললেও, টাইগার পয়েন্ট যতো কাছে আসে ততো চোখমুখ শুকাতে থাকে। কেউ মুখে প্রকাশ করে না, বরং একটু বেশিই যেনো সাহসী দেখানোর ভাব- কিন্তু ঠেলে ঠেলে ঠিক দলের মাঝখানে চলে আসে। কেননা আগে থেকেই মাথায় ছিলো, বাঘ দলের পেছন থেকে মানুষ থাবা দিয়ে নিয়ে যায়। দলে পিছিয়ে পড়া অভাগাকে লক্ষ্য বানায়। কাজেই পিছনে পড়তেই শ্বাসমূলের সূচালো অগ্রভাগ তোয়াক্কা না করেই মাঝখানে ঢোকার নিঃশব্দ হুটোপুটি লেগে রইলো। সামনে বন বিভাগ থেকে সঙ্গে দেওয়া থ্রি নট থ্রি রাইফেলধারী বনরক্ষী অজয়। বাঘমামা এলে যে এই বন্দুক আর তার নামের কোনো পরওয়াই করবেন না, তা সবারই জানা।
হরিণের বিচরণ প্রায় এক কিলোমিটার জল, কাদা, শ্বাসমূল আর ভয়ের সঙ্গে যুদ্ধের পর টাইগার পয়েন্ট সামনে এসে হাজির হয়। একটুখানি জায়গাজুড়ে মাটির ঢিবি। বৃত্তাকার এ জায়গায় কোনো গাছ নেই, একটি মরা গাছ পড়ে রয়েছে- চতুর্দিকে ঘন ঝোপ। যেকোনো দিক থেকে ঘাড়ে লাফিয়ে পড়তে পারে বাঘ। সবাইকে বলা হলো, সবদিকে নজর রাখতে।

এখানকার বনরক্ষীদের ভাষ্য, জোয়ারে বনের নিম্নাংশ ডুবে গেলে বাঘ এই উঁচু ঢিবিতে এসে বসে। সেখান থেকে এ জায়গাটির নাম টাইগার পয়েন্ট।
টাইগার পয়েন্টের পথে
দূর থেকে বানরের ডাক ভেসে আসে। হরিণ সতর্ক করার সংকেত? খানিক বাদে ভেসে আসে কাঁকর হরিণের ডাকও। বুঝতে বাকি থাকে না, মামা রয়েছেন কাছে কোথাও।
 
টাইগার পয়েন্টে নিচু হয়ে বনের ভেতরটা যতোদূর দেখা যায় খোঁজা হলো, রয়েল বেঙ্গল টাইগার মহাশয় কোথাও হেলেদুলে চলছেন কিনা। নাহ, ব্যর্থ মনোরথে আধঘণ্টা মতো এদিক-ওদিক চেয়ে ফেরার পা মাটির হাঁড়ির ভাঙা টুকরোয় হোঁচট খায়।  
মাটির জিনিসপত্রের ভাঙা অংশ
মাটির ঢিবিজুড়ে মাটির বাসন-কোসনের ভাঙা অংশ। কিছু বের হওয়া, কিছু অর্ধেকটা ঢুকে রয়েছে মাটির ভেতর। বোঝা যায়, খুঁড়লে মিলবে আরও।

ভাবনা আসে, এই জোয়ারবিধৌত বনে এতো বেশি পরিমাণে মাটির জিনিসপত্রের ভাঙা অংশ আসবে কী করে? এমন তো নয় বাসাবাড়ির জিনিস। কারণ, ত্রিসীমানার আশেপাশে কোনো জনবসতি নেই। তাহলে কারখানা? মাটির জিনিসপত্রের হওয়ার সুযোগ কম কারণ, লোকালয় থেকে শত শত মাইল দূরে বনের মধ্যে ক্রেতা কই? হতে পারে লবণ কারখানা ছিলো। বা কোনো ব্রিটিশ বা পর্তুগিজ আউটপোস্ট। ১৮৭৫ সালে ব্রিটিশরা সুন্দরবনকে সংরক্ষিত বন হিসেবে ঘোষণা করে। হতে পারে তাদেরই কোনো কর্মযজ্ঞ ছিলো। সবই হতে পারে!
টাইগার পয়েন্টের চারদিকে ঘন বন বাঘে ফিরে আসা যাক। বাঘ দেখা দিলো না। এখনও জামতলা, কচিখালি যাওয়ার বাকি। সেখানে হয়তো দেখা হবে। সুন্দরবনের সবচেয়ে বেশি বাঘের ঘনত্ব এ অঞ্চলগুলোতেই। আপাতত একই পথ বেয়ে পা এগোয় কটকা বিচের দিকে। ও হ্যাঁ, জুতো বহাল তবিয়তেই ছিলো- বানর নেয়নি।

** সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
** সিরিয়াল-তামিল-চাইনিজ ছবির দখলে দুবলার চর
** একটু-আধটু কুমড়া-মুলায় দুবালার চর
** দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা
** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
**এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে

সহযোগিতায়

বাংলাদেশ সময়: ১১২০ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৩, ২০১৬
এসএনএস/এসআরএস

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।