সুন্দরবন (গাবুরা) ঘুরে: সুন্দরবনের সাপখালী খাল। এখানে দিনভর মাছ ধরার পর শেষ বিকেলে বাড়ি ফিরছিলেন সাইদুল ইসলাম।
চিকন ঘাম ছুটতে শুরু করলো। সাইদুলের জানা আছে, বাঘের প্রথম নজর যার দিকে পড়বে, সে তার ওপরই আক্রমণ করবে, সেখানে একশ’ লোক থাকলেও ওই বাঘ আর কারও দিকে তাকাবে না। থরথর করে কাঁপুনিও শুরু হলো। সহযোগীদের দুঃসাহসে সাইদুল অক্ষতই ফিরে আসেন সেদিন। কিন্তু যে কাঁপুনি তার শুরু হয়, তাতে জ্বর উঠে যায়, সে জ্বর তাকে ভুগিয়েছিল বেশ কিছু দিন।
সুন্দরবনের দ্বীপ ইউনিয়ন গাবুরার চাঁদনীমুখা ঘাটের পাশে আলাপ হচ্ছিল এই সাইদুলের সঙ্গে। তার বাড়ি চাঁদনীমুখা গ্রামেই। টানা জাল দিয়ে গলদা চিংড়ির পোনা ধরছিলেন তিনি। সকালে ভাটা পড়েছে খোলপেটুয়া নদীতে। প্রায় ছয় ঘণ্টা থাকার কথা এই ভাটা। সেজন্য অন্যদের মতো তিনিও নেমেছেন গলদার পোনা ধরতে।
আলাপটা মাছ ধরা নিয়েই শুরু হলো। সাইদুলের প্রধান জীবিকা এই মাছের ওপরই নির্ভর করে। এখন ধরছেন গলদার পোনা। শরীর টানলে বিকেলেই নামবেন মাছ ধরতে। আনুমানিক পঞ্চাশের সাইদুল বলছিলেন বছর বিশেক আগের কথা। তিনি তখন তাগড়া যুবক। চাঁদনীমুখা ঘাটের উল্টো দিকের সাপখালী এলাকায় সেসময় অন্য পশু-পাখির মতো বাঘও ছিল বেশ কিছু। এই বাঘের ভয় সঙ্গে নিয়েই জীবিকার জন্য মাছ ধরতে হতো তাদের।
সাইদুল বলে চলেন তার জীবনের সবচেয়ে ভয়ের দিনটির কথা, “হাঁটতে হাঁটতে সামনে দেখি বাঘটা আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। ঘাম বের হয়ে গেছিল। আর যে কয়জন ছিল, তাদের হাতে যেমন লাঠি ছিল, আমার হাতেও লাঠি ছিল, কিন্তু বাঘ আমার দিকেই তাকিয়ে আছে। সঙ্গীরা বুঝতে পেরে সামনে চলে এলো, আমাকে তাদের আড়াল করে হাঁটতে থাকলো। আমার তো পা চলে না। সে যে কাঁপানি। ”
সাইদুলের মনে হয়, “সেদিন নৌকায় উঠেই যে জোরে টান দিছি, আর এমন টান দিই নাই জীবনে। মনে হইছিল আরেকবার জীবন পাইছি। পুরা জ্বর উঠে গেছিল। ”
ওই ঘটনার পর সাপখালীতে বেশ ক’বছর যাননি সাইদুল। পরে গেলেও ধারেকাছ থেকে মাছ ধরেই ফিরে এসেছেন।
ঠিক বাঘের সামনে না পড়লেও পাশ দিয়ে বাঘের চলে যাওয়া টের পেয়েছিলেন আরেকবার। সেটাও বছর দশ-বারো আগে, ডিঙ্গিমারি এলাকায়। সেখানে মধু সংগ্রহ করতে গিয়েছিলেন। দেখেন পাশ দিয়ে একদল হরিণ ছোটাছুটি করছে। সেবার আর মধু না নিয়েই ফিরে আসেন তিনি ও তার সঙ্গীরা। সাইদুলরা মৌসুম মেনে ধরেন মাছ। এর বাইরে আহরণ করেন বাগদা, গলদা ও হরিণা চিংড়ির পোনা। চিকন শলাকার মতো প্রায় আধ ইঞ্চি লম্বা বাগদার পোনা ধরার মৌসুম ফাল্গুন-চৈত্র থেকে আষাঢ় মাস পর্যন্ত। আর গলদার পোনা ধরা যায় সারাবছর। ভাটা নামলেই টানাজাল নিয়ে নেমে পড়েন হরিণার পোনা ধরতে।
সাইদুল জানান, তারা গলদা চিংড়ির পোনা বিক্রি করেন প্রতিটি এক টাকা করে। বাগদার পোনাও বাজার দরে বিক্রি হয়। আর এ অঞ্চলের বিখ্যাত হরিণার পোনা বিক্রি হয় এক বাক্স দেড়শ’ থেকে পৌনে দুইশ’ টাকা দরে। প্রতি বাক্সে পোনা থাকে ৬-৭ হাজার।
সাইদুলের সঙ্গে কথা বলে চাঁদনীমুখা বাজারে আলাপ হলো আরও ক’জন জেলের সঙ্গে। সবারই এমন বাঘের ধারে-কাছে থেকে বেঁচে আসার অভিজ্ঞতা আছে। হরিণের ছোটাছুটি দেখে পড়িমড়ি করে ছুটে আসারও অভিজ্ঞতা আছে কয়েকজনের।
এদেরই একজন ইউনুস আলী। চাঁদনীমুখার পূর্বমুখী ঘাট থেকে চিংড়ির পোনা ধরে রাস্তার পাশের বাড়িতে ঢুকছিলেন তিনি। বয়স হয়েছে ষাটের ওপরে। তাই এখন মাছ বা পোনা ধরতে নামেন না। ১৫-২০ বছর আগেও ধরতেন। সেসময়ের অনেক অভিজ্ঞতা আছে ইউনুসের। তবে কখনো বাঘের সামনে পড়েননি। সাপখালী থেকেই একদিন মাছ ধরে ফেরার সময় বানরের কিচিকিচি শব্দে চিৎকার-চেঁচামেচি শুরু হয়। ভয় পেয়ে গিয়েছিলেন, বুঝতে পারছিলেন আশপাশে ঘোরাঘুরি করছে বাঘ। তারপর অনেকদিন সেই সাপখালীতে যাননি।
ইউনুস বলেন, “সুন্দরবনে থাকলে এরকম দু’একবার বাঘের ধারে-কাছে পড়ার অভিজ্ঞতা থাকবেই। তবে এখন ফরেস্টের বাজি ফাটানোর কারণে বাঘেরা গভীর জঙ্গলে চলে গেছে। এখন আগের মতো ভয়-ডরের কারণ নেই। ”
বাংলাদেশ সময়: ১৮০১ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ২৮, ২০১৬
এইচএ/
আরও পড়ুন
** লোনা পানির সুন্দরবনে ঘরে ঘরে ‘মেটে’
** প্রথম সুন্দরবন যাত্রায় শুশুকের অভ্যর্থনা
** ফুলতলার গামছাশিল্প বাঁচাবে কে!
**ফুলতলার দেশসেরা গামছা
**সবচেয়ে বড় এক গম্বুজের মসজিদ বাগেরহাটে
**বাগেরহাটে মধ্যযুগীয় সড়কের পথ ধরে
**ফের জাগছে খান জাহানের খলিফাতাবাদ নগর!
**শতভাগ বৃক্ষশোভিত বেতাগার সবুজছায়
**রিয়েলাইজেশন অব ডিজিটালাইজেশন