ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

বছরজুড়ে দেশ ঘুরে

রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরায় পাঁচ ঘণ্টা 

শুভ্রনীল সাগর, ফিচার এডিটর | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩২৬ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরায় পাঁচ ঘণ্টা  জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায় / ছবি: শুভ্রনীল সাগর

রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেলো একটি হরিণ। ডানদিকে ঘন বন। নিচু হয়ে দেখলে থমথমে আঁধার। কান পাতলে পাখির ডাক, পাতাখসা শব্দ আলাদা আলাদা করে কানে আসে।

সুন্দরবন ঘুরে: রুদ্ধশ্বাসে ছুটে গেলো একটি হরিণ। ডানদিকে ঘন বন।

নিচু হয়ে দেখলে থমথমে আঁধার। কান পাতলে পাখির ডাক, পাতাখসা শব্দ আলাদা আলাদা করে কানে আসে।

বামদিকটা আবার ঠিক উল্টো। পৌষের মধ্যাহ্নে শন বিছানো বিস্তীর্ণ প্রান্তর। মিশেছে একেবারে নদীতে। এদিকে-ওদিকে বুনো ফুল-লতার জটলা। মাথাভর্তি ঝাঁকড়া চুল নিয়ে থম মেরে দাঁড়িয়ে রয়েছে বরই গাছ। ঘন বন থেকে পড়িমরি করে বেরিয়ে সামনে দিয়ে ছুটে যায় আরেকটি হরিণ। চোখের পলকে নেই হয়ে যায়। কেউ তাড়া করছে বোধহয়! 

শোনা কথা, হরিণ নাকি এক লাফে যায় ১৩ ফুট আর বাঘ ১২। পেছনে বাঘ ধাওয়া করলে এই সমীকরণ দাঁড়ায়। তবে কি ওটা ১৩ ফুটের দৌড় ছিলো! এবার গলা শুকিয়ে আসে, পা এগোয় না। বাঘ?

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

বাঘের বার্তা আগেই ছিলো। শরণখোলা রেঞ্জের কটকা জেটি দিয়ে একটু এগিয়ে ওয়াচ টাওয়ার। উপর থেকে দক্ষিণ-পশ্চিম দিক বরাবর দৃষ্টি গিয়ে ঠেকে জামতলা বনে। ডানে-বামে বন ও খোলা প্রান্তর রেখে এগিয়ে গেছে সরু ট্রেইল। ওয়াচ টাওয়ার পেছনে রেখে একটু এগিয়ে গেলে মিঠে পানির পুকুর। সতর্ক সহযাত্রী তখনই দেখিয়েছিলেন বাঘের পদচ্ছাপ। বেশ কদিনের পুরনো বুজে যাওয়া ছাপ দেখে কেউ তেমন একটা ‍গা করেনি। বরং রোদের সঙ্গে সঙ্গে শরীর থেকে ঠিকরে বেরিয়েছে বুনো রোমাঞ্চ। সেটা উবে গেলো হরিণের ছুট দেখে।

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

ব্যাখ্যা দাঁড়ায়, বনের ভেতরে আপন মনে চরে বেড়াচ্ছিল হরিণের দল। পেছন থেকে হঠাৎ রয়েল বেঙ্গল টাইগারের হামলা। হয়তো একটি থাবার নিচে, বাকিদের এই ‘দে ছুট’ হাল। কিংবা ফস্কে গেছে শিকার, পিছু পিছু এদিকেও বাঘের পা পড়েছে। এখানে একদল মানুষের দেখা পেয়ে পড়েছে লুকিয়ে। হরিণের পিছু পিছু ১২ ফুটের লাফ তাই দেখা গেলো না, কিন্তু দোপেয়েদের ঘাড়ে থাবা বসার শঙ্কা-ভীতি ঠিকই রয়ে গেলো।

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

ন্যাশনাল জিওগ্রাফিক চ্যানেলে এ দৃশ্য খুব পরিচিত, বহুবার দেখা। দল বেঁধে চরে বেড়াচ্ছে হরিণ, মহিষ কিংবা জেব্রার দল। দূর থেকে নিশানা লাগিয়ে গাছ-গাছালি, লতাপাতার আড়ালে রয়েছে বাঘ। শিকারের জন্য এরকম খোলা প্রান্তর বাঘের খুব পছন্দের। পূর্ণগতিতে তাড়া করা যায়। সুযোগ মিলতেই রকেটের গতিতে শিকারের উপর ঝাঁপিয়ে পড়ে। কিছু বুঝে ওঠার আগেই ঘাড়ে কামড়। প্রাণভয়ে বাকিদের দশা হয় ওই দুই হরিণের মতো।  

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

প্রকাশ না পেলেও বাঘ দেখতে আসা অরণ্যযাত্রীদের মনের অবস্থা তখন ওইরকমই। পা যতো জামতলা বনের দিকে এগোয় ট্রেইল ততো সরু হয়ে আসে। ঝুঁকে পড়া গাছের পাতা ঘাড়ে-কানে লাগলেই মেরুদণ্ড বেয়ে শীতল স্রোত নামে। এই বুঝি বাঘ এলো!

পরিস্থিতি হালকা করতে কৌতুক উড়ে এলো। কার উপর ঝাঁপিয়ে পড়বে সেটা বাঘ নাকি আগেই ঠিক করে ফেলে। এক্ষেত্রে নাদুস-নুদুস শরীরই তার বেশি পছন্দের। দলে এরকম লোভনীয় শরীরের অভাব নেই, কাজেই ভয় জেঁকে বসলো আরও কয়েকগুণ।

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

ভয়, শঙ্কা, বাঘ সঙ্গে নিয়ে জামতলা বন পেরিয়ে পা গিয়ে পড়লো কচিখালি সৈকতে। বিশ্বের সবেচেয়ে বড় উপসাগর বঙ্গোপসাগরের ঢেউ আছড়ে পড়ছে সবচেয়ে বড় ম্যানগ্রোভ ফরেস্ট সুন্দরবনের বালুতটে। জোয়ারের পানি ভিজিয়ে দিয়ে যায় সুন্দরী-কেওড়া-গরানের গোড়া। সৈকত ধরে টানা দুই-তিন ঘণ্টা হেঁটে গেলে কচিখালি রেঞ্জ অফিস ও বন্যপ্রাণী অভয়ারণ্য কেন্দ্র।

পশুর নদীর বুক চিরে দুবলার চর, হিরণ পয়েন্ট, কটকা ঘুরে আমাদের গাঙচিল লঞ্চ তখন কচিখালি জেটিতে। কটকা জেটি দিয়ে ঢুকে জামতলা বনের শেষ মাথা পর্যন্ত মোটামুটি পর্যটকদের যাওয়া-আসা রয়েছে। এরপর সৈকত ধরে এতোটা পথ হেঁটে কচিখালি জেটি অব্দি সচরাচর কেউ যায় না। অন্য একটি কারণও রয়েছে, সুন্দরবনের যে অঞ্চলগুলোতে বাঘের ঘনত্ব সবচেয়ে বেশি, এর মধ্যে কচিখালি অন্যতম।  

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

যাত্রাশুরুর প্রথম তিন দিন লঞ্চের ডেক থেকে দীর্ঘশ্বাস ছুটে এসেছে গহীন বনে। বন ঘুরলেও বুনো স্বাদ তখনও কপালে জোটেনি। গা ছমছমে অনুভূতি একটু কটকা টাইগার পয়েন্টে হয়েছিল, কিন্তু খুব একটা জমেনি। সেই অপূর্ণতা ঘোঁচাতে দল এগুলো কচিখালি বনের পাশ দিয়েই। কার্যত, রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরার মধ্য দিয়ে। খুব কাছ থেকে সমুদ্র ডাকলেও যাওয়ার জো নেই, চতুর্দিকে চোরাবালির অদৃশ্য ফাঁদ। জল ও ডাঙা, ঘোর বিপদ দু’দিকেই!

একদিকে সমুদ্র, একদিকে সুন্দরবন। কোথায় যেনো পড়েছিলাম, সুন্দর খুব তীব্র হয়ে উঠলে ভয়ঙ্কর হয়ে ওঠে। ব্যাপারটি দাঁড়ায়, ভয়ঙ্কর সুন্দর। এর স্বার্থক উদাহরণ হতে পারে, কচিখালি। পদে পদে বিপদ, প্রতি ইঞ্চিতে ইঞ্চিতে সুন্দর। নেশা ধরিয়ে দেয়!

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

নেশা নেমেও যায় সহযাত্রীর উত্তেজিত হাঁক শুনে, এই দেখেন, বাঘের পায়ের ছাপ! 

সঙ্গে সঙ্গে আটটি মাথা ঝুঁকে গেলো। বনরক্ষীর পর্যবেক্ষণ, একদমই তাজা পায়ের ছাপ। কিছুক্ষণ আগেই হেঁটে গেছে। মানে, আশেপাশেই রয়েছে। লুকিয়ে দূর থেকে দেখছে আমাদের।

উল্টোদিক থেকে পায়ের ছাপ মিশেছে শন বনে। খানিকটা এগিয়ে আবারও পায়ের ছাপ, তবে আকার ভিন্ন। এর মানে অন্য আরেকটি বাঘ! চারপাশ ভালো করে খুঁটিয়ে দেখতে মিললো ব্যাঘ্রছানার ছোট্ট পায়ের ছাপও। পূর্ব পরিকল্পনা ছিলো, শন বনের ভেতর দিয়ে উঠবো কচিখালি রেঞ্জ অফিস। সঙ্গে সঙ্গে বাতিল।  

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

গত কয়েকদিনের ‘বাঘ দেখবো, বাঘ দেখবো’ রব কোথায় যে মিলিয়ে গেলো! উল্টে প্রাণ নিয়ে ফিরতে পারলে বাঁচি। মা বাঘিনী তাগড়া বাঘের চেয়েও ভয়ঙ্কর। প্রথমত, বাচ্চার জন্য খাবারের জোগাড়; দ্বিতীয়ত, বাচ্চার নিরাপত্তা। একবার যদি তার মনে হয়, আমরা তার বাচ্চাদের জন্য হুমকি- তাহলেই শেষ। অনেক সময় পুরুষ বাঘ বাচ্চাকে খেয়ে ফেলে বা থাবা দিয়ে মেরে ফেলে। এখান থেকে বাচ্চাকে বাঁচাতে বাঘকেও আক্রমণে হারিয়ে দেয় বাঘিনী। সেখানে আমরা তো চুনোপুঁটি! 

পায়ের ছাপ দেখেই বোঝা যাচ্ছে, অল্প সময় আগেই গোটা পরিবার হেঁটে গেছে সৈকতে। বনবিভাগের হিসাব অনুযায়ী, সুন্দরবনের বাংলাদেশ অংশে বাঘ অবশিষ্ট রয়েছে মাত্র ১০৬টি। এর মধ্যে তিন-চারটির দেখা তো এখানেই মিললো। দেখা মানে, পায়ের ছাপই সই। রয়েল টাইগার বলে কথা। সেলফি তুলতে তো আর আসবেন না, এলে স্বরূপেই দেখা দেবেন। ওই দেখা নিশ্চয়ই কেউ দেখতে চান না!

রয়েল বেঙ্গল টাইগার বা বাংলার বাঘ বাংলাদেশের জাতীয় পশু। বাঘের অধিকাংশ বাচ্চাই ফেব্রুয়ারি-মে মাসের মধ্যে জন্মায়। মায়ের যত্নেই চার-পাঁচ মাস লালিত-পালিত হয়। বাচ্চারা এক বছর বা আরও বেশি সময় মায়ের সঙ্গে থাকে। বড় আকারের একটি বাঘের দৈনিক মাংশ চাহিদা গড়ে আট-নয় কেজি। এমনিতে নিশাচর হলেও দিনেও যে বের হয় না, তা নয়। সেক্ষেত্রে ওই আট-নয় কেজি মাংশের যোগানদাতা কেউই হতে চান না, জোর পা চলে জেটির দিকে।

জামতলা-কচিখালি বাঘের ডেরায়

যেতে যেতে কিছু সহজলভ্য তথ্য এখানেও দেওয়া যাক, বাঘের ৮টি উপপ্রজাতির মধ্যে ৫টি এখনও জীবিত। এর মধ্যে বেঙ্গল টাইগার রয়েছে বাংলাদেশ, ভারত, ভুটান, নেপাল, চীন ও পশ্চিম মায়ানমার, আমুর (সাইবেরীয়) বাঘ সাইবেরিয়া, মাঞ্চুরিয়া ও উত্তর-চীন, দক্ষিণ-চীনের (আময়) বাঘ কেবল চীন, সুমাত্রার বাঘ সুমাত্রা এবং ইন্দোচীন বাঘ কাম্পুচিয়া, চীন, লাওস, মালয়, পূর্ব-মায়ানমার, থাইল্যান্ড ও ভিয়েতনামে দেখা মেলে।

আবাসভূমি উচ্ছেদ, খাবারের অভাব, চামড়া ও অন্যান্য অঙ্গ-প্রত্যঙ্গের জন্য অবৈধ শিকার সুন্দরবনের রয়েল বেঙ্গল টাইগারকে বিপন্নতার দিকে নিয়ে যাচ্ছে। সংশ্লিষ্টরা আশু পদক্ষেপ না নিলে অচিরেই বাঘহীন হয়ে পড়বে সুন্দরবন।

‘ভাই বাঘ দেখিছেন?’ লঞ্চে পৌঁছাতেই লঞ্চচালক তৈয়বের প্রশ্ন। ‘না’ শুনতেই সান্ত্বনা দেন, আমি ২৫ বছর সুন্দরবনে ট্রিপ মারি। বছরে ৬০-৭০ বার ট্যুরিস্ট নিয়ে আসি। বাঘ দেখিছি মাত্র আটবার।

এই পরিসংখ্যান শুনে আমরা এক ধরনের স্বস্তি অনুভব করি!

আরও পড়ুন
** সুন্দরের শীলন- সুশীলন

** বাঘের খোঁজে কটকার টাইগার পয়েন্ট​
** সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
** সিরিয়াল-তামিল-চাইনিজ ছবির দখলে দুবলার চর
** একটু-আধটু কুমড়া-মুলায় দুবালার চর
** দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা
** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
**এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে

বাংলাদেশ সময়: ০৯২২ ঘণ্টা, ডিসেম্বর ৩১, ২০১৬
এসএনএস/এএ


 

  
        
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।