তার স্মৃতির কথা মাথায় রেখে ঠিক আম বাগানের পাশেই ২০১১ সালে করা হয়েছে সিকান্দার আবু জাফর ফাউন্ডেশনের দোতলা ভবন। কবি পরিচয়ে বিখ্যাত হলেও তিনি একাধারে সঙ্গীত রচয়িতা, নাট্যকার ও সাংবাদিক।
উপরের বক্তা জুনায়েদ আকবর, ফাউন্ডেশনের পরিচালক ও সম্পর্কে কবির আপন ছোটভাইয়ের ছেলে। গ্রামের অলি-গলি ঘুরিয়ে, ডোবা পুকুরের পাড় দিয়ে আমাদের নিয়ে চলেন তাদের পূর্ব-পুরুষদের ভিটায়।
যেতে যেতে কবির ছোটবেলার গল্প শোনান, আমার দাদা সৈয়দ মঈনউদ্দীন হাশেমী ছিলেন ব্যবসায়ী ও কৃষক। ছেলেদের শরীর-স্বাস্থ্যের দিকে খুব নজর রাখতেন। এজন্য বাবা-চাচাদের দিয়েই হাল চাষ, মাটি কাটাসহ চাষাবাদের কাজ করাতেন। ভোরবেলা তুলে দিতেন। তার বক্তব্য ছিলো, এতে শরীরও ভালো থাকবে আর আমার কাজও হয়ে যাবে। সেই সূত্রে কবিকেও চাষাবাদের কাজ করতে হয়েছে।
শোনান আরও একটি মজার ঘটনা, কবির চাচা ও আমার আরেক দাদা সৈয়দ জালালউদ্দীন হাশেমী তখন ক্যালকাটা করপোরেশনের প্রথম মুসলিম মেয়র। স্থানীয় স্কুল থেকে ম্যাট্রিক পাস করার পর কবি কলকাতার রিপন কলেজে ভর্তি হন। থাকতেন তার মেয়র চাচার বাড়িতেই। একদিন চাচা জালালউদ্দীন দেখলেন, ভাইপো মনের আনন্দে তার সরকারি গাড়ি চালাচ্ছে। তিনি তখন বললেন, তুমি মেয়র নও, আমি মেয়র। ওটা আমারই চালানো উচিৎ।
ততোক্ষণে শতবর্ষী পাঁচিল পেরিয়ে মূল ভিটেয় ঢুকে পড়েছি। পেছনে রেখে এলাম কবির স্মৃতিবিজড়িত শান বাঁধানো পুকুর ও তার পূর্বপুরুষদের কবর। প্রশস্ত উঠানে এক কোণে আমগাছ। ঠিক এর পাশে একটি চৌচালা ঘর ছিলো। সেখানেই জন্মান কবি। ঘরটি এখন নেই। উঠানের অন্য পাশে পাকা বাড়ি উঠে গেলে কবির জায়গা হয় দোতলার কোণার ঘরে। ছাত্রজীবনের পুরোটা কেটেছে সেখানেই।
‘আমার চাচা-ফুফুরা সবাই সংস্কৃতিমনা ছিলেন। রোজ সন্ধ্যায় গান-কবিতার আসর বসতো। কেউ গান ধরলে অন্যরা গলা মেলাতেন। কবিতা পড়লে সবাই মনযোগ দিয়ে শুনতেন। কবি সিকান্দার আবু জাফরের কবি হয়ে ওঠা বলতে গেলে ওই ঘর থেকে’।
ধীরে ধীরে পরিবার বড় হয়েছে। সবাই গ্রামের বিভিন্ন প্রান্তে ঘর তুলেছেন। ১৯১৯ সালের ১৯ মার্চ সাতক্ষীরা জেলার তালা উপজেলার তেঁতুলিয়া গ্রামে জন্ম নেওয়া এ কবিও কলকাতা থেকে পড়াশোনার পাট চুকিয়ে দেশভাগের পর ঢাকায় চলে আসেন। পঞ্চাশের দশকে রেডিও পাকিস্তানের শিল্পী হিসেবে কাজ করেছেন। ১৯৫৭ সাল থেকে ১৯৭৫ সাল পর্যন্ত তিনি পালন করেছেন সাহিত্য পত্রিকা 'সমকাল'র প্রকাশক ও সম্পাদকের দায়িত্ব।
তার রচিত বিখ্যাত ‘আমাদের সংগ্রাম চলবেই’ গান ও ‘বাংলা ছাড়ো’ কবিতা স্বাধীনতা সংগ্রামকে আরও ত্বরান্বিত করেছে। তার প্রকাশিত কবিতার বইয়ের মধ্যে রয়েছে প্রসন্ন প্রহর (১৯৬৫), বৈরী বৃষ্টিতে (১৯৬৫), তিমিরান্তিক (১৯৬৫), বৃশ্চিক লগ্ন (১৯৭১) ও বাংলা ছাড়ো।
লিখেছেন নাটকও- শকুন্ত উপাখ্যান (১৯৫২), মাকড়সা (১৯৬০), সিরাজউদ্দৌলা (১৯৬৫) ও মহাকবি আলাওল (১৯৬৬)।
উপন্যাসের মধ্যে রয়েছে- মাটি আর অশ্রু, পূরবী ও নতুন সকাল এবং কিশোর উপন্যাস জয়ের পথে ও নবী কাহিনী।
অনুবাদেও হাত পাকিয়েছেন- রুবাইয়াৎ-ওমর খৈয়াম, সেন্ট লুইয়ের সেতু ও বারনাড মালামুডের যাদুর কলস।
বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে জন্ম-মৃত্যুর সঙ্গে মিলিয়ে মজার একটি দিকও নজরে আনলেন কবির ভাইপো। বঙ্গবন্ধুর জন্ম ১৭ মার্চ (১৯২০) ও মৃত্যু ১৫ আগস্ট (১৯৭৫) এবং কবির জন্ম ১৯ মার্চ (১৯১৯) ও মৃত্যু ০৫ আগস্ট (১৯৭৫)।
এজন্য কবি ও বঙ্গবন্ধুর জন্ম মাস মিলিয়ে সিকান্দার আবু জাফর ফাউন্ডেশন ২০১১ সাল থেকে প্রতিবছর ১০ দিনব্যাপী লোকজ মেলার আয়োজন করে আসছে। ‘সিকান্দার মেলা’ নামে পরিচিত এ মেলা সরকারিভাবে পালিত হয়। গ্রামীণ ঐতিহ্য, হস্তশিল্পকে ও লোক সংস্কৃতিকে এগিয়ে ফাউন্ডেশন কাজ করে চলেছে বলে জানান জুনায়েদ আকবর।
আরও পড়ুন
** কপোতাক্ষের স্নেহের তৃষ্ণা মেটে কার জলে!
** রয়েল বেঙ্গল টাইগারের ডেরায় পাঁচ ঘণ্টা
** সুন্দরের শীলন- সুশীলন
** বাঘের খোঁজে কটকার টাইগার পয়েন্ট
** সুশীলনের ব্যাঘ্রতট থেকে সুন্দরবনের হাতছানি
** সিরিয়াল-তামিল-চাইনিজ ছবির দখলে দুবলার চর
** একটু-আধটু কুমড়া-মুলায় দুবালার চর
** দুবলার চরের জেলেদের জীবনগাথা
** না দেখলেই নয় হাড়বাড়িয়া ইকোট্যুরিজম কেন্দ্র!
**এইসব দিনরাত্রি রয়ে যাবে গাবখান-বলেশ্বরের বাঁকে
** বুড়িগঙ্গা-মেঘনা ছুঁয়ে পশুর নদীর ডাকে
বাংলাদেশ সময়: ০৬৫৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ০২, ২০১৭
এসএনএস/এটি