ঢাকা, সোমবার, ৮ পৌষ ১৪৩১, ২৩ ডিসেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

পর্যটন

আড্ডা আছে, ‘সেই’ আড্ডাটা নেই কফি হাউসে

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৩৫০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৭
আড্ডা আছে, ‘সেই’ আড্ডাটা নেই কফি হাউসে ছবি ও ভিডিও: আসিফ আজিজ

কলকাতা: মৌলালি থেকে চিপা যানজটের রোড ধরে ৬ রুপিতে সোজা কলেজ স্ট্রিট। পুরনো বইয়ের গন্ধ মাখতে মাখতে প্রেসিডেন্সি কলেজ রোড ধরে এগোনো। দুটি ট্রাম ঠং ঠং ঘণ্টা বাজিয়ে ছুটে গেলো রাস্তার মাঝধরে। প্রেসিডেন্সির গেটের উল্টোদিকের বাঁয়ের গলিতে ঢুকলেই বিখ্যাত ইন্ডিয়ান কফি হাউস। সামনেই সংস্কৃত কলেজ।

বইপাড়ার ভিড় ঠেলে একগ্লাস আমপোড়া শরবতে প্রাণ জুড়িয়ে পুরনো ভবনের দোতলার সিঁড়ির কাছে যেতেই গমগম মানুষের আওয়াজ। পাশে টেরাকোটা কাজের খানদশেক সিঁড়ি ভাঙতেই নজরে এলো নিয়ন আলোয় লেখা কফি হাউস।


কফি হাউসের প্রবেশমুখ/ছবি: আসিফওরে বাবা! কি আওয়াজ ভেতরে! বসার জন্য মিনিট ১০ ঘুরেও জায়গা পাওয়া গেলো না। কখন কোন টেবিল থেকে কে উঠছে সেই ভিড়ের মধ্যে দাঁড়িয়ে থেকে দেখাও অস্বস্তিকর। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় গিয়েও দেখা গেলো একই চিত্র। কিন্তু আড্ডাবাজদের চেহারা-পরিচ্ছদ দেখে বোঝা গেলো নিছক আড্ডা নয়, তারা কাজের আড্ডায় বসেছেন বেশি। কবি-লেখক-শিল্পীই হবেন হয়তো! প্রেমিক যুগলও আছে কিছু।
তুমুল আড্ডা কলকাতা কফি হাউসে/ছবি: আসিফ-বাংলানিউজ‘কফি হাউসের সেই আড্ডাটা আজ আর নেই….’ মান্না দে’র সেই গানের সঙ্গে কেউ মেলাতে পারবে না অন্তত শনিবারের কফি হাউসকে। তবে মান্না দে’র জায়গা থেকে হয়তো হিসাব সহজ। বিখ্যাত গীতিকার গৌরী প্রসন্ন মজুমদার অসুস্থ অবস্থায় ট্রেনে বসে সিগারেটের প্যাকেটে গানের শেষ যে স্তবকটি রচনা করেছিলেন সেখানেই রয়েছে সহজ হিসাবের উত্তর।

‘সেই সাতজন নেই আজ টেবিলটা তবু আছে/সাতটা পেয়ালা আজও খালি নেই/একই সে বাগানে আজ এসেছে নতুন কুঁড়ি/
শুধু সেই সেদিনের মালি নেই/কতো স্বপ্নের রোদ ওঠে এই কফি হাউজে কত স্বপ্ন মেঘে ঢেকে যায়/কতজন এলো গেলো কতজনই আসবে/ কফি হাউজটা শুধু থেকে যায়। ’
কফি হাউসে আড্ডায় প্রবীণরা/ছবি: আসিফ-বাংলানিউজমান্না দে আমলের ‘সেই’ আড্ডাটা রূপ বদলেছে গৌরীবাবুর কথামতোই।
 
অ্যালবার্ট হলে ৬৫ জন ট্রাস্টি ১৯৫৮ সাল থেকে চালাচ্ছেন কফি হাউস। তারাই মালিক, তারাই কর্মচারী।
কফি হাউসের উপর-নিচ মিলে চলছে আড্ডা/ছবি: আসিফ-বাংলানিউজক্যাশে বসে তপন পাহাড়ি বলছিলেন, আমি ২২ বছর হলো কাজ করছি কফি হাউসে। আমার বাবা গোপাল পাহাড়ি কাজ করেছেন ৪০ বছরের বেশি। মান্না দে’কে কাছ থেকে দেখেছি। সবশেষ বেশি পরিচিত লেখকদের মধ্যে সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় নিয়মিত আসতেন। তবে একসময় কফি হাউসে সব শ্রেণীর মানুষ ঢুকতে ভয় পেতেন, এখন সেটা কেটে গেছে। সবাই এখন এখানে আসে। বসার জায়গা পাওয়া যায় না।
 
এখন প্রচুর সংখ্যক বিদেশি প্রতিদিন কফি হাউসে আসে বলেও জানান তিনি।
কফি হাউসে আড্ডায় তারুণ্য/ছবি: আসিফ-বাংলানিউজআশাপাশে বিখ্যাত সব শিক্ষা প্রতিষ্ঠান, নামি প্রকাশনী, খাবারের দোকান, শতবর্ষী বিভিন্ন প্রতিষ্ঠান-ভবন কলেজ স্ট্রিটকে দিয়েছে ভিন্ন মাত্রা। সমরেশ মজুমদারে বিখ্যাত নায়ক-নায়িকা অনিমেষ, দীপান্বিতা কিংবা কবির সুমনের গানেও উজ্জ্বল এ বুদ্ধিচর্চার ক্ষেত্র।
 
কিন্তু কফি হাউসে কি আছে আগের সেই জৌলুস? অনেকে গানের সঙ্গে মেলাতে গিয়ে গুলিয়ে ফেলেন। মান্না দে, গৌরীপ্রসন্ন, পুলক বন্দ্যোপাধ্যায়, সত্যজিৎ রায়রা তো সবসময় থাকে না, থাকবে না। তাদের ধ্যানিক জগতে নতুন আলো ফেলবে সেই যুগের তারুণ্য।
 
মোটা চশমা পরে কফির কাপে ধোঁয়া উড়িয়ে যে লোকটি জমিয়ে রেখেছেন আড্ডা, সেই হয়তো নিখিলেশ, মইদুল। তিন-চার ঘণ্টার আড্ডায় যে লোকটি চারমিনার ঠোঁটে জ্বালিয়ে কথা বুলি ঝাড়ছেন কিংবা কোণায় বসে যে মেয়েটি ক্লাস শেষে এসে বসেছে কফির পেয়ালায় চুমুক দিকে সেই হয়তো গানের কোনো খোলস বদলানো সুজাতা।
কফি হাউসের ওপরতলায় যুগলদের আড্ডা/ছবি: আসিফ-বাংলানিউজকফি হাউসে বসে দেখা কবি নৃপেন চক্রবর্তীর সঙ্গে। কফি হাউসের আড্ডা প্রসঙ্গে তার বক্তব্য, কফি হাউস কেমন আছে, আড্ডা কেমন চলছে সেটা তো এখানে বসেই দেখতে পাচ্ছো। টেবিল খালি পাওয়া যায় না। আমরা কবিবন্ধুরা এসেছি আড্ডা দিতে। প্রবীণদের পাশপাশি যেসব তরুণ এখানে আসছে তারাও কোনো না কোনোভাবে শিল্প-সাহিত্য-সংস্কৃতির সঙ্গে যুক্ত। তুমি খোঁজ নিয়ে কথা বলে দেখতে পারো। অল্প কিছু লোক হয়তো আসে দেখতে কিংবা বিখ্যাত কফি হাউসে এককাপ কফি পান করতে। আড্ডাটা মোটেও হারিয়ে যায়নি, কমেনি।
 
নিচতলায় ৫৪টি টেবিলে বসতে পারেন ২৫০ জনের বেশি। ছোট্ট টেবিলটাতে ৬-৭জন ঘিরে বসার রেকর্ডেই বেশি। ওপরতলায় রয়েছে ৪৫টি টেবিল। তবে পুরনোদের বেশি পছন্দ নিচতলা। এটিকেই তারা মূল কফি হাউস মনে করেন। ওপরে অপেক্ষাকৃত তরুণ ও যুগলদের ভিড় বেশি। ওয়েটারদের পোশাকে সেই আগের আভিজাত্য এখনও ধরে রেখেছে। সব মিলে চারশোজনের মতো একসঙ্গে বসে আড্ডা দিতে পারেন এখানে। জানাচ্ছিলেন তপন।
কফি হাউসের নিচতলার ক্যাশ কাউন্টার/ছবি: আসিফ-বাংলানিউজট্রাস্টির মাধ্যমে চললেও ভারত সরকারের প্রত্যক্ষ নজর রয়েছে কফি হাউসের প্রতি। মাত্র চার হাজার টাকা নামমাত্র মাসিক ভাড়ায় চলে প্রতিষ্ঠানটি।
 
কফি হাউসে কিন্তু শুধু কফি পাওয়া যায় না। এখানে পাঁচ পদের কফির পাশাপাশি চায়নিজ আইটেম ও বিভিন্ন স্ন্যাকসও মেলে। দামও ততো বেশি নয়। কফি মেলে ১৭ থেকে ৩৮ টাকার মধ্যে। ক্রিমসহ কোল্ড কফির দাম সর্বোচ্চ।

বাংলাদেশ সময়: ০৯৪০ ঘণ্টা, মার্চ ২০, ২০১৭
এএ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।