ঢাকা, শুক্রবার, ১২ পৌষ ১৪৩১, ২৭ ডিসেম্বর ২০২৪, ২৪ জমাদিউস সানি ১৪৪৬

সিঙ্গাপুর

সিঙ্গাপুরের চিঠি-২

ভারতীয় খালা বলেই খাবারের দাম দিলেন

মাজেদুল নয়ন, স্পেশাল করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৫ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৭
ভারতীয় খালা বলেই খাবারের দাম দিলেন সিঙ্গাপুরের চিঠি

সিঙ্গাপুর থেকে: ট্যাক্সি চালকের নাম তিন পিউ। পঞ্চাশোর্ধ পিউ জিপিএসে ঠিকানা বসাতেই ম্যাপ চলে এলো। এখানে ট্যাক্সিগুলোতে মোবাইলে নয়, বরং জিপিএস মেশিনই বসানো হয় বলে জানান তিনি। 

পর্যটক প্রিয় যে কোন শহরে প্রাথমিক তথ্য নেওয়ার জন্য সবচেয়ে নির্ভরযোগ্য সোর্স অবশ্যই ট্যাক্সি চালক। সিঙ্গাপুর যেন আমার কাছে এবারই প্রথম, এমন ভঙ্গি নিয়ে জানতে চাইলাম, ‘বাইরে বেশ গরম, তাই না?’ 

নিজের দেশ আর শহরকে পরিচয় করিয়ে দিতে কার না ভাল লাগে? পিউও তা-ই করলেন।

বললেন, ‘সবসময় গরম এখানে। ৩২ ডিগ্রির মতো তাপমাত্রা। আর নভেম্বর, ডিসেম্বরের দিকেই কিছুটা বৃষ্টি হয়। তবে অনেক গরম যে সেটাও বলা যাবে না। ’ 

হাসতে ভালবাসেন এই চালক। কথার আগে-পরে একবার করে হাসি দেন।  

অনিন্দ্য সুন্দর সিঙ্গাপুরকেবল সিঙ্গাপুর নয়, বিদেশে এলেই আপনাকে বেশ কয়েকবার উত্তর দিতে হবে যে, ভারত থেকে এসেছেন কিনা? কারণ দৈহিক গড়ন ও বর্ণ। বাংলাদেশ বলতেই জানালেন, তার অনেক বাংলাদেশি বন্ধু রয়েছে।  

পিউ এক সময় নির্মাণশিল্পে একটি কোম্পানির ব্যবস্থাপক হিসেবে চাকরি করতেন। তখন অনেক বাংলাদেশির সঙ্গে পরিচয় হয়। ‘বৃষ্টি নেই গরম লাগছে’, ‘পানি খাবো’— এ ধরনের আরও কিছু কিছু বাংলা বাক্য শোনাতে পেরে বেশ খুশি তিনি। তবে ভাষা হিসেবে বাংলাকে চায়নিজের মতোই কঠিন হিসেবেই আখ্যা দিলেন।

চাঙ্গি এয়ারপোর্ট থেকে বের হওয়ার পর যে হাইওয়েটি চোখে পড়ে, সেটা মন জুড়ানো। অনেক ফুল চিনি না বলে আফসোস হলো। এতো রঙিন রাস্তা আর চোখে পড়েনি কোথাও। লাল-নীল-বেগুনী রংকে মুড়িয়ে রেখেছে সবুজ। এখানে শুধু পথের এক দিকেই ৬ লেনের রাস্তা। আর সেখানে বলা আছে কোথায় গেলে কোন লেনে থাকতে হবে। প্রায় ৪৫ মিনিটের পথ পেরিয়ে ১২১ ক্লেমেন্তি রোডের কেন্ট ভ্যালিতে যখন প্রবেশ করি, ঘুম তখন চোখের দুই পাপড়ির ঠিক মাঝখানটায় ঝুলছে।  

অনিন্দ্য সুন্দর সিঙ্গাপুর২৫ ডলার ভাড়া দিয়ে অ্যাপার্টমেন্টের অফিসের দিকে এগোলাম। এটা যে একটা বনেদি জায়গা, সেটা নামার পড়েই বোঝা যায়। পিনপতন নীরবতা। ন্যাশনাল ইউনিভার্সিটি অব সিঙ্গাপুরে আসা বিদেশি অতিথিদের রাখা হয় এখানে।  

সামনেই ঝিরির মতো পানির স্রোত। এখানকার ৩২ বা ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস তাপমাত্রায় ঠাণ্ডা হাওয়া বইয়ে দেয়। অ্যাপার্টমেন্টে অফিসে ঢুকে বললাম, আমি এজেএফ’র ফেলো। পাশের চায়নিজ মেয়েটি লাফ দিয়ে উঠলো। ‘ওহ তুমি এজেএফ’র! আমি চিন চিয়াং, ফেলো ফ্রম চায়না। ’ দেখতে সুন্দরী বলা যায়, পাশে তার বাচ্চাও।  

চিনের কথার ফাঁকে কাউন্টারের নারী জানিয়ে দিয়েছেন, ২টার আগে চেক-ইন হবে না। অগত্যা আরও একঘণ্টা অপেক্ষার জন্য সোফায় বসলাম। কিন্তু মিনিট পাঁচেকের মধ্যেই কাউন্টার থেকে বললেন, তুমি রুমে যেতে পারো। তবে রেজিস্ট্রেশন ফর্মে সময় উল্লেখ করতে মানা করা হলো।

১০ তলায় ১০০৬ নাম্বার ফ্ল্যাটটি বিশাল বলা যায়। এ যেন ছোট-খাট ফুটবল মাঠ। পুরো ফ্ল্যাটের এ মাথা থেকে ও মাথা দ্রুত হাঁটলেও এক মিনিটের বেশি সময় লাগবে। এরই মধ্যে জানা হয়ে গেছে, আমার ফ্ল্যাটমেটদের একজন ভারতীয় এবং একজন ইন্দোনেশিয়ান। ভারতের মুম্বাইয়ের ছেলে চৈতন্য সিনিয়র রিপোর্টার হিসেবে কাজ করেন মুম্বাই মিররে এবং ইন্দোনেশিয়ার দামার হারসানতো জাকার্তা পোস্টের অনলাইন এবং আন্তর্জাতিক বিভাগের সম্পাদক। আমি দু’জনকেই মেইল করে জানিয়ে দিলাম যে, ফ্ল্যাটে ঢুকেছি এবং তাদের জন্য অপেক্ষা করছি। চৈতন্য কিছুক্ষণের মধ্যেই আসবে বলে ফিরতি মেইলে জানালো। আর দামার আসবে পরদিন।  ফেলোদের মাঝে লেখকএই ফ্ল্যাটে কী কী আছে তা বলার চেয়ে সহজে বলা যায়, থাকার কিছুই বাকি নেই। পুরোটা ঘুরে দেখার আগেই ঘুমিয়ে গেলাম সোফায় ৫৪ ইঞ্চি টেলিভিশন ছেড়ে দিয়ে। গভীর ঘুম ভাঙলো দরজা খোলার শব্দে। চৈতন্য রুমে ঢুকলো। সঙ্গে তার খালা এবং খালু। দু’জনেই এখানে এসটিই সফটওয়্যার কোম্পানিতে ইঞ্জিনিয়ার হিসেবে কাজ করেন। গত ২৮ বছর ধরেই এখানে চাকরি করছেন অনুপমা পিসুপাতি এবং রবিশংকর পিসুপাতি।  

জিজ্ঞাসা করলেন, দুপুরে খেয়েছি কিনা? না বলতেই তাদের সঙ্গে খেতে যেতে বললেন। সুযোগ হাতছাড়া করলাম না। কারণ এই ক্ষুধা পেটে একা একা খাবারের দোকানের সন্ধান করা কঠিন।

ওয়েস্ট ভিলেজ মার্কেট এখান থেকে কাছেই। তবে নতুন পথ চিনে কেন্ট ভেলের পেছনের পকেট পর্যন্ত পৌঁছাতে সময় লেগে গেলো। পকেট ফটকেই ক্লেমেন্তি উড পার্ক উঁচু-নিচু টিলায় সাজানো। এখানে রাস্তা পার হতে সিগন্যাল লাগে। অন্য দেশেও এমন নিয়ম দেখেছি, তবে মানা হয় না। রাস্তা খালি থাকলেও মানুষ পার হয় না। সিগন্যালের জন্য অপেক্ষা করে।

অনুপমা খালা একটু অবাক হলেন আমি হিন্দি বলতে পারি না জেনে। এটা আমার বলিউড সিনেমা সম্পর্কে অজ্ঞতার কারণ বলে জানালাম। আমার এবং চৈতন্যের কী করণীয়—সে সম্পর্কে ধারণা দিতে থাকলেন। বাজারের ফুড কোর্টে বেশিরভাগ দোকান চায়নিজদের। নিরামিষভোজী চৈতন্যের জন্য মাংস হারামের মতো। সে জীবনেও মাংস খায়নি। খালা আমার জন্য মুরগির সিদ্ধ মাংস আর ভাত অর্ডার করলেন। নিজেরা বসলেন আঁখের শরবত নিয়ে। একমাত্র ভারতীয় খালা বলেই আমাকে বিল দিতে হলো না। তবে চায়নিজ বা সিঙ্গাপুরের আন্টি হলে নিজেকেই যে বিল দিতে হতো, সেটা আমার জানা।

চৈতন্য আজ রাতেও তার খালার বাসায় থাকবে। রুমে ফিরে একা আমি টিভি দেখার চেষ্টা করলাম। তবে টিভির প্রোগ্রাম অপারেট করা সহজ নয়। সন্ধ্যা হয়ে এলো, এমন সময় ম্যাসেঞ্জারে শানিকার টোকা। শ্রীলংকার সাংবাদিক শানিকা ফ্রিল্যান্স কাজ করে। পরে শুনেছি, তামিলদের বিরুদ্ধে শ্রীলংকান সেনাবাহিনীর যুদ্ধে অসীম সাহসিকতার সঙ্গে  রিপোর্ট করেছেন তিনি। আমি শানিকাকে কফি পানের দাওয়াত দিলাম।

তার ডাকে কেন্ট ভেলের লবিতে গেলাম। সেখানে গিয়ে নারীদের আড্ডায় পড়ে গেলাম যেন। মালয়েশিয়া স্টারের চিফ রিপোর্টার শর্মিলা, চায়নিজ একটি পত্রিকার রিপোর্টার ও টিভি চ্যানলের উপস্থাপিকা আকি, চিন চিয়াং এবং শানিকা বসা। তাদের ভ্রমণ অভিজ্ঞতা শেয়ার করছে। কিছুটা বিরক্ত হচ্ছিলাম অতিমাত্রায় ‘ওয়াও’ বা ‘আহা’ ধরনের শব্দের উচ্চারণে। সময় যাওয়ার অপেক্ষা করছিলাম। ওরা বের হয়ে গেলে রওনা দিলাম ওয়েস্ট ভিলেজের পথে। আজ রাতে বার্গার কিংয়ের বার্গারই ভরসা। আর এখানে সিগারেট টানতে হলে হাঁটতে হয় প্রায় দেড় কিলোমিটার পথ।

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জুলাই ৩১, ২০১৭
এমএন/এইচএ/

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।