২৬ আগস্ট সকালে বাংলাদেশ সীমানা পেরিয়ে ইমিগ্রেশন শেষ করার পর তিন দিন চেরাপুঞ্জির আনাচে-কানাচে চষে বেড়িয়েছি। সবচেয়ে অবাক করার বিষয়, কোথাও এক পলকের জন্য একজন পুলিশও চোখে পড়েনি।
আসলে এখানকার মানুষগুলোই সবার অবাধ বিচরণের দ্বার উন্মুক্ত করে রেখেছেন। এখানকার খাসিয়াদের জীবনমান খুবই স্বাচ্ছন্দ্যের নয়, তবে পর্যটকদের ঘিরেই এখন অর্থনীতি কিছুটা জমজমাট। তাই হয়তো পর্যটকদের জন্য সার্বিক সুবিধাজনক পরিস্থিতি বজায় রেখেছেন নিজেরাই।
প্রতিটা স্পটের সামনেই ছোট-বড় চা-নাস্তার দোকান রয়েছে। আপনি দোকানের সামনে দিয়ে ঘুরে ইচ্ছামতো দোকান পছন্দ করে অর্ডার করবেন। কিন্তু কেউ ‘আমার দোকানে আসেন’ বলে টু শব্দটিও করবে না। আপনি যা জানতে চাইবেন, সানন্দে সবকিছু বুঝিয়ে দেবে সবাই। খাসিয়ারা নিজের ভাষার পাশাপাশি বেশ ভালো ইংরেজি বলে। দোকানগুলোতে ঘুরে ক’দিনে বোঝা গেলো, হিন্দির চেয়ে তারা ইংরেজিতেই বেশ দক্ষ।
খোঁজ নিয়ে জানা গেলো, মাতৃপ্রধান খাসিয়াদের প্রায় শতভাগ সন্তানই স্কুলে যায়। দুর্গম নংরিয়েত গ্রামে গিয়েও স্কুল দেখে তার প্রমাণ পাওয়া গেলো। আমরা চেরাপুঞ্জিতে যে বাড়িতে ছিলাম, সেই বাড়ির মালিক অর্লিন অর্থনীতিতে স্নাতক সম্পন্ন করে কিছুদিন স্কুলশিক্ষক হিসেবে চাকরি করেছেন। স্বামী এখনো মিজোরাম রাজ্যে স্কুলশিক্ষক হিসেবে কর্মরত। এক সন্তানের জননী অর্লিন একপর্যায়ে চাকরি ছেড়ে দিয়ে নিজের বাড়ির সামনে একটা দোকান করেছেন, আর পর্যটকদের থাকার জন্য ছাদে দুইটা রুম করে রেখেছেন। তিন দিনের দুই দিন তার বাড়ির রান্নাই খেয়েছি, তৃতীয় দিন তার ঘরে খাইনি। প্রতিদিনই কোথায় খাওয়া যাবে, কোথায় ঘুরতে হবে সবকিছু বুঝিয়ে দিয়েছেন ভীষণ আন্তরিকতার সঙ্গে। শেষের দিন আধঘণ্টার মধ্যে নতুন গাড়িও ঠিক করে দিয়েছেন।
নংরিয়েত গ্রামে ডাবল ডেকার রুট ব্রিজে যাওয়ার সময় আমাদের গাইড ড্যানি সপ্তম শ্রেণি পর্যন্ত পড়েছেন। স্বল্প বয়সী এই ড্যানিও বেশ ঝরঝরে ইংরেজি বলেছেন। তার নিজের ইচ্ছেমতো নয়, আমাদের ইচ্ছেমতো সবকিছু খুঁটিয়ে খুঁটিয়ে বর্ণনা করে গেছেন পুরোটা পথ। মাওলিনং গ্রামের হোটেল মালিক আমাদের বলেছেন, কোন সময়ে শিলং-চেরাপুঞ্জির কোন রূপ। কখন কোন স্পট ঘোরার উপযুক্ত সময়- সবকিছু।
দীর্ঘ চারদিনের ভ্রমণে কোথাও যত্র-তত্র ময়লা আবর্জনা পাইনি। আপনি চিপস-পানি খাচ্ছেন, প্রয়োজনে স্থানীয়রা দেখিয়ে দেবে ডাস্টবিন কোথায়। কিংবা আপনার ফেলে রাখা বর্জ্য নিজ হাতে ডাস্টবিনে রেখে একরকম শিক্ষা দিয়ে দেবে। গ্রামগুলোর মধ্যেও বাঁশের তৈরি ডাস্টবিনের দেখা মিলবে। আশ্চর্যের বিষয় এত ঝরনা-ঝিরিপথ কিংবা পাহাড়ের আনাচে-কানাচে কোথাও কোনো বর্জ্যের দেখা মেলেনি। সবাই পরিচ্ছন্নতার বিষয়ে কত সচেতন!
এত বড় পর্যটন কেন্দ্র হওয়া সত্ত্বেও কোথাও কোনো কৃত্রিমতার ছাপ নেই। ভাবলাম, আমাদের দেশে হলে এখানে ফাইভ স্টার মানের কত হোটেল গড়ে উঠতো। কত ধরনের বাণিজ্য চালু হতো এখানে। অথচ এখানে চাষ হয় না বলে এখনো সবজির স্বল্পতা রয়েছে। আসাম থেকে শিলং হয়ে চাহিদা অনুযায়ী অনেক দামে সবজি সরবরাহ করা হয় এখানে। শিলংয়ের কিছু এলাকায় সবজি চাষ হলেও চেরাপুঞ্জিতে প্রায় শূন্য। পাহাড়ের এক কোণে ছোট গ্রামগুলোতেও পাবলিক টয়লেটের দেখা মিলবে। কিছুদূর যাওয়ার পরপর ‘পে অ্যান্ড ইউজ’ লেখা দেখে বোঝা যায়, পর্যটকদের জন্য কী করেনি তারা।
চেরাপুঞ্জি থেকে শিলং ফেরার পথে ড্রাইভার বা-জোপ মাঝপথে নিজের আত্মীয়ের বাড়িতে চায়ের সাদর আমন্ত্রণ জানালেন। ঘরে ডেকে নিয়ে ‘স্টিকি রাইস’সহ রং চা আসলেই আমাদের জন্য ছিল বাড়তি পাওনা।
কথা প্রসঙ্গে বা-জোপ জানালেন, এখানকার বেশিরভাগ জায়গার মালিক স্থানীয় বাসিন্দারা। বাইরের রাজ্যের কেউ চাইলেই এখানে জমি কিনতে পারবেন না। কিছু পাহাড় সরকারের আওতায় রয়েছে, বাকি সবই স্থানীয়দের। তখনো মনে মনে ভাবছি, আদিবাসীদের সঙ্গে অন্যদের মিলিয়ে ফেলা হয়নি এখানে। কিংবা মিলে যাওয়ার সুযোগ দেওয়া হয়নি। তাই হয়তো নিজেদের মধ্যে হিংসা-বিদ্বেষ, ক্রোধ-হানাহানি নেই এখানে।
সবমিলিয়ে বোঝা গেলো, শিলং-চেরাপুঞ্জি ভ্রমণে এসে যদি আপনি খাসিয়া বা স্থানীয়দের ড্রাইভার বা গাইডের সাক্ষাৎ পান তাহলে প্রত্যাশার চাইতে বেশি কিছুই পাবেন। গাড়ির নম্বর প্লেটে এমএল লেখা এবং আলোচনা করে সানন্দে রওনা দিতে পারেন। এখানে অনেক ড্রাইভার আছেন আসামের, সেসব গাড়ির নম্বরপ্লেটে সাধারণত এএস লেখা থাকে।
অবশেষে ২৯ তারিখ রাতে শিলং শহরে এসে প্রথমবারের মতো একটি গাড়িতে পুলিশের দেখা পেলাম। টিমমেটদের একজন বললেন, রাজধানী শহরেই পুলিশ নেই। রাজধানীর বাইরে যে পুলিশ সদস্যরা আছেন, তাদের বোধহয় কোনো কাজই নেই।
শেষ দিন ৩০ আগস্ট সকালে শিলং থেকে ডাউকি ফেরার আগে সকালের নাস্তা করেছিলাম একটি হোটেলে। নাস্তা শেষে সামনে গাড়ি খুঁজছিলাম। আবার ওই হোটেলের সামনে ফিরে আসতেই দোকানী ডেকে ৩০ রুপি ফেরত দিয়ে বললেন, ভুলে বেশি রাখা হয়েছিল। আমরা ভাবলাম, এও সম্ভব শিলংয়ে? অবশ্যম এর আগে যখন কোনো দোকানে ভুলে মানিব্যাগ বা মোবাইল রেখে ঘুরে গিয়ে একই স্থানে তেমনই ফেরত পাওয়ার কথা জেনেছি; সেখানে দোকানী ভুল করে বেশি নিয়ে ৩০ টাকা ফেরত দেবেন- এটা নিশ্চয়ই বেশি কিছু নয়!
শিলং থেকে ডাউকি আসার শেষ সঙ্গী ড্রাইভার নাথান জানালেন, বিজেপি জোটের এক দল ক্ষমতায় মেঘালয়ে। রাজ্য প্রধান একজন গারো সম্প্রদায়ের। জৈন্তা,খাসিয়া ও গারো হিলসের মধ্যে জৈন্তা হিলসের লোকজন ধনী। কারণ সেখানে সবচেয়ে বেশি পাথর ও কয়লা উত্তোলন হয়। তবে ভিন্ন ভিন্ন জাতি ধর্মের লোকজন নিয়ে কারও কোনো ভ্রুক্ষেপ নেই। সবাই নিজের মতো বেশ সুখে আছে। খাসিয়া হিলসের মানুষ একটু বেশিই বন্ধুসুলভ।
প্রকৃতি কোথাও কম বা কোথাও বেশি দিয়েছে। তবে যা আছে তাতে ভালোবাসার ছোঁয়া এবং কর্তৃপক্ষের সঠিক পরিকল্পনা থাকলে সহজেই ভালো থাকা যায়। যার প্রমাণ, এই চার দিনের ভ্রমণে এত বড় পর্যটন এলাকায় একজন ভিক্ষুকের দেখাও পাইনি। প্রাপ্তি যাই হোক, হাসিমুখে সবার মন জয় করে নেওয়াটাই হয়তো শিলং-চেরাপুঞ্জির স্থানীয়দের বিশেষত্ব। মেঘ, পাহাড় এবং ঝরনার সঙ্গে শিলং-চেরাপুঞ্জির স্থানীয়দের মননের শুদ্ধতা মন জয় করে নেবে যে কারও।
বাংলাদেশ সময়: ০৯২০ ঘণ্টা, সেপ্টেম্বর ০৯, ২০১৯
পিএম/এইচএ/
পড়ুন আগের দুই পর্ব
** মেঘের দেশে ঝরনার গান ডোবায় গভীর মোহে
** শিলং-চেরাপুঞ্জির পথে...