ঢাকা, সোমবার, ১৩ মাঘ ১৪৩১, ২৭ জানুয়ারি ২০২৫, ২৬ রজব ১৪৪৬

অন্যান্য

টাকা জোগাড়ে করের বোঝা

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯২৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৬, ২০২৫
টাকা জোগাড়ে করের বোঝা প্রতীকী ছবি

দেশের রাজনীতির অনিশ্চয়তা ভর করেছে দেশের অর্থনীতিতে। অন্তর্বর্তী সরকারের সময়ে আস্থাহীনতায় ব্যবসা-বিনিয়োগে ভাটা।

উৎপাদন, সরবরাহ ও বিপণনে ধীরগতি। আইন-শৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে উদ্বেগ।

ব্যবসার প্রসার কিংবা নতুন বিনিয়োগ করা না করা নিয়ে শঙ্কা থাকায় গতি নেই অর্থনীতিতে। আন্তর্জাতিক মুদ্রা তহবিলসহ (আইএমএফ) বিভিন্ন আন্তর্জাতিক দাতা সংস্থার কাছে ঋণ পেতে মরিয়া সরকার। সঞ্চয়পত্রের সুদের হার বাড়ানোর মাধ্যমে অভ্যন্তরীণ ঋণ সংগ্রহেরও চেষ্টা চলছে। তবে সাফল্য নেই কোথাও।

সার্বিকভাবে এর প্রভাব পড়েছে দেশের রাজস্ব আয়ে। টাকা জোগাড়ের সহজ পন্থা হিসেবে জনগণের ঘাড়ে চাপিয়ে দেওয়া হয়েছে করের বোঝা।

অর্থবছরের মাঝপথে চলতি বছরের শুরুতেই আইএমএফের প্রেসক্রিপশনে অধ্যাদেশ জারি করে অর্ধশতাধিক পণ্য ও সেবার ওপর ভ্যাট আরোপ করেছিল জাতীয় রাজস্ব বোর্ড (এনবিআর)। পরবর্তী সময়ে আন্দোলনে নামে ব্যবসায়ী, অর্থনীতিবিদ, রাজনীতিবিদ ও ভোক্তারা।

বিশ্লেষকরা বলছেন, এই হঠকারী, অপরিণামদর্শী ও অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত থেকে আংশিক ইউ টার্ন নিতে বাধ্য হয়েছে সংস্থাটি। উচ্চ মূল্যস্ফীতির চাপে ন্যুব্জ গণতান্ত্রিক একটি দেশে এমন সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেওয়াকে সরকারের স্ববিরোধী নীতির সঙ্গে তুলনা করছেন ব্যবসায়ীরা।

ক্ষমতা হারানো আওয়ামী লীগ সরকার উচ্চাভিলাষী রাজস্ব লক্ষ্যমাত্রা দিয়ে গণ-অভ্যুত্থানে গদিছাড়া হলেও তাদের রেখে যাওয়া টার্গেট অনুযায়ী কাঙ্ক্ষিত রাজস্ব আসছে না। বরং রাজস্ব আয় বড় ধরনের ঘাটতির পথে। অর্থবছরের ছয় মাসেই রাজস্ব আয়ে টানাটানি চলছে।

ঘাটতি ছাড়িয়েছে প্রায় ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এমন পরিস্থিতিতে করজাল সম্প্রসারণ না করে উল্টো করের হার বাড়িয়ে আবার কিছু পণ্যে করের হার কমিয়ে অদূরদর্শী সিদ্ধান্ত নিয়েছে অন্তর্বর্তী সরকার।

জানা গেছে, চলতি ২০২৪-২৫ অর্থবছরে আইএমএফ বাংলাদেশকে কর-জিডিপি অনুপাত ০.২ শতাংশ বাড়ানোর শর্ত দিয়েছে। বাড়তি এই টাকা চার লাখ ৮০ হাজার কোটি টাকার সঙ্গে যুক্ত হবে। জুলাই-আগস্টের আন্দোলন ও ব্যবসা-বাণিজ্যে নানা সংকটে রাজস্ব আদায়ে ধস। প্রথম ছয় মাসে রাজস্ব ঘাটতি ৫৮ হাজার কোটি টাকা। এমন অবস্থায় তৃতীয় কিস্তির টাকা পেতেই এই পদক্ষেপ। যদিও এর ফলে আগে থেকেই অস্থির থাকা বাজার আরো অস্থির হয়েছে। বেড়েছে ভ্যাটের সঙ্গে যুক্ত প্রতিটি পণ্য ও সেবার দাম। এতে চরম ভোগান্তিতে পড়েছে দেশের খেটে খাওয়া কোটি মানুষ।

নতুন বছরে বিস্কুট, ওষুধ, আমদানি করা ফল, ফলের রস, সাবান, সাবানজাতীয় পণ্য, পোশাক কেনাকাটা, মিষ্টি, বেশ কয়েক ধরনের টিস্যু, মোটরগাড়ির গ্যারেজ, রেস্তোরাঁ, এলপি গ্যাসের মতো পণ্যে ভ্যাট ও শুল্ক বাড়ানো হয়েছে। সিগারেটে আরেক দফা দাম ও কর বাড়ানো হয়েছে। মোবাইল ফোনের সিম কার্ডের ওপর সম্পূরক শুল্ক ২০ থেকে বাড়িয়ে ২৩ শতাংশ করা হয়েছে। ইন্টারনেট সেবা বা আইএসপির ওপর প্রথমবারের মতো ১০ শতাংশ সম্পূরক শুল্ক বসানো হয়েছে।

পরে আন্দোলনের মুখে রেস্তোরাঁ, মোবাইল ফোন, ওয়ার্কশপ, ওষুধসহ ৯ পণ্য ও সেবার বাড়তি ভ্যাট প্রত্যাহার করে প্রজ্ঞাপন জারি করেছে এনবিআর। যদিও আন্দোলনের জেরে এই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়নি বলে জানিয়েছেন এনবিআরের একজন ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তা। নাম প্রকাশ না করার শর্তে তিনি বলেন, ‘আইএমএফ সরকারকে অতিরিক্ত রাজস্ব আদায়ের শর্ত দিয়েছে। এ ক্ষেত্রে আইএমএফের সঙ্গে বসেই আমরা নীতি প্রণয়ন করেছি। সরকার তাতে সম্মত হয়েছে। উপদেষ্টা পরিষদ থেকেও কিছু সিদ্ধান্ত দেওয়া হয়েছে। আন্দোলনের কারণেই ভ্যাট প্রত্যাহার করা হয়েছে, তা ঠিক নয়। বিভিন্ন কারণে সব কিছু বিবেচনায় নিয়ে সরকারের মনে হয়েছে যে কয়েকটি পণ্যের ওপর ভ্যাট সমন্বয় করা প্রয়োজন। তখন এই কাজগুলো করা হয়েছে। ’

যদিও ব্যবসায়ীদের অভিযোগের তীর এনবিআরের দিকে। এনবিআরের সমালোচনা করে বাংলাদেশ রেস্তোরাঁ মালিক সমিতির মহাসচিব ইমরান হাসান বলেন, ‘সব সময়ই এনবিআর এ ধরনের কাজগুলো করে। অংশীজনদের সঙ্গে আলোচনা করার কোনো প্রয়োজন তারা অনুভব করে না। এসি চেয়ারে বসে যদি তারা একটা সিদ্ধান্ত চাপিয়ে দেয় তাহলে সেটা ব্রিটিশ জমিদারি প্রথার মতোই হয়ে গেল। গণতান্ত্রিক দেশে এটা হওয়ার কথা নয়। আমলাতন্ত্রের কালো থাবা ও চরম অব্যবস্থাপনার কোনো সীমারেখা নেই, তা আবারও স্পষ্ট হলো। এই সরকারকে একটা জটিল পরিস্থিতির মধ্যে ফেলে দেওয়ার জন্যই এসব করা হয়েছে। ’

টাকা জোগাড়ে ভ্যাট বাড়িয়ে পরে আবার চাপের মুখে ভ্যাট কমানোর প্রসঙ্গে জানতে চাইলে বিশ্বব্যাংকের ঢাকা কার্যালয়ের সাবেক মুখ্য অর্থনীতিবিদ ড. জাহিদ হোসেন বলেন, ‘কোনো ধরনের প্রভাব পর্যালোচনা করা হয়নি। খুবই তড়িঘড়ি করে এসব করা হয়েছে। বিভিন্ন ধরনের পণ্যের ওপর ভ্যাট বাড়ানো হলে সেটার যে একটা পুশব্যাক আসবে তা বোঝার জন্য কোনো বিজ্ঞানী হওয়ার প্রয়োজন নেই। এটা তো সাধারণ জ্ঞান প্রয়োগ করেই বোঝা যায়। এই অর্থবছরেই রাজস্ব আদায় বাড়ানোর একটা চাপ ছিল আইএমএফের পক্ষ থেকে, কিন্তু এখানে আরো নেগোসিয়েশন করা যেত। ’

বিএনপির ভাইস চেয়ারম্যান ও এফবিসিসিআইয়ের সাবেক সভাপতি আবদুল আউয়াল মিন্টু বলেন, ‘রাজনীতি ও অর্থনীতি দুটি বিষয়কে আলাদা করা যাবে না। একটা দেশে যদি রাজনীতি ভালো না হয়, সেই দেশে কখনোই অর্থনীতি ভালো হয় না। ব্যবসা-বাণিজ্যের প্রসার, বিনিয়োগ বৃদ্ধি তথা সার্বিক অর্থনীতির পরিস্থিতির উন্নতির জন্য রাজনৈতিক পরিস্থিতি গুরুত্বপূর্ণ। সবাই সামনে তাকিয়ে আছে, সামনে যে দেশের রাজনীতির কী হবে। ’

তিনি বলেন, ‘অর্থনীতির এই নাজুক পরিস্থিতিতে নতুন করে ভ্যাট ও কর চাপিয়ে দেওয়া অনুচিত। এ অবস্থা থেকে উত্তরণ করতে হলে ব্যবসায়ীদের ওপরে নতুন করে কোনো বোঝা চাপানোর সুযোগ নেই। মূল্যস্ফীতি কমাতে সরকার যে নীতিতে চলছিল সেখান থেকে ভ্যাট আরোপ করা স্ববিরোধী। ’

সূত্র: কালের কণ্ঠ

বাংলাদেশ সময়: ০৯২৩ ঘণ্টা, জানুয়ার ২৬, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।