ঢাকা, শনিবার, ১ চৈত্র ১৪৩১, ১৫ মার্চ ২০২৫, ১৪ রমজান ১৪৪৬

অন্যান্য

সেলাই করা খোলা মুখ

জাগো মাঠ প্রশাসন, ‘কুণ্ঠে বাহে?’...

নিউজ ডেস্ক | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১১৩০ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫
জাগো মাঠ প্রশাসন, ‘কুণ্ঠে বাহে?’...

গত কিছুদিন ধরে দৈনিক পত্রিকাগুলোর পাতায় খুন-ধর্ষণ-ছিনতাই-লুণ্ঠন-দখলবাজি-চাঁদাবাজি ইত্যাদির সংবাদ এত বেশি আসছে যে একটি সংবাদপত্রকে সব ধরনের সংবাদ পরিবেশনের মাধ্যম না বলে অপরাধজগতের মুখপত্র বললে মনে হয় খুব একটা অতিশয়োক্তি হবে না। অবশ্যই পাঠক দেশ-বিদেশের নানা গুরুত্বপূর্ণ সংবাদ জানার জন্যই রোজ সকালে খবরের কাগজের জন্য চাতক পাখির মতো অপেক্ষা করতে থাকেন।

কেউ নিশ্চয়ই কোথায় কোন শিশু ধর্ষণের শিকার হয়েছে, সড়ক দুর্ঘটনায় একই পরিবারের চারজন কোথায় মর্মান্তিকভাবে মৃত্যুবরণ করেছে, কন্যাদায়গ্রস্ত কোন পিতা ছিনতাইকারীর হাতে তাঁর সর্বস্ব খুইয়ে পথে বসেছেন—এই সব হৃদয়বিদারক সংবাদ পাঠের জন্য গাঁটের পয়সা খরচ করে পত্রিকা কেনেন না।

সারা দেশে অপরাধপ্রবণতা হঠাৎ করেই অনেকটা বেড়ে যাওয়ার কারণ হিসেবে অনেকেই আইনশৃঙ্খলা রক্ষাকারী বাহিনীর দিকে অঙ্গুলি নির্দেশ করছেন।
গত বছরের জুলাই-আগস্টের ঘটনাবলির সময় পুলিশ বাহিনী যে বেসামাল অবস্থায় নিপতিত হয়েছিল তাতে তার মাঠ পর্যায়ের সদস্যরা বোধগম্য কারণেই মনোবল হারিয়ে দিশেহারা হয়ে পড়েছিল। সরকারের দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়ার ফলে এবং ওই বাহিনীর শীর্ষ পর্যায়ের কর্মকর্তাদের দৃঢ়তার কারণে পরিস্থিতির যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে। যেকোনো সুশৃঙ্খল বাহিনীর মূল চালিকাশক্তি তার ‘মরাল’ বা মনোবল। মনোবলে চিড় ধরা মানে একটি অস্ত্রশস্ত্রে সুসজ্জিত বাহিনীর পঙ্গুত্ববরণ করা।

বিগত সরকার পুলিশ বাহিনীর মতো একটি বেসামরিক বাহিনীকে নিরীহ নিরস্ত্র জনগণ নিধনে ব্যবহার করায় ওই বাহিনীর মনোবল শূন্যের কোঠায় পৌঁছে গিয়েছিল। যাক, স্বস্তির বিষয়, পরিস্থিতির এখন যথেষ্ট উন্নতি হয়েছে।

দেশে আইনশৃঙ্খলা নিয়ে যেকোনো আলোচনার কেন্দ্রবিন্দুতে যা থাকবে তা, আমার বিবেচনায়, দেশের মাঠ প্রশাসন। ভালো-মন্দ যাই হোক, আমাদের দেশের মাঠ প্রশাসন (এবং সামগ্রিকভাবে সমগ্র শাসনব্যবস্থা) চলছে প্রায় পৌনে তিনশ বছর আগে ব্রিটিশরাজ প্রবর্তিত বিধিব্যবস্থামত।

ব্রিটিশরাও তাদের পূর্বসূরী মোগলদের শাসনকাঠামোই মোটামুটি খোল-নলচে পাল্টে বহাল রেখেছিল। দেশ শাসিত হতো কেন্দ্রীয় সরকার কর্তৃক নিয়োজিত কর্মচারীদের দ্বারা। ফলে ব্রিটিশরা যে জেলা, মহকুমা বা থানা ইত্যাদি যেভাবে রেখে গিয়েছিল ১৯৪৭ সালে তাদের বিদায়ের কালে, সেগুলো মোটামুটি সেভাবেই কিছু কিছু নাম-ধাম পরিবর্তন-পরিমার্জন করে এখনো সেভাবেই আছে। তখনো মাঠ প্রশাসনের কেন্দ্রবিন্দু ছিল জেলা, এখনো তাই আছে। তখন জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বে যে ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট ছিলেন, এখনো তিনিই আছেন।

শুধু নাম বদলিয়ে এখন তিনি হয়েছেন ডেপুটি কমিশনার। বাংলায় বলা হয় জেলা প্রশাসক। একটি জেলার সার্বিক দায়িত্বে আছেন তিনি। তাঁর মৌলিক দায়িত্ব হচ্ছে ভূমি প্রশাসন ও ভূমি রাজস্ব আদায়, জেলার আইনশৃঙ্খলা নিয়ন্ত্রণ এবং সব ধরনের উন্নয়ন কর্মকাণ্ডে সমন্বয়কের ভূমিকা পালন। সব কিছু মিলিয়ে তিনি সংশ্লিষ্ট জেলায় সরকারের প্রতিনিধি। তাঁকে বলা হয় ‘সিম্বল অব অ্যাডমিনিস্ট্রেশন,’ বা প্রশাসনের প্রতীক। ফলে জেলার কোথাও কোনো ঘটনা-দুর্ঘটনা ঘটলে সরকারের উপরিমহলে প্রথমেই খোঁজ পড়ে তাঁর। তাঁর বক্তব্যই হয় সরকারি বক্তব্য। বিশেষ করে আইনশৃঙ্খলাজনিত বা রাজনৈতিক বিষয়াদি নিয়ে তাঁর ভূমিকা আবহমানকালের।

পাকিস্তানি আমলে ষাটের দশকে একটি মহকুমা (বর্তমান ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা), তৎকালীন পশ্চিম পাকিস্তানে দুটি মহকুমা, বাংলাদেশের তিনটি বৃহত্তর জেলা (কুষ্টিয়া, খুলনা ও ঢাকা) এবং রাজশাহী বিভাগের বিভাগীয় কমিশনারের দায়িত্বপালনের অভিজ্ঞতা থেকে মাঠ পর্যায়ে আইনশৃঙ্খলা পরিস্থিতি নিয়ে দুটি কথা বলার জন্য আজকের এই নিবন্ধ। গোড়াতেই বলে রাখতে চাই সম্প্রতি মাগুরার একটি শিশু ধর্ষণের (মেয়েটি গত বৃহস্পতিবার মারা গেছে। ইন্না লিল্লাহি ওয়া ইন্না ইলাইহি রাজিউন) ঘটনায় দেশব্যাপী যে তুমুল বিক্ষোভের ঝড় বইছে তা খুবই স্বাভাবিক। বিশেষ করে আমাদের স্কুল-কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ের সন্তানতুল্য তরুণ শিক্ষার্থীরা বারবার যেভাবে জাতির বিবেক ধরে নাড়া দিচ্ছে তাতে আমি অন্তত আশাবাদী, এই দেশে বৈষম্য থাকবে না, অন্যায় করে কেউ পার পাবে না, দেশে আইনের শাসন অতি শীঘ্র প্রতিষ্ঠিত হবে। তবে একটি কথা আন্দোলনকারীদের মনে রাখতে হবে, কোনো অপরাধীকে পাকড়াও করা, তাকে আইনের আওতায় আনা, নারী নির্যাতন, ধর্ষণ, ছিনতাই ইত্যাদি বন্ধ করার প্রাথমিক দায়িত্ব কিন্তু কোনো মন্ত্রী, সচিব বা বিভাগীয় বড় কর্তার নয়—এই দায়িত্ব মাঠ পর্যায়ে কর্মরত কর্মকর্তা-কর্মচারীর। অতএব ঢাকায় নীতিনির্ধারণকারী কোনো মন্ত্রী, সচিব বা বিভাগীয় বড় কর্তার পদত্যাগ দাবি করা যুক্তিসঙ্গত নয়। তবে হ্যাঁ, তাঁদের কাছে অবশ্যই দাবি জানানো যেতে পারে। তাতে সংশ্লিষ্ট বিভাগের টপ-টু-বটম সকলেরই টনক নড়বে সন্দেহ নেই।

এখন আসুন মাঠ পর্যায়ে কী ঘটছে, বা সব সময় কী ঘটে থাকে তা একটু নাড়াচাড়া করে দেখা যাক। মনে রাখা দরকার, একটি এলাকার চোর-চোট্টা-বদমাশ-ধর্ষকরা, ইভ টিজাররা, সব সময় চোখ-কান খোলা রেখে এলাকার ও.সি., এস.পি, ডি.সি., ইউএনও ইত্যাদি কর্মকর্তার গতিবিধি ও কার্যকলাপ মনিটর করে। যদি দেখে এদের একজনের সঙ্গে আরেকজনের সদ্ভাব নেই, একজনের কাজকর্মের সঙ্গে অন্যজনের কাজকর্মের সমন্বয়ের অভাব, কিংবা তাঁরা ব্যস্ত নিজের পকেটপূর্তিতে বা ‘স্যারের’ জন্য চাঁদা তুলতে, অথবা কোনো নেতার তাঁবেদারি করতে, তখন তারা বগল বাজিয়ে নেমে পড়ে যাবতীয় কুকর্মে। অপরাধীরা ঠিকই লাইন বের করে ফেলে চুরি-ডাকাতি-ধর্ষণ ইত্যাদি যেকোনো অপরাধ করে কী করে নির্বিঘ্নে বেরিয়ে যেতে হবে।

এখানে দু-একটি মৌলিক বিষয়ের উল্লেখ করতেই হয়। জেলার আইনশৃঙ্খলা, অপরাধ দমন ইত্যাদির সার্বিক দায়িত্বে নিয়োজিত প্রধান দুই কর্মকর্তা—ডি.সি. এবং এস.পি.—সারাক্ষণ জনসাধারণের নজরদারিতে আছেন, এটা ভুলে গেলে চলবে না। অতএব তাঁরা অফিসে এবং অফিসের বাইরে ব্যক্তিগত জীবনে পরস্পর পরস্পরের প্রতি বন্ধুত্বপূর্ণ বা ভ্রাতৃত্বসুলভ আচরণ করেন, নাকি ‘আমি কী হনু রে’, ‘ও আবার কে?’ ইত্যাদি মার্কা ব্যবহার ফুটে ওঠে তাঁদের কথায়-বার্তায়, চলনে-বলনে তা সব সময় পাবলিক লক্ষ্য করে। যেকোনো সমস্যায় বা গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ে ডি.সি.-এস.পি. ঘন ঘন নিজেদের মধ্যে আলাপ-আলোচনা করে সিদ্ধান্ত নিলে সেটা বাস্তবায়ন করা সহজ হয়। একই কথা বলা যায় ইউএনও-ও.সি.-র বেলায়ও। অন্যথায় নিজ নিজ অফিসের অধস্তন কর্মকর্তা-কর্মচারী আদেশপালনে বা সিদ্ধান্ত বাস্তবায়নে গড়িমসি করবে।

আরেকটি কথা। ডি.সি.-এস.পি.-র জনসংযোগ। জনপ্রশাসনের কর্মকর্তা ডি.সি. বা এস.পি. জেলার জনপ্রতিনিধিদের সাহায্য-সহযোগিতা-পরামর্শ ব্যতীত কখনোই সফল হতে পারবেন না। মনে রাখতে হবে, জনপ্রতিনিধি ওই এলাকার মানুষ, সান অব দ্য সয়েল, যে কারণে এলাকা, এলাকার মানুষ, সমস্যা ও তার সমাধান সম্বন্ধে তাঁর কিছু বিশেষ জ্ঞান থাকার কথা, যা আপনার নেই। কাজেই আপনি ডি.সি. বা এস.পি.যেই হোন না কেন অনেক সময় প্রকৃত তথ্য জানার জন্য, অথবা যেকোনো বিষয়ে জনসমর্থন লাভের জন্য স্থানীয় কোনো সর্বজন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তির—তিনি কোনো স্কুলের শিক্ষক, রাজনৈতিক নেতা, ব্যবসায়ী বা ভূস্বামী হতে পারেন—সাহায্য নিতে পারেন। তবে লক্ষ্য রাখতে হবে, কোনো টাউট-বাটপাড় যেন এই সুযোগে কাছে ভিড়তে না পারে। কুষ্টিয়ায় ১৯৭৪ সালে আমি যখন ডি.সি. হিসেবে যোগদান করি তখন সন্ত্রাসী কর্মকাণ্ডে কুষ্টিয়ায় বলা যায় দাবানল জ্বলছিল। আমার কাজ ছিল বিশেষ বিশেষ এলাকায় গিয়ে জনসাধারণকে সন্ত্রাসের বিরুদ্ধে সংঘবদ্ধ করা। গ্রামে গ্রামে মিটিং করতাম রাজনৈতিক নেতাদের মত। আমার বক্তৃতায় সদ্য স্বাধীন দেশকে ভালবাসা, তার উন্নয়নে কাজ করা, ঐক্যবদ্ধভাবে শান্তি-শৃঙ্খলার পক্ষে থাকার কথা বলতাম। এসব কাজে কুষ্টিয়ার সেই সময়ের রাজনৈতিক নেতাদের সাহায্য-সহযোগিতা খুবই কাজে লেগেছিল। আল্লাহর ইচ্ছায় তিন-চার মাসের মধ্যে সন্ত্রাসের আগুন নেভাতে সমর্থ হয়েছিলাম আমরা।

আরেকটি কথা। ডি.সি., এস.পি. এবং জেলার সব সিনিয়র কর্মকর্তাকে তাঁদের সকল কাজে সততার পরিচয় দিতে হবে। তবেই তাঁদের বিভিন্ন কাজেকর্মে জনসমর্থন পাওয়া যাবে। আর জনসমর্থন ব্যতীত কোনো উদ্যোগ-আয়োজনই সাফল্যের মুখ দেখবে না।

শেষ কথা, একটি আকুতি। ডি.সি.-এস.পি.-রা কি জাতির এই মাহেন্দ্রক্ষণে জুলাই-আগস্টের চেতনায় উদ্বুব্ধ হয়ে মাঠ প্রশাসনকে গণমুখী করতে পারেন না? পারেন না ক্রমবর্ধিষ্ণু মারাত্মক অপরাধগুলোর মূলোত্পাটন করতে? ঐক্যবদ্ধ প্রয়াসে এর অনেকখানিই সম্ভব বলে আমি—তোমাদের এই বরিষ্ঠ সাবেক সহকর্মী—মনে করি। মাঠ প্রশাসনের এই দুই ভ্রাতৃপ্রতিম সহকর্মী হাতে হাত মিলিয়ে, কাঁধে কাঁধ মিলিয়ে আইনশৃঙ্খলার পাগলা ঘোড়াকে নিশ্চয়ই অতি দ্রুত বাগে আনতে পারবে এ প্রত্যাশা শুধু আমার নয়, সমগ্র জাতির।

লেখক : সাবেক সচিব, কবি
[email protected]

বাংলাদেশ সময়: ১০৪৬ ঘণ্টা, মার্চ ১৫, ২০২৫

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।