গোপন কৌশলের কারণে বিভাজন, ছদ্মবেশ আর স্বার্থপুষ্ট উদ্দেশ্য অব্যাহত থাকে, তাহলে সমাজ, রাজনীতি এবং আইনের শাসনই ধ্বংসের মুখে পড়বে। মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করবে, সম্পর্ক ও ঐক্য ভাঙবে; বিশ্ববিদ্যালয় ও শিক্ষাঙ্গনে ভবিষ্যৎ নেতৃত্বের নৈতিকতা ও বুদ্ধিমত্তা ঝুঁকিতে পড়ে যাবে।
স্বাধীন বাংলাদেশে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থানে ছাত্র-জনতাকে নতুন করে রক্ত দিতে হয়। দেড় হাজারের বেশি মানুষ শহীদ হন—সমতা, গণতন্ত্র, ভোটের অধিকার, ন্যায়বিচার, আইনের শাসন এবং মানবাধিকারের জন্য। এ এক করুণ বাস্তবতা—যেখানে রাষ্ট্র আবারও প্রশ্নের মুখে পড়ে; স্বাধীনতা কি শুধুই রাজনৈতিক ক্ষমতা বদলের নাম, নাকি একটি মানবিক, গণতান্ত্রিক, সাম্যভিত্তিক রাষ্ট্র ও সমাজের প্রতিশ্রুতি?
তারেক রহমান বলেছেন, ‘লাখো প্রাণের বিনিময়ে ১৯৭১-এর স্বাধীন বাংলাদেশ, পঁচাত্তরের ৭ নভেম্বরের আধিপত্যবিরোধী তাঁবেদারমুক্ত বাংলাদেশ, নব্বইয়ের স্বৈরাচারবিরোধী বাংলাদেশ এবং ২০২৪-এর ফ্যাসিবাদবিরোধী বাংলাদেশ। বাংলাদেশের ইতিহাসে এমন প্রতিটি বাঁকে মানুষ কেন অকাতরে জীবন দিয়েছিলেন? কী ছিল এই শহীদদের স্বপ্ন? তাঁরা কেমন বাংলাদেশ চেয়েছিলেন? একজন রাজনৈতিক কর্মী হিসেবে এসব প্রশ্নের জবাব খোঁজার জন্য ৫৪ বছর সময় খুব বোধ হয় কম সময় নয়, এ জন্যই আমি মনে করি, শুধু শহীদদের আত্মত্যাগকে শ্রদ্ধার সঙ্গে স্মরণের মধ্য দিয়েই রাজনৈতিক কর্মী বা নেতা হিসেবে আমাদের দায়িত্ব বোধ হয় শেষ হয়ে যায় না।
শহীদদের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার মাধ্যমেই কেবল আমরা তাঁদের সুমহান আত্মত্যাগের প্রতিদান দেওয়ার চেষ্টা করতে পারি। বাংলাদেশের ৫৪ বছরের ইতিহাসের সবচেয়ে দুটি গুরুত্বপূর্ণ অর্জন—১৯৭১ সাল ছিল বাংলাদেশের স্বাধীনতা অর্জনের, ২০২৪ সাল ছিল দেশ ও জনগণের স্বাধীনতা রক্ষার। ’
গণতন্ত্রের অন্যতম ভিত্তি হলো স্বচ্ছতা ও জবাবদিহি। জনগণকে অন্ধকারে রেখে, আড়ালে-আবডালে সিদ্ধান্ত নেওয়া রাজনীতিকে গোষ্ঠীনির্ভর করে তোলে; জনগণনির্ভর নয়।
এই প্রেক্ষাপটে ডাকসু ও জাকসু নির্বাচনের ক্ষেত্রে প্রশাসন ছাত্রশিবিরকে সক্রিয়ভাবে নির্বাচিত করার চেষ্টা চালিয়েছে—এখন এটি জনগণের কাছে একটি ‘ওপেন সিক্রেট’ বিষয়। সচেতন শিক্ষার্থীরা আগেই বলেছিলেন, বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন গুপ্ত রাজনীতির কৌশলী শাখা হিসেবে কাজ করছে। এতে গণতান্ত্রিক ক্যাম্পাস এবং শিক্ষার্থীদের সার্বিক বিকাশ বাধাগ্রস্ত হচ্ছে।
ইসলামের ইতিহাস অনুযায়ী, প্রিয় নবী হজরত মুহাম্মদ (সা.) কখনো গুপ্ত রাজনীতি করেননি। তাঁর জীবন ছিল স্বচ্ছ, নৈতিক ও খোলামেলা নেতৃত্বের এক অনন্য দৃষ্টান্ত।
নবী (সা.) কখনো জনগণের সামনে গোপন উদ্দেশ্য আড়াল করেননি। যুদ্ধ ও কূটনীতি; যেমন—বদর, উহুদ, খন্দক, বনুকুরা, বনুমুস্তালিক, মা’তা, ফতহমক্কা, হুনাইন, তাঈফ অভিযান ও তাবুক অভিযান—সবই মূলত আত্মরক্ষা, সীমান্ত নিরাপত্তা, ন্যায় প্রতিষ্ঠা ও জনগণের নিরাপত্তার জন্য স্পষ্টভাবে পরিচালিত হয়েছিল। হুদাইবিয়ার চুক্তিসহ সব কৌশল সর্বদা প্রকাশ্য ও স্বচ্ছ ছিল। উম্মাহকে পরামর্শ ও শুরার মাধ্যমে অংশগ্রহণের সুযোগ দেওয়ার এই দৃষ্টান্ত স্পষ্ট করেন। নবীর নেতৃত্বে মূলভিত্তি ছিল সত্যবাদিতা, ন্যায়পরায়ণতা এবং মানবিক মর্যাদা।
গুপ্ত রাজনীতি ষড়যন্ত্র, বিভাজন ও সহিংসতা জন্ম দেয়, মানুষের মধ্যে অবিশ্বাস সৃষ্টি করে। গুপ্ত রাজনীতিক কখনোই প্রকাশ্য বিতর্ক বা মতাদর্শিক প্রতিযোগিতার মাধ্যমে গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়ায় কাজ করেন না, বরং ছদ্মবেশ, অনুপ্রবেশ ও অপকৌশলের মাধ্যমে নিজেদের প্রভাব বিস্তার করেন। ১৬ বছর ধরে বিশ্ববিদ্যালয়, সাংস্কৃতিক ও সামাজিক সংগঠনের মধ্যে প্রবেশ করে শিক্ষাঙ্গনকে বিভাজন, ভয় ও সহিংসতার পরিবেশে নিমজ্জিত করেছে আওয়ামী ছাত্রলীগ। জামায়াত-শিবির ও অন্যান্য গুপ্ত নেটওয়ার্ক কেবল ঢাকায়ই নয়, দেশের বিভিন্ন কলেজ-বিশ্ববিদ্যালয়ে গুপ্ত কার্যক্রম অব্যাহত রেখেছে। তারা নিজেদের আসল পরিচয় লুকিয়ে, কখনো বিতার্কিক, কখনো ক্রীড়া সংগঠক, সাধারণ শিক্ষার্থী বা ছাত্রলীগের কোনো পরিচয় ধারণ করে সাংগঠনিক কার্যক্রম পরিচালনা করেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে তারা আসল পরিচয়ে আবর্তিত হলেও পুরনো সম্পর্কগুলো প্রভাবশালী হয়ে থেকে যায়। বিগত ফ্যাসিস্ট রিজিমের সময়ে যারা ক্যাম্পাস নিয়ন্ত্রণ করেছে, তাদের কর্মীরাও আশ্রয় পেতে থাকে। এভাবেই ক্যাম্পাসগুলোতে গুপ্ত রাজনীতি প্রকাশ্যে আসে। ফলে স্বচ্ছ নির্বাচন, শিক্ষার্থীদের অংশগ্রহণমূলক রাজনীতি এবং গণতান্ত্রিক নেতৃত্বের বিকাশ এক ধরনের ধ্বংসের মুখোমুখি হয়।
মুক্তিযুদ্ধের সময় যারা বিশ্বাসঘাতকতা করেছে, তারা আজও আনুষ্ঠানিকভাবে ক্ষমা চায়নি। রাজনীতিতে কোনো অনুশোচনা নেই; একাত্তরের সেই কালো অধ্যায়ের ধারাবাহিকতাই তাদের আরো জোরালো করেছে। কয়েক মাস আগে ছাত্রশিবির তাদের নিজস্ব পত্রিকায় মুক্তিযুদ্ধের ইতিহাস বিকৃত করে নিবন্ধ প্রকাশ করে, যেখানে মুক্তিযুদ্ধকে অবমাননার চেষ্টা করা হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে প্রবল প্রতিবাদের মুখে শেষ পর্যন্ত ছাত্রশিবিরকে তাদের ভুল স্বীকার করতে বাধ্য হতে হয়। আগস্ট মাসে তারা মুক্তিযুদ্ধবিরোধী চিহ্নিত রাজাকারদের ‘শহীদ’ ও জাতীয় বীরের পরিচয় দিয়ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের টিএসসিতে প্রদর্শনীও করে। শিক্ষার্থীসমাজ এবং বামপন্থী ছাত্রসংগঠনের তীব্র প্রতিবাদে বিশ্ববিদ্যালয় প্রশাসন শেষ পর্যন্ত সেই কলঙ্কজনক প্রদর্শনী সরাতে বাধ্য হয়।
জামায়াত-শিবিরের রাজনীতি মূলত সুযোগ ও সুবিধার জন্য; তারা নারীমুক্তি, সমান অধিকার বা প্রগতিশীল রাজনীতিতে বিশ্বাসী নয়। একাত্তরকে চব্বিশ দিয়ে ঢেকে দিতে চায় তারা। মূলত একাত্তর ও চব্বিশ আলাদা বিষয়। একটির সঙ্গে আরেকটির তুলনা করার কোনো যৌক্তিকতা নেই। যুক্তিবাদী চিন্তা-ভাবনা, ভিন্ন ধর্ম ও সংস্কৃতির স্বাধীনতা, সমান অধিকার ও বৈচিত্র্যে তারা বিশ্বাস করে না। তারা একটি একরঙা, বৈচিত্র্যবিহীন, রুদ্ধ সমাজের স্বপ্ন দেখে, যা বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধের চেতনা, স্বাধীনতার মর্যাদা, চব্বিশের গণ-অভ্যুত্থানের চেতনা ও সবার বাংলাদেশ দর্শনের সঙ্গে সরাসরি সাংঘর্ষিক। গুপ্ত রাজনীতি, অপরাজনীতি কোনোভাবেই গণতান্ত্রিক দেশের জন্য ভালো হতে পারে না।
এই প্রজন্মকে এই গুপ্ত রাজনীতির অপকৌশল থেকে নিজেদের বুদ্ধিমত্তা ও প্রজ্ঞা দিয়ে মোকাবেলা করতে হবে। একাত্তর আমাদের পরিচয়, আমাদের অস্তিত্ব—এটি স্বীকার করে ব্যর্থতাগুলোকে সফলতায় রূপ দিতে চব্বিশ তৈরি হয়েছে। অর্থাৎ একাত্তরকে রক্ষার জন্যই এই প্রজন্ম চব্বিশে সর্বোচ্চ ভূমিকা পালন করেছে। শিবিরের গুপ্ত অপকৌশলকে নিরর্থক করার শক্তি এই প্রজন্মের মধ্যে নিহিত। তারা যথাসময়ে সঠিক জবাব দিয়ে দেয়।
বাংলাদেশের রাজনীতির অঙ্গন আজ এক গভীর চক্রান্ত ও পরিবর্তনের মধ্য দিয়ে যাচ্ছে। বিশেষ করে তরুণ প্রজন্ম ১৬ বছর ধরে এক নিষ্ঠুর স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদের নির্মম বাস্তবতার মুখোমুখি হয়েছে। তবু সেই স্বৈরশাসন ও ফ্যাসিবাদ উত্খাতের মূল ভূমিকায় ছিল তারা। আগামী সংসদ নির্বাচনে তরুণ ভোটারের সংখ্যা প্রায় অর্ধেক, যাঁদের জীবনদান ও লড়াইয়ের কারণে আজ বাংলাদেশ ফ্যাসিবাদমুক্ত। এই প্রজন্মই আগামী দিনের রাজনীতির ভবিষ্যৎ নির্ধারণ করবে। তাদের স্বচ্ছ, জবাবদিহিমূলক এবং ন্যায়পরায়ণ নেতৃত্বই ভবিষ্যতের গণতন্ত্রকে শক্তিশালী করবে।
রাজনৈতিক দলগুলোর উচিত জনগণের ইচ্ছা ও আকাঙ্ক্ষার ভিত্তিতে অন্তর্ভুক্তিমূলক, ন্যায়ভিত্তিক ও সমৃদ্ধ বাংলাদেশ গঠন করা। মুক্তিযুদ্ধের আদর্শ বাস্তবায়নে ২০২৪ সালের গণ-অভ্যুত্থান নতুন আশা সঞ্চার করেছে, যা দেশের রাজনৈতিক চেতনায় নতুন মাত্রা যুক্ত করেছে। এই চেতনাকে ধারণ করেই বেশির ভাগ রাজনৈতিক দল এগিয়ে চলেছে। তাদের কর্মসূচি জনগণের মৌলিক চাহিদা, অধিকার ও স্বপ্ন বাস্তবায়নের একটি সুস্পষ্ট রূপরেখা দিচ্ছে। রাষ্ট্র ও রাজনীতির কাঠামো পরিবর্তন, গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার, মানবাধিকার প্রতিষ্ঠা, অর্থনৈতিক মুক্তি ও সামাজিক সুরক্ষা—প্রতিটি ক্ষেত্রে এই কর্মসূচি নতুন জীবনব্যবস্থার সূচনা করতে চায়।
একাত্তরের স্বাধীনতার স্বপ্ন এবং চব্বিশের পরিবর্তনের অঙ্গীকার—এই দুই সময়ের একটি শক্তিশালী সেতুবন্ধ তৈরি হবে। এটি এক ঐতিহাসিক দায়িত্ব এবং প্রজন্মান্তরের আশাপূরণের সংকল্প বাস্তবায়ন করতেই হবে।
লেখক : রাজনৈতিক বিশ্লেষক ও যুগ্ম সম্পাদক, কালের কণ্ঠ