ঢাকা, বুধবার, ৫ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২০ নভেম্বর ২০২৪, ১৮ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম বাণিজ্য বাড়লেও বাড়েনি রপ্তানি 

এ কে এস রোকন, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৫০৩ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২৩
চাঁপাইনবাবগঞ্জে আম বাণিজ্য বাড়লেও বাড়েনি রপ্তানি 

চাঁপাইনবাবগঞ্জ: গত কয়েক বছরের তুলনায় এবার আমের দাম ভালো মিলছে ‘আমের রাজধানী’ চাঁপাইনবাবগঞ্জে। ফলে লাভের মুখ দেখছেন আম বিক্রেতারা।

সংশ্লিষ্টরা বলছেন, কানসাট, চাঁপাইনবাবগঞ্জের শিবগঞ্জ উপজেলার এ বাজার দেশের সবচেয়ে বড় আমের বাজার। যেখানে প্রতিদিন প্রায় ৪০ কোটি টাকার আম বেচাকেনা হচ্ছে।  

এ বছর জেলায় আম বিক্রি বাড়লেও রপ্তানি বাড়েনি। করোনার প্রভাবসহ বিভিন্ন জটিলতা কাটিয়ে এবার মোটামুটি ভালো দামেই বিক্রি হচ্ছে আম। এতে বাগান মালিক ও ব্যবসায়ীরা খুশি থাকলেও রপ্তানি না বাড়ায় হতাশা রয়েছে।  

বাজার ঘুরে দেখা গেছে, এবার উচ্চ আদালতের নির্দেশে প্রশাসনিক নজরদারির কারণে পরিপক্ব ও বিষমুক্ত আমই বাজারজাত হচ্ছে এবং দামও ভালো পাওয়া যাচ্ছে। আম বেচাকেনাকে কেন্দ্র করে চাঙা হয়ে উঠেছে নানা ধরনের ব্যবসা কার্যক্রম।  

দেশের বৃহত্তম আমের বাজার কানসাট ঘুরে দেখা গেছে, মান অনুযায়ী খিরসাপাত ২ হাজার ৫০০ থেকে ৩ হাজার ৫০০ টাকায়, ল্যাংড়া ১ হাজার ৫০০ থেকে আড়াই হাজার, লক্ষণভোগ ৮০০ থেকে ৯০০ টাকা এবং গুটিসহ অন্যান্য জাতের আম দেড় হাজার টাকা মণ বিক্রি হচ্ছে।  

কানসাট বাজারে আম বিক্রি করতে আসা শ্যামপুর ইউনিয়নের বাবুপুর গ্রামের বাসিন্দা রায়হান আলী বলেন, এবার আমের দাম তুলনামূলক ভালো। জলবায়ুর প্রভাবে এ বছর দেরিতে আম উঠলেও অতিরিক্ত গরমে এবার বিভিন্ন জাতের আম দ্রুত পেকে যাচ্ছে। চিন্তায় আছি, সব মিলিয়ে লাভ হবে কি না।  

শাহবাজপুর এলাকার আমচাষি ইসরাঈল বলেন, গত কয়েক বছর ধরেই আমে লোকসান গুণছি। এবার লাভবান হতে পারব কি না বলতে পারছি না। কারণ সব কিছুর দাম বেড়েছে। একজন শ্রমিকের মজুরি গত বছর ছিল ২৫০ টাকা, এবার ৪০০ টাকা। যে কীটনাশক আগে ৮০০ টাকায় কিনেছি, এবার তা কিনতে হচ্ছে ১ হাজার ২০০ টাকায় এবং বিদ্যুতের দাম বাড়ায় আর খরার কারণে পানি সেচে খরচ বেড়েছে দ্বিগুণ।  

এদিকে চলতি মৌসুমে ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আম বাণিজ্যের আশা করছে কৃষি বিভাগ। আবহাওয়া অনুকূলে থাকলে উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়ে যেতে পারে বলে ধারণা করছে জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর। তবে বেসরকারি সংস্থাগুলো বাণিজ্যের আশা করছে আরও বেশি।  

কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য অনুযায়ী, ২০০৭ সালে এখানে আম চাষ হতো ২১ হাজার ৮০০ হেক্টর জমিতে। ২০২৩ সালে এসে তা দাঁড়িয়েছে ৩৮ হাজার হেক্টরে। ১৫ বছরে আম চাষের জমি বেড়েছে প্রায় ১৬ হাজার হেক্টর। জমি বাড়ার পাশাপাশি আম চাষে চাষিরা আরও আন্তরিক হওয়ায় উৎপাদন যেমন বেড়েছে, তেমনি বাণিজ্যও বাড়ছে।  

কৃষি বিভাগ আরও জানায়, গত বছর জেলায় ৩৭ হাজার ১৬৫ হেক্টর জমিতে আমের আবাদ হয়েছিল। সে মৌসুমে জেলায় আম উৎপাদন হয় ৩ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন। ২০২১ সালে জেলায় ৩৫ হাজার হেক্টর জমি থেকে আড়াই লাখ মেট্রিক টন এবং ২০২০ সালে ৩৩ হাজার হেক্টর জমি থেকে ২ লাখ ৪৫ হাজার মেট্রিক টন আম উৎপাদন হয়। গত বছরের তুলনায় প্রায় ৭৫০ কোটি টাকা বেশি আম বাণিজ্য হবে এবার-এমনটাই আশা করছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।  

এ বছর প্রায় ২ হাজার ৪০০ কোটি টাকার আম বাণিজ্যের আশা করা হচ্ছে।  

অন্যদিকে চাঁপাইনবাবগঞ্জ কৃষি অ্যাসোসিয়েশনের সাধারণ সম্পাদক মুনজের আলম মানিক দাবি করেন, সরকারি তথ্যের তুলনায় এ জেলায় আমের পরিসংখ্যান আরও বেশি হবে।  
তার মতে, সরকারি পরিসংখ্যানে ৪ লাখ ২৫ হাজার মেট্রিক টন উৎপাদন বলা হলেও এ বছর প্রকৃতপক্ষে আমের উৎপাদন হয়েছে ৯ লাখ মেট্রিক টন। যার বাজার মূল্য ৫ হাজার ৫০০ কোটি টাকা।  

তিনি আরও দাবি করেন, উৎপাদিত মোট আমের সিংহভাগই ঝড় বা বিভিন্ন কারণে নষ্ট হয়। একসঙ্গে পাকার কারণে পঁচেও যায়। তাছাড়া আমের ন্যায্য দাম পান না চাষিরা। যদি এ জেলায় আম প্রক্রিয়াজাত করার উদ্যোগ নেওয়া হয়, তাহলে বাজার মূল্য ১০ হাজার কোটি টাকা ছাড়িয়ে যাবে।  

শিবগঞ্জ উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা শরিফুল ইসলাম বলেন, অনেক আগে থেকেই আম উৎপাদনে জেলার মধ্যে শিবগঞ্জ সেরা। এবারও প্রচুর আম রয়েছে এ উপজেলায়। আর কানসাট আমবাজার এ উপজেলাতেই অবস্থিত। তবে বাজারে দৈনিক কত টাকার আম বিক্রি হয় তা সঠিকভাবে বলা সম্ভব নয়। আনুমানিক বলা যায়, দৈনিক ৩০-৪০ কোটি টাকার আম বিক্রি হয় এ বাজারে।  

তবে জেলায় আম বাণিজ্য বাড়লেও সে অনুপাতে বাড়েনি রপ্তানি। কৃষি বিভাগ জানায়, ২০১৯ সালে চাঁপাইনবাবগঞ্জ থেকে ৬৫ দশমিক ৪৫ মেট্রিকটন, ২০২০ সালে ৬৫ দশমিক ৫০ মেট্রিকটন, ২০২১ সালে ৬৫ দশমিক ৫৯৬ মেট্রিকটন এবং ২০২২ সালে ১৩২ দশমিক ৫৬৯ মেট্রিকটন আম বিদেশে রপ্তানি হয়েছে। আর চলতি বছর এ পর্যন্ত মাত্র ১ হাজার ৪০০ কেজি আম রপ্তানি করা সম্ভব হয়েছে।  

তবে আশার কথা হচ্ছে, এ বছর কৃষি বিভাগ রপ্তানি বাড়াতে বেশ কিছু পদক্ষেপ নিয়েছে। অন্যান্য বছর নিজ উদ্যোগে রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করা হলেও বিদেশে পাঠাতে না পেরে লোকসানের মুখে পড়েছিলেন চাষিরা। তবে এবার সরকারি প্রকল্প থাকায় আম রপ্তানির নিশ্চয়তা রয়েছে বলে জানিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।  

স্বাদ, গন্ধ ও পুষ্টিগুণের দিক দিয়ে ভালো হলেও আম রপ্তানিতে বাংলাদেশের অবস্থান অশানুরূপ নয়। বিদেশের মার্কেটে বাংলাদেশের আমের চাহিদা থাকলেও রপ্তানি ছাড়ে জটিলতা ও পরিবহন খরচ বেশি হওয়ায় এবং বিভিন্ন মার-প্যাঁচে চাষিরা বিদেশে রপ্তানি করতে পারেন না। আমের উৎপাদন বেশি হলেও কাঙ্ক্ষিত মূল্য না পেয়ে হতাশায় ভোগেন আমচাষিরা। এ কারণে বাগানের পুরোনো আম গাছ কেটে ফেলছেন অনেকেই।  

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের তথ্য মতে, চাঁপাইনবাবগঞ্জে ২০১ জন চাষি এ প্রকল্পের আওতায় নিরাপদ ও রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন করছেন। এর মধ্যে সদর উপজেলায় ৪১ জন, শিবগঞ্জ উপজেলায় ৬৪ জন, গোমস্তাপুর উপজেলায় ৩২ জন, নাচোল উপজেলায় ৩৫ জন এবং ভোলাহাট উপজেলায় এ প্রকল্পের সঙ্গে যুক্ত আছেন ২৯ জন চাষি।  
এরই মধ্যে তাদের সার, কীটনাশক, ফ্রুট ব্যাগ, নগদ অর্থ দেওয়ার পাশাপাশি প্রশিক্ষণও দিয়েছে কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।  

চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদর উপজেলার বাসিন্দা আব্দুল জাব্বার। তিনি চাঁপাই-পালশা এলাকায় রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের সহায়তায় আম চাষাবাদ করছেন।  

তিনি বলেন, প্রথম থেকেই গতানুগতিক আম চাষাবাদ করে আসছি। এবার কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের প্রশিক্ষণ নিয়ে কম বালাইনাশক স্প্রে করে আম চাষাবাদ করছি। নতুন পদ্ধতিতে আম চাষাবাদ করে ভালো ফলন হয়েছে। দেশের বিভিন্ন এলাকায় আম চাষের কারণে উৎপাদন বেড়ে যাওয়ায় এ আমগুলো যদি আমরা বাইরে রপ্তানি করতে পারি, তাহলে কাঙ্ক্ষিত মূল্য পাওয়া যাবে। এতে আমাদেরও লাভ, সরকারেরও লাভ।  

বিদেশে আম রপ্তানি করতে গেলে বিভিন্ন সরকারি দপ্তরের সাহায্যের প্রয়োজন হয়, না হলে আম রপ্তানি করা যায় না। যেহেতু সরকারি এ প্রকল্পটি হাতে নিয়েছে, আশা করা যাচ্ছে, এবার বিদেশে আম পাঠাতে আর সমস্যা হবে না।  

সম্প্রতি জেলার নাচোল উপজেলা থেকে সুইডেন প্রবাসী বদরুদ্দোজা নামে এক বাগান মালিক ইংল্যান্ড ও সুইডেনে ১ হাজার ৪০০ কেজি আম রপ্তানি করেছেন। তিনি রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের আওতায় না থাকলেও কৃষি সম্প্রসারণ থেকে তাকে সব ধরনের সহায়তা করা হয়েছে।  

বদরুদ্দোজার সহায়তায় একই উপজেলায় রফিকুল ইসলাম নামে এক বাগান মালিকও কিছু আম রপ্তানি করেছেন এবং রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্পের সব ধরনের সুযোগ সুবিধা পেয়েছেন।  

বদরুদ্দোজা জানান, অন্যান্য দেশ বিশেষ করে ভারত থেকে আম পাঠাতে খরচ কম হলেও বাংলাদেশ থেকে আম পাঠানোর খরচ অনেক বেশি। বিষয় সরকার গুরুত্ব দিলে আন্তর্জাতিক বাজারে আম বিক্রির প্রতিযোগিতায় আমরা টিকব। তাতে আরও রপ্তানি বাড়বে।  

শিবগঞ্জের আমচাষি শামিম খান জানান, আম রপ্তানির সময় ঢাকার শ্যামপুরে ছাড়পত্র নিতে গিয়ে ব্যাপক ভোগান্তিতে পড়তে হয়। মানহীন অনেক আম ছাড়পত্র পেলেও উত্তম কৃষি পদ্ধতিতে চাষ করা আম অনেক সময় ছাড়পত্র পায় না। এতে অনেক চাষি আম বিদেশে পাঠাতে নিরুৎসাহিত হন।  

এদিকে রপ্তানি বাড়াতে উত্তম কৃষি চর্চা (গুড এগ্রিকালচারাল প্র্যাকটিস বা গ্যাপ) অনুসরণ করে নিরাপদ আম উৎপাদন করা হচ্ছে এ প্রকল্পের আওতায়। এ তথ্য জানিয়েছেন জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক পলাশ সরকার।  

তিনি বলেন, চলতি বছরই রপ্তানিযোগ্য আম উৎপাদন প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। জেলায় রপ্তানিকারকদের আকৃষ্ট করতে নানা পদক্ষেপ নেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের আওতায় ২০১ জন আম চাষি রয়েছেন। তাদের সবাইকে একটি করে প্রদর্শনীসহ প্রশিক্ষণ, সার, কীটনাশক, বালাইনাশক, ফ্রুট ব্যাগ দেওয়া হয়েছে। এ প্রকল্পের মাধ্যমে এ অঞ্চলের কৃষকরা নতুন পদ্ধতিতে আম চাষাবাদ করে বিদেশে রপ্তানি করতে পারবেন। আশা করছি, এবার বিগত বছরগুলোর চেয়ে অন্তত ১০০ মেট্রিকটন বেশি আম রপ্তানি করা যাবে। নির্ধারিত যেসব আম বাগান নিয়মিত মনিটর করা হচ্ছে, সেসব বাগানের আম রপ্তানির নিশ্চয়তা রয়েছে। উৎপাদন ও চাহিদার ভেতরে একটি সম্পর্ক রয়েছে। উৎপাদন বেশি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে চাহিদাও বাড়াতে হবে। তখনই কাঙ্ক্ষিত দাম পাওয়া যাবে। সে অনুযায়ী আমরা কাজ করে যাচ্ছি। কাছাড়া আম রপ্তানিতে কৃষি মন্ত্রণালয়ের সুদৃষ্টি রয়েছে এবার। কোনো ধরনের ঝামেলা ছাড়াই এবার এ জেলার আম বিদেশে পাঠাতে পারবেন চাষিরা।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪৫৭ ঘণ্টা, জুন ২২, ২০২৩ 
এসআই 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।