বরিশাল: বরিশালের বাবুগঞ্জ উপজেলার রাকুদিয়া গ্রামের শ্যামল ব্রহ্মর সঙ্গে ১৯৯৩ সালে মাত্র ১৬ বয়সে বিয়ে হয় মাদারীপুরের শহুরে মেয়ে রিতা ব্রহ্মর। শহুরে মেয়ে হওয়ায় শুরুতে গ্রামের পরিবেশ ও মানুষদের সঙ্গে মিলিয়ে চলাটা খুব সহজ ছিল না রিতার জন্য।
জানা গেছে, সারা বাংলা কৃষক সোসাইটি যৌথভাবে কেনিয়ার একটি কৃষক সংগঠনের সঙ্গে এ বছর জাতিসংঘের খাদ্য ও কৃষি সংস্থার কৃতিত্ব পুরস্কার লাভ করেছে। কৃষি ক্ষেত্রে অসামান্য কৃতিত্বের জন্য সংগঠন, ব্যক্তি বা এফএও এর টিমকে প্রতি বছর এই পুরস্কার দেওয়া হয়। বিশ্বময় এফএও’র কর্মসূচির সফল বাস্তবায়নের মধ্য দিয়ে যে সকল উদ্ভাবনী কর্মকাণ্ড সমাজে ইতিবাচক প্রভাব ফেলে বা মানুষের জীবন ও জীবিকায় উজ্জ্বল পরিবর্তন আনে, সেই কর্মসূচি বাস্তবায়নকারীকে এই পুরস্কার দেওয়া হয়।
তিন দশক আগে মাত্র একটি বোম্বাই মরিচ গাছ লাগিয়ে তা থেকে এক বছরে কয়েক হাজার টাকা উপার্জন করে কৃষিতেই নিজেকে সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে যাওয়ার স্বপ্ন দেখা সারা বাংলা কৃষক সোসাইটির সভাপতি রিতা ব্রহ্ম বাংলানিউজকে বলেন, অনেক সংগ্রাম করে নিজেকে আজ একজন স্বাবলম্বী নারী হিসেবে সমাজের প্রতিষ্ঠা পেয়েছি। শুরুর দিকে শ্বশুর বাড়িতে এসে শহুরে মেয়ে হওয়ায় গ্রামের কাদামাটির রাস্তায় ঠিকভাবে হাঁটতেও পারতাম না। পানি আনতে গিয়ে কত যে কলস ভেঙেছি তার হিসাব নেই। শ্বশুরের যৌথ পরিবারের মাঝে নিজের অবস্থান করে নিতেও সময় লেগেছে। সময়ের সঙ্গে সঙ্গে সেই যৌথ পরিবার থেকে যখন নিজের পরিবার আলাদা হয়, তখনও খুবই খারাপ দিন কাটাতে হয়েছে। অন্যের কাছ থেকে চাল ধার আনতে হয়েছিল খাওয়ার জন্য, তারপর এমনও সময় গেছে মেয়েটিকে বুকের মধ্যে নিয়ে বসে থাকতাম কারণ টিন বেয়ে ঘরের ভেতর বৃষ্টির পানি পড়তো। সেই দিন ঘুরে যাবে, বাড়িতে পাকা ঘর হবে এ যেন স্বপ্ন ছিল, আজ যা বাস্তব।
রিতা বলেন, পাশের বাড়ির পলি আপা একদিন বললেন, তুমি তো শিক্ষিত আছো, ঘরে বসে না থেকে কিছু একটা করো। আর সেদিন থেকে কিছু একটা করার জন্য বিভিন্ন উন্নয়ন সংস্থার সঙ্গে হয়ে কাজ করেছি। কিছুদিন পরেই কৃষক দম্পতিদের নিয়ে গড়ে ওঠা রাকুদিয়া আইপিএম ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হই। আর সেই ক্লাব সারা বাংলা কৃষক সোসাইটির সঙ্গে যুক্ত হয়। তারপর থেকেই যেন সব কিছু ঘুরে দাঁড়াতে শুরু করে।
ইন্দোনেশিয়া, আফ্রিকাসহ বেশ কয়েকটি দেশ ঘুরে এসেছেন বলে জানালেন রিতা বলেন, এই ক্লাবে যুক্ত হয়ে উন্নত প্রশিক্ষণ, আর্থিক সহযোগিতাসহ নানা কিছু পেতে শুরু করি। আমরা শুধু প্রশিক্ষণই নেইনি, প্রশিক্ষণ নিয়ে আমাদের আশপাশের নারী-পুরুষ কৃষকদেরকেও প্রশিক্ষিত করেছি, ঐক্যবদ্ধ করেছি। আধুনিক কৃষি ব্যবস্থাপনায় নতুন নতুন যন্ত্রের সাথে নিজেদের পরিচয় করিয়েছি আর তার ব্যবহার নিশ্চিত করে উপার্জনের পথও সুগম করেছি। সব থেকে বড় বিষয় কৃষকদের অধিকার মনোবল বাড়াতে অভিভাবকের ভূমিকায় ছিল সারা বাংলা কৃষক সোসাইটি।
তিনি বলেন, বর্তমানে খরা প্রবণ উত্তর বঙ্গ ও লবণাক্ততা প্রবণ দক্ষিণ বঙ্গের ১৬ জেলার ৫৫টি কৃষক সংগঠন নিয়ে সারা বাংলা কৃষক সোসাইটির কাজ করছে। যেখানে ১০ হাজারের ওপর সদস্য রয়েছে। ক্ষুদ্র ও প্রান্তিক কৃষকদের সংগঠিত করে তাদের বহুমাত্রিক সমস্যা সমাধানে নিরলস কাজ করে যাচ্ছে সারা বাংলা কৃষক সোসাইটি। সংগঠন শক্তিশালীকরণ, আর্থিক ব্যবস্থাপনা, নেতৃত্ব বিষয়ক প্রশিক্ষণসহ তহবিল ব্যবস্থাপনায় সারা বাংলা যে প্রবর্তনামূলক স্বচ্ছতা নিয়ে এসেছে তার ফলে এত দিনকার সমবায়ের তহবিল ব্যবস্থাপনায় যে জটিলতা ছিল তা সমাধান হয়েছে। তহবিল ব্যবস্থাপনা ও তদারকিতে ডিজিটাল প্রযুক্তি অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে। যা কোনো বিশেষজ্ঞ ছাড়াই কৃষকরা নিজেরেই শিক্ষণ প্রক্রিয়ায় আত্মনির্ভরতার সঙ্গে পরিচালনা করতে সক্ষম। সারা বাংলা স্বল্প সুদে ঋণ দানেও দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে। সেখানেও ঋণ পরিশোধের হার শতভাগ। এছাড়া নেতৃত্বের ক্ষেত্রে নারী নেতৃত্ব সারা বাংলার একটি সৌন্দর্যের দিক। শতকরা ৬৫ ভাগ নারী সদস্য নিয়ে গঠিত সংগঠনগুলোতে নারীদের ক্ষমতায়নকে অগ্রাধিকার ভিত্তিতে বিবেচনা করা হয়।
তিনি বলেন, আমরা যারা বাটন মোবাইল চালাতে পারতাম না, তারাই এখন কৃষিকাজের পাশাপাশি ট্যাব চালাচ্ছি, সমস্যা সমাধানে তাৎক্ষণিক অনলাইন মিটিংও করছি, আমাদের উৎপাদিত পণ্য একত্রিত করে বাজারে পাঠাচ্ছি, ন্যায্য মূল্যে বিক্রি করতে পারছি। আমাদের মধ্যে কেউ গরু পালন করছেন, কেউ হাঁস-মুরগির খামার করেছেন, কেউ মাছ চাষ আবার কেউ ভার্মি কম্পোস্ট সার উৎপাদন করছেন। ধান চাষের সঙ্গে সঙ্গে আমরাই আবার বিষমুক্ত সবজিও উৎপাদন করছি। আবার যারা আমার মতো শিক্ষিত তারা অনেকেই সারা বাংলা কৃষক সোসাইটির মাধ্যমে হিসাব রক্ষণের ওপর প্রশিক্ষণ নিয়ে কিংবা কম্পিউটার চালনা শিখে কৃষি কাজের পাশাপাশি বাড়তি উপার্জন করছেন। আবার আমাদের ডিজিটাল গ্রাম সেবা কেন্দ্রগুলোতে কৃষক পরিবারের সন্তানরাই কর্মসংস্থানের সুযোগ পাচ্ছে।
রিতা রানীর মতো দক্ষিণ রাকুদিয়া গ্রামের বাসিন্দা ও সংগঠনের হিসাবরক্ষক রেহেনা বেগম বলেন, এসএসসি পাশ করার পরে বিয়ে হয়। এরপর তো সংসার জীবনেই মন দেওয়ার কথা কিন্তু রিতা দিদির কারণে রাকুদিয়া আইপিএম ক্লাবের সঙ্গে যুক্ত হওয়া। যার হাত ধরে সারা বাংলা কৃষক সোসাইটি থেকে বিভিন্ন প্রশিক্ষণ নিয়েছি এবং কৃষি কাজের পাশাপাশি বিভিন্ন সংগঠনের সঙ্গে যুক্ত হয়ে উপার্জনও করছি।
তিনি বলেন, নিজেকে আরও তৈরি করতে এইচএসসি পাশ করে ডিগ্রিতে ভর্তি হয়েছি। এরই মধ্যে আমার দুই সন্তান বড় হচ্ছে। যেখানে আমার পথচলার শুরুটা মসৃণ ছিল না এখন পরিবারসহ শ্বশুরবাড়ির সবাই আমাকে আগের চেয়ে অনেক গুরুত্ব দেয়।
রিতা ব্রহ্ম বরেন, কৃষিকাজের বাইরে বিভিন্ন প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে যুক্ত থেকে মাসে প্রায় ২০ হাজার টাকা আয় করেন রেহেনা।
একই এলাকার বাসিন্দা হাসিনা বেগম বলেন, খুব অভাব অনটনে দিন কাটাতাম কিন্তু এখন সবকিছু পাল্টে গেছে। সারা বাংলা কৃষক সোসাইটির মাধ্যমে প্রশিক্ষণগুলো আমাদের জীবনমান পাল্টে দিয়েছিল। শুরুর দিকে যখন ব্যাংকে গিয়ে সকাল থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত বসে থেকেও মূল্যায়ন পেতাম না, আর এখন ব্যাংকে গেলে বসিয়ে চা-বিস্কুট খাইয়ে দ্রুত কাজ সেরে দেয়। পরিকল্পিত প্রশিক্ষণের মধ্য দিয়ে যে উপার্জন করছি তা দিয়ে তিন ছেলেকে পড়ানোর পাশাপাশি মেয়েদের বিয়েতেও কৃষক স্বামীর সঙ্গে সমান ভূমিকা রেখেছি।
বাংলাদেশ সময় ১৭৩০ ঘণ্টা, অক্টোবর ২০, ২০২৩
এমএস/এসআইএস