ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

সমলয় প্রযুক্তিতে হালতিবিলে চাষ হচ্ছে হাইব্রিড হিরা-২ জাতের বোরো ধান

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪১৩ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২৪
সমলয় প্রযুক্তিতে হালতিবিলে চাষ হচ্ছে হাইব্রিড হিরা-২ জাতের বোরো ধান

নাটোর: সমলয় প্রযুক্তি ব্যবহার করে নাটোরের হালতিবিলের ৫০ জন কৃষক এবার ১৫০ বিঘা জমিতে উচ্চ ফলনশীল হাইব্রিড হিরা-২ জাতের বোরো চাষ করছেন।  

সনাতন পদ্ধতির চেয়ে সমলয় প্রযুক্তি ব্যবহারে উৎপাদন খরচ তুলনামূলক অনেক কম হওয়ায় এ পদ্ধতি অনুসরণ করে চাষাবাদে আগ্রহী হচ্ছেন এখানকার কৃষকরা।

এজন্য ১৫০ বিঘা জমিতে গড়ে তোলা হয়েছে সমলয় চাষাবাদ স্কিম। সরকার এজন্য প্রায় ১৪ লাখ ২৮ হাজার টাকার প্রণোদনা দিয়েছে।  

আর এ প্রণোদনা কার্যক্রমের মাধ্যমে কৃষকের জমি এবং সেচের খরচ বাদে ধানের বীজতলা তৈরি থেকে শুরু করে সব ব্যয় বহন করবে সরকার।  

নলডাঙ্গা উপজেলার হালতিবিলের গৌরিপুর এলাকায় ৫০ একর জমিতে সমলয় পদ্ধতিতে হাইব্রিড হিরা-২ জাতের ধান চাষ করা হচ্ছে। উপজেলা কৃষি পুনর্বাসন বাস্তবায়ন কমিটির মাধ্যমে প্রণোদন এ স্কিমের কার্যক্রম মনিটর করছে কৃষি বিভাগ। এ কার্যক্রম সফল হলে রাজশাহী অঞ্চলের কৃষিতে যুক্ত হবে নতুন দিগন্ত।

কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, সমলয় চাষাবাদ পদ্ধতি হলো একটি নির্দিষ্ট মাঠে একই সময়ে একই জাতের ফসল চাষাবাদের মাধ্যমে ফসলের রোপণ ও কাটার সময় এবং উৎপাদন খরচ কমানো। একই সঙ্গে কৃষকদের সংগঠিত করে নতুন নতুন প্রযুক্তির সঙ্গে পরিচিত করা। যা আগামী দিনের আধুনিক কৃষির জন্য এক অপরিহার্য উদ্যোগ।

সাধারণত এ পদ্ধতিতে ট্রেতে করে পলিথিনে মোড়ানো হাউজে বীজতলা তৈরি এবং যত্নের সঙ্গে মাত্র ১৮ থেকে ২০ দিনেই রোপণের উপযোগী চারা প্রস্তুত করা যায়। সেইসব চারা রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে লাইন লোগো পদ্ধতি ব্যবহার করে রোপণ করা হয় জমিতে। যাতে পর্যাপ্ত আলো-বাতাসে বেড়ে ওঠে ধানের চারা, সুবিধা হয় পরিচর্যায়।

পরে পোকা মাকড়ের প্রকোপ থেকে রক্ষা পেতে ব্যবহার করা হবে পার্চিং পদ্ধতি, খরচ কমাতে ব্যবহার করা হবে আধুনিক সেচের এডব্লিউডি (পর্যায়ক্রমিক শুষ্ক ও ভেজা) পদ্ধতি, সার ব্যবহার যথাযথ ও সীমিত করতে ব্যবহার করা হবে সুষম সার, অনায়াসে আগাছা নিধনে থাকবে উইডার মেশিন আর সর্বোপরি ধান কাটা, মাড়াই এবং প্যাকিংয়ে ব্যবহার করা হবে কম্বাইন্ড হারভেস্টার। যাকে বলে সমলয় পদ্ধতিতে ধান চাষ।

এদিকে সোমবার (১৫ জানুয়ারি) দুপুর থেকে আনুষ্ঠানিকভাবে কৃষি বিভাগের নির্দিষ্ট স্থানে রাইস ট্রান্সপ্লান্টার মেশিনে বোরো ধানের চারা রোপণ কার্যক্রম শুরু করা হয়েছে। আগামী দুই-একদিনের মধ্যে রোপণ সম্পন্ন হবে।

এসময় উপস্থিত ছিলেন নাটোর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ, নলডাঙ্গা উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা (ইউএনও) দেওয়ান আকরামুল হক, জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (উদ্যান) শামসুন নাহার ভুঞা, অতিরিক্ত উপ-পরিচালক (পিপি) কল্যাণ প্রসাদ পাল, উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) মো. রাকিবুল হাসান, নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফৌজিয়া ফেরদৌস, অতিরিক্ত কৃষি অফিসার মো. কিশোয়ার হোসেন, উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ অফিসার মো. সাজ্জাদ হোসাইন, খাজুরা ইউপি চেয়ারম্যান মো. সোহরাব হোসেনসহ অনেকে।  

একই সঙ্গে রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে ধানের চারা রোপণ কার্যক্রম দেখতে বিপুল সংখ্যক কৃষকও উপস্থিত ছিলেন।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কার্যালয় সূত্র জানায়, সাধারণত প্লাস্টিকের ফ্রেমের মধ্যে ৩:২ অনুপাতে কাদা দিয়ে বীজতলা তৈরি করা হয়। এরপর সেখানে বীজ ছিটিয়ে পুনরায় ছাই ও পানি দিয়ে ভিজিয়ে রাখা হয়। একই পলিথিনের ছই বানিয়ে বীজতলা ঢেকে দেওয়া হয়। বীজতলা তৈরির তিন থেকে চারদিনের মাথায় অঙ্কুর বের হয়ে যায়। রাতে পলিথিনে ঢেকে রাখা হয় আর দিনে রোদ উঠলেই পলিথিন সরিয়ে রাখা হয়।

তবে কুয়াশা থাকলে দিনের বেলাতেও পলিথিন সরানো হয় না। জমিতে রোপণ উপযোগী চারা প্রস্তুত হতে ১৮ থেকে ২০ দিন লাগে। এসময় পর্যন্ত গুণগত বীজ উৎপাদনে পলিথিন ব্যবহার করা হয়। আর জীবন চক্রের বেশি সময় জমিতে থাকায় পূর্ণ পুষ্টি পেয়ে ধানের কুশির সংখ্যা বৃদ্ধি পায় এবং ধানের পরিমাণও বেশি হয়।

সূত্র আরও জানায়, এবার ৫০ জন কৃষককে ৩০০ কেজি হাইব্রিড হিরা-২ জাতের বোরোর বীজ দেওয়া হয়। সেই বীজে সাড়ে চার হাজার ট্রেতে চারা তৈরি করা হয়। যা আনুষ্ঠানিকভাবে রোপণ শুরু হয়েছে। সমলয় পদ্ধতিতে বোরো চাষাবাদে বীজতলা তৈরি থেকে ধান কাটা পর্যন্ত ১৪৫ থেকে ১৫০ দিন সময় লাগে। বিঘা প্রতি গড় ফলন হয় শুকনো অবস্থায় ৩৫ থেকে ৪০ মণ। এছাড়া উৎপাদন খরচ তুলনামূলকভাবে সনাতন পদ্ধতির চেয়ে এ পদ্ধতিতে অনেক কম হয়।

স্থানীয় সুবিধাভোগী কৃষক পলাশ, আব্দুল হাকিম ও শহিদুল ইসলাম জানান, আগে এ পদ্ধতিতে চাষাবাদ করেননি। অনেকটা কৌতূহলের বশে তারা কৃষি বিভাগের পরামর্শে এ চাষাবাদ প্রক্রিয়ায় অংশ নিয়েছেন। এ পদ্ধতি অনুসরণ করে একজন কৃষক সর্বোচ্চ ৩০ বিঘা ও সর্বনিম্ন এক বিঘা জমিতে বোরোর চাষাবাদ করছেন। জমি আর সেচের খরচ বাদে সব কিছুই দেবে সরকার।  

তারা বলেন, এ পদ্ধতিতে বোরো ধানে লাভবান হলে আগামীতে আরও পরিধি বাড়াব। কৃষকদের দাবি বন্যাপ্রবণ হালতিবিলে আধুনিক এসব যন্ত্রপাতি আর প্রযুক্তি পর্যবেক্ষণ এবং অনুসরণ করে এলাকার অন্যান্য কৃষকরাও উপকৃত হবেন।

গৌরিপুর এলাকার কৃষক আব্দুল মতিন জানান, এ পদ্ধতিতে বীজতলা প্রস্তুত থেকে মাত্র ২০ দিনের মাথায় তারা চারা রোপণ করতে পারছেন। রাইস ট্রান্সপ্লান্টারে লাইন লোগো পদ্ধতি ব্যবহার করে চারা রোপণ করা হচ্ছে জমিতে। এতে চারাগুলো সতেজ থাকছে এবং নষ্ট বা অপচয় হচ্ছে না। একই কথা জানালেন আরও অনেকে।

নলডাঙ্গা উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা ফৌজিয়া ফেরদৌস বাংলানিউজকে বলেন, সব প্রযুক্তির সমাহারে গড়ে তোলা এ স্কিমকে সফল এবং মডেল হিসেবে গড়ে তুলতে কৃষি বিভাগ সব রকমের পদক্ষেপ নিয়েছে। আশা করি, এ প্রযুক্তি ব্যবহার করে কৃষকরাও স্বল্প সময়ে বোরো ধানে বেশি ফলন পাবেন।  

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে বলেন, কৃষি যান্ত্রিকীকরণ এবং সব প্রযুক্তির সঙ্গে কৃষকের মেলবন্ধন তৈরিতে কাজ করছে কৃষি বিভাগ। আশা করি, সরকারের প্রণোদনার এ স্কিম সফল হবে। জেলার সব উপজেলায় এ  কর্মসূচি ছড়িয়ে পড়ছে।  

তিনি বলেন, এ পদ্ধতিতে চাষাবাদে খরচ কম হয় এবং লাভ বেশি হয়। একই সঙ্গে কৃষকদের শ্রমিক সংকট নিরসন ও সময় সাশ্রয় হয়। এজন্য নাটোরের কৃষকরা এ পদ্ধতি অনুসরণ করছেন। এতে বোরো আবাদে আগ্রহ বাড়ছে কৃষকদের।  

বাংলাদেশ সময়: ১৪০৮ ঘণ্টা, জানুয়ারি ১৬, ২০২৪
এসআই
 

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।