ঢাকা, শুক্রবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২২ নভেম্বর ২০২৪, ২০ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

রঙিন ফুলকপি পরীক্ষামূলক চাষেই কৃষকের সাফল্য

মো. মামুনুর রশীদ, ডিস্ট্রিক্ট করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১০৩৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪
রঙিন ফুলকপি পরীক্ষামূলক চাষেই কৃষকের সাফল্য

নাটোর: উচ্চমূল্য প্রাপ্তি ও নিরাপদ পুষ্টি চাহিদা মেটাতে নাটোরের গুরুদাসপুরে প্রথমবারের মত পরীক্ষামূলকভাবে রঙিন ফুলকপি চাষ করে সফলতা পেয়েছেন স্থানীয় বিলকাঠোর গ্রামের কৃষক মো. আব্দুল আলিম। মাত্র ১০ কাঠা জমিতে ২২০০ চারা রোপণ করে প্রায় এক লাখ ৫০ হাজার টাকার ফসল উৎপাদন করে নজির স্থাপন করেছেন তিনি।

জানা গেছে, চারা রোপণ থেকে উত্তোলন পর্যন্ত পরিচর্যা, জৈবসারসহ মোট খরচ হয়েছিল মাত্র ছয় হাজার টাকা। চারা রোপণের দুই মাস পর অর্থাৎ ৬০ থেকে ৬৫ দিনের মধ্যে জমি থেকে ফসল উত্তোলন করে বাজারে বিক্রি করে খরচ বাদে তার লাভ হয়েছে প্রায় এক লাখ ৪০ হাজার টাকার মত। প্রথম বারেই কৃষক আব্দুল আলিমের এমন সফলতা দেখে এখন উৎসাহ পাচ্ছেন এলাকার অন্য কৃষকেরা।

অন্যদিকে স্থানীয় বাজারে ব্যাপক সাড়া ফেলেছে এই রঙিন ফুলকপি। পাশাপাশি বাজারেও সাদা ফুল কপির চেয়ে বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এই রঙিন ফুলকপি, অনেকেই কৌতূহল বশত: কিনছেন এই সবজি। সবজি বিক্রেতা থেকে শুরু করে পাইকারি বিক্রেতারাও হন্যে হয়ে খুঁজছেন এই রঙিন ফুলকপি। ফলে এই ফুলকপি চাষাবাদ নিয়ে এখন রঙিন স্বপ্ন দেখছেন স্থানীয় কৃষকেরা।  

স্থানীয় কৃষি বিভাগ বলছেন, ভালো ফলন আর ভালো দামও পাওয়ায় রঙিন ফুলকপি চাষে আগ্রহী হয়ে উঠছেন এ অঞ্চলের চাষিরা। রঙিন ফুলকপির সাফল্যে স্থানীয় কৃষি বিভাগও তাই অনেক খুশি। আগামীতে জেলা জুড়ে এ ফসল চাষাবাদ ছড়িয়ে দিতে কাজ করবেন কৃষি বিভাগ এমনটি দাবি কৃষি বিভাগের।

কৃষক মো. আব্দুল আলিম বাংলানিউজকে জানান, প্রথম দিকে এই ফুলকপি চাষাবাদ নিয়ে তিনি একটু শঙ্কিত ছিলেন। কেননা এ ফসল চাষাবাদ নিয়ে তার কোনো ধারণা ছিল না। তবে কৃষি বিভাগের পরামর্শে এবার প্রথম সাহস করে মাত্র ১০ কাঠা জমিতে ২২০০ চারা রোপণ করেছিলেন তিনি। কোনো প্রকার রাসায়নিক সার ও কীটনাশক ব্যবহার ছাড়াই এ ফসল চাষাবাদ করেছেন। তবে জৈব সার ও জৈব বালাইনাশক ব্যবহার করেছেন তিনি। সাদা ফুলকপির মতই চাষাবাদ খরচ হলেও তুলনামূলকভাবে এই ফসলে জৈব সার বেশি প্রয়োগ করতে হয়েছে। ১০ কাঠা জমিতে চারা রোপণ, পরিচর্যা, জৈব সার, জৈব বালাইনাশক ব্যবহারসহ মোট খরচ হয়েছে মাত্র ছয় হাজার টাকা।

তিনি জানান, চারা রোপণ থেকে দুই মাসের মধ্যে ফসল তোলা শুরু করেন। তার জমিতে বেগুনি ও হলুদ রঙের ফুলকপি ছিল। প্রথম দিকে প্রতি কেজি ফুল কপি ৮০ থেকে ১০০ টাকা দরে বিক্রি হয়েছে। পরে গড়ে ৬০ টাকা কেজি হিসেবে এই ফুলকপি বিক্রি করেন। বেগুনি রঙের কপি দুই থেকে আড়াই কেজি এবং হলুদ রঙের কপির ওজন হয়েছে পৌনে দুই কেজি থেকে আড়াই কেজি। বাজারে এই ফুল কপির চাহিদাও অনেক বেশি। সাদা কপির চেয়ে এই কপির দাম বেশি হলেও মানুষ এই কপি কিনতে বেশি আগ্রহী। অনেকে জমি থেকেই কিনেছেন আর স্থানীয় হাট-বাজারে তোলার পর সবজি বিক্রেতাদেরও চাহিদা ছিল বেশি।

তিনি আরও জানান, তার সফলতা দেখে এখন অনেকে এই রঙিন ফুলকপি চাষাবাদের জন্য আগ্রহ দেখাচ্ছেন। এলাকায় ব্যাপক সাড়া পড়েছে। তাই আগামীতে বড় পরিসরে রঙিন ফুলকপির চাষাবাদের পরিকল্পনা রয়েছে তার। পাশাপাশি অন্যদেরও এই সবজি চাষাবাদে উৎসাহিত করবেন তিনি।

স্থানীয় গণমাধ্যমকর্মী এমএম আলী আক্কাসসহ এলাকাবাসী জানান, এই প্রথম তারা এ ধরনের ফুল কপির চাষাবাদ দেখেছেন। সাদা ফুল কপির চেয়ে এই কপির স্বাদ একটু আলাদা মনে হয়েছে। দেখতে যেমন সুন্দর, খেতেও অনেক মজা। এছাড়া ফসলের জমিতে সবুজ পাতার ফাঁকে ফাঁকে বেগুনি আর হলুদ রঙের কপি উকি যেন আরও একটি চমৎকার পরিবেশ সৃষ্টি হয়েছিল।

এছাড়া অনেকে ছবি তোলার জন্য জমিতে ভিড় জমাতেন। আর হলুদ-বেগুনি রঙের ফুলকপির ছবি তুলে সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ছেড়েছেন অনেকে। এমএম আলী আক্কাস বলেন, পরিবেশ ভালো থাকায় তিনি এই ব্যতিক্রমী সবজি চাষ করে বেশ লাভবান হয়েছেন। তিনি ৬০ টাকা কেজি দরে একটি কপি কিনেছেন, যার একটির ওজন প্রায় দুই কেজি। খেতে স্বাদও ভাল।

স্থানীয় কাছিকাটা বাজারের সবজি বিক্রেতা রঞ্জু ও রাজিব হোসেন বলেন, বাজারে সাদা ফুল কপি বিক্রি হচ্ছে ২০ থেকে ২৫ টাকা কেজি দরে। সেখানে রঙিন ফুলকপি বিক্রি হচ্ছে ৫০ থেকে ৬০ টাকা কেজি দরে। সাধারণ ফুলকপির চেয়ে দাম ও চাহিদা দুটোই বেশি। তারা বলেন, ক্রেতাদের মতে অন্য ফুলকপির চেয়ে এই ফুলকপির স্বাদ বেশি ও মজাদার। তাই বার বার রঙিন ফুলকপি কিনতে আসছেন তারা।

গুরুদাসপুর উপজেলা কৃষি অফিসার কৃষিবিদ মো. হারুনুর রশীদ বাংলানিউজকে জানান, রঙিন ফুলকপি চাষে জৈব সার ব্যবহার করায় রাসায়নিক সারের ব্যবহার অনেকাংশে কম লাগে। রঙিন ফুলকপি সাধারণ ফুলকপির তুলনায় পুষ্টিগুণ বেশি থাকে। পুষ্টিগুণ আর ভিন্ন রঙের কারণে স্থানীয় বাজারে এর প্রচুর চাহিদা রয়েছে। এজন্য কৃষক দামও কিছুটা বেশি পাচ্ছেন। প্রথমবার কৃষক আব্দুল আলিম একটু হতাশাবোধ করেছিলেন, তবে চাষাবাদ ভাল ও দাম বেশি পাওয়ায় তিনি খুব খুশি। পাশাপাশি কৃষি বিভাগও সন্তুষ্ট এবং আশাবাদী। কেননা এ সবজি চাষাবাদ নিয়ে যে হতাশা ছিল তা দূর হয়ে গেছে। তাই আগামীতে এর প্রসার ঘটাতে কৃষি বিভাগ থেকে কৃষকদের সব ধরনের সহযোগিতা দেওয়া হবে।

নাটোর জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক কৃষিবিদ আব্দুল ওয়াদুদ বাংলানিউজকে জানান, জেলার মধ্যে এটাই প্রথম রঙিন ফুলকপি চাষ। এই ফসল চাষাবাদে রাসায়নিক সার ও কোনো প্রকার কীটনাশক ব্যবহার করতে হয় না। কেবল জৈবসার ব্যবহার করে ভালো ফলন পাওয়া সম্ভব। এছাড়া সাদা ফুলকপির থেকে রঙিন ফুলকপি এক মাস আগে হারভেস্ট (ফসল কাটা) করাও সম্ভব। গুরুদাসপুরের কৃষক আব্দুল আলিম নিজের প্রচেষ্টা আর কৃষি বিভাগের পরামর্শে প্রথমবার রঙিন ফুলকপি চাষ করে সফল হয়েছেন।

তিনি আরও বলেন, পুষ্টিবিদদের মতে রঙিন ফুলকপিতে অ্যান্টি-অক্সিডেন্ট থাকে, যা ক্যান্সার প্রতিরোধে সহায়তা করে। এছাড়া এন্টিঅক্সিডেন্ট থাকায় শরীরের রোগ-প্রতিরোধ ক্ষমতাও বৃদ্ধি করে। এই রঙের সবজিতে অন্য রঙের সবজির তুলনায় প্রায় পঁচিশ গুণ বেশি ভিটামিন এ উপাদান থাকে। যা ভিটামিন এ, সি, আয়রন, খনিজ উপাদানের পরিমাণ সাদাকপির তুলনায় বেশি থাকে রঙিন সবজিতে। এছাড়া কমলা বা হলুদ রঙের ফুলকপিতে রয়েছে বিটা কেরোটিন, যা শরীরে ভিটামিন ‘এ’ তে পরিণত হয়। চোখ এবং ত্বককে ভালো রাখে। তাই মানুষের শরীরের অঙ্গপ্রত্যঙ্গ ভালো রাখতে রঙিন শাকসবজি খাওয়া প্রয়োজন। পাশাপাশি নিরাপদ পুষ্টি চাহিদা মেটাতে এবং উচ্চ মূল্য প্রাপ্তির জন্য নিরাপদ রঙিন সবজি চাষাবাদে কৃষকদের এগিয়ে আসতে হবে।

বাংলাদেশ সময়: ১০৩৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ৭, ২০২৪
এসএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।