ঢাকা, বৃহস্পতিবার, ৬ অগ্রহায়ণ ১৪৩১, ২১ নভেম্বর ২০২৪, ১৯ জমাদিউল আউয়াল ১৪৪৬

কৃষি

স্টেভিয়া: দেশের কৃষিতে নতুন চমক, চিনির চেয়েও ৪০০ গুণ মিষ্টি

শরীফ সুমন, সিনিয়র করেসপন্ডেন্ট | বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১২৩৮ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২৪
স্টেভিয়া: দেশের কৃষিতে নতুন চমক, চিনির চেয়েও ৪০০ গুণ মিষ্টি

রাজশাহী: গুল্মজাতীয় উদ্ভিদ স্টেভিয়া। এর বৈজ্ঞানিক নাম স্টিভিয়া রিবাউডিয়ানা।

চিনির চেয়েও ৪০০ গুণ বেশি মিষ্টি হলেও এটিকে বলা হয় প্রাকৃতিক চিনি।

অনেকটা তুলশীর মতো দেখতে এই সবুজ উদ্ভিদটি দেশের কৃষকদের কাছে ‘মধু গাছ’ বা ‘চিনি পাতা’ নামেও সমান পরিচিত। দেশের কৃষিতে নতুন চমক হিসেবে বলা হচ্ছে এই স্টেভিয়াকে। পরীক্ষামূলক চাষে সফলতা আসায় রাজশাহীতে এখন বাণিজ্যিকভাবে চাষ শুরু হয়েছে উচ্চমূল্যের এই ফসল।

তিন মাস পরপর সংগ্রহ করা যায় এই গাছের পাতা। আর গাছ থেকে ছিঁড়তে হয় চা-পাতা বা তুলশী পাতার মতো করেই। এরপর তা শুকিয়ে গুঁড়ো করে ব্যবহার করতে হয়। তবে এর কাঁচা পাতা গরম পানিতে দিলেও পাওয়া যাবে চিনির মতোই মিষ্টি স্বাদ। এর এক কেজি গুঁড়ো ৪০ থেকে ৫০ কেজি চিনির সমান। তাই বলা হচ্ছে ‘স্টেভিয়া’ চিনির চেয়েও ৪০০ গুণ বেশি মিষ্টি।

বর্তমানে বিশ্বের প্রায় ১৫ কোটি মানুষ চিনির বিকল্প হিসেবে স্টেভিয়া ও এর নির্যাস ব্যবহার করছেন। ১৮৯৯ সালে পর্তুগাল ও ব্রাজিলের পাহাড়ি অঞ্চলে সন্ধান মেলে এই উদ্ভিদের। এরপর চীন ও নেপালে এবং ভারতের আসামে চাষ শুরু হয় স্টেভিয়ার। এরই মধ্যে নতুন এই ফসলটি দেশের কৃষকদেরও স্বপ্ন দেখাচ্ছে।  

স্টেভিয়ায় ক্যালোরি না থাকায় এই ভেষজ নিয়ন্ত্রণে রাখে রক্তে শরীরের শর্করার পরিমাণ। তাই ডায়াবেটিসে আক্রান্ত অনেকেই এটি খেয়ে থাকেন মিষ্টির বিকল্প হিসেবে। এটি নিয়মিত খেলে ক্যাভিটি ও দাঁতের ক্ষয় রোধ হয়। নিয়ন্ত্রণে থাকে ওজন, ভালো থাকে হার্ট। প্রতিরোধ করে ক্যান্সারের জীবাণুও। তবে এমন সব স্বাস্থ্য উপকারিতা থাকলেও উদ্ভিদটির পক্ষে-বিপক্ষে আছে নানান মত।

এই অবস্থায় রাজশাহীতে স্টেভিয়ার চাষাবাদ বাড়াতে উদ্যোগী হয়েছে কৃষি বিভাগ।  

বর্তমানে রাজশাহীর কাশিয়াডাঙ্গা ও চারঘাটের বালিয়াডাঙ্গা গ্রামে চাষ হচ্ছে স্টেভিয়ার। এরই মধ্যে সেখানে হয়েছে টিস্যু কালচার পদ্ধতিতে স্টেভিয়ার চারা উৎপাদনের প্রশিক্ষণও। প্রতি কেজি কাঁচা অথবা শুকনো পাতার গুঁড়ো ২ থেকে ৪ হাজার টাকায় বিক্রি হচ্ছে বাজারে। বলা হচ্ছে উচ্চমূল্যের এই ফসল বাণিজ্যিকভাবে চাষ করলে প্রতি হেক্টর জমিতে লাভ হবে ৭ থেকে ৮ লাখ টাকা।

বাংলাদেশ সুগারক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের উদ্যোগে স্টেভিয়ার পরীক্ষামূলক চাষাবাদে সফলতা আসায় রাজশাহীতে বাণিজ্যিকভাবে উৎপাদন শুরু করেছেন রাজশাহীর অনেক কৃষি উদ্যোক্তা। উৎপাদন খরচ কম। এর চাষাবাদ পদ্ধতিও সহজ। সারা বছর রোপণ করা সম্ভব। তাই এখন অনেকেই জমির পাশাপাশি রোপণ করছেন বাড়িতেও।

জানতে চাইলে কাশিয়াডাঙ্গা এলাকার কৃষি উদ্যোক্তা আতাউর রহমান রেন্টু বলেন, বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট (বিএসআরই) এর সার্বিক সহযোগিতা ও পর্যবেক্ষণে ২০২৩ সালে প্রথম তিনি স্টেভিয়ার চাষ শুরু করেন। এতে সফলতা আসায় তিনি এখন বাণিজ্যিকভাবে স্টেভিয়া চাষ শুরু করেছেন। তিন মাস পরপর এর পাতা সংগ্রহ করা যায়। তুলশী পাতার মতই গাছ থেকে পাতা ছিড়ে রোদে শুকিয়ে ব্লেন্ডারে গুড়া করা হয়। এরপরই তা ব্যবহার উপযোগী হয়ে ওঠে। তবে এর কাঁচা পাতাও গরম পানিতে মেশালে মিষ্টি স্বাদ পাওয়া যায়। আর চিনির চেয়ে মিষ্টি বেশি হলেও এর কোনো পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া নেই। বাজারে দাম ভালো পাওয়ায় এর চাষাবাদ বাড়তে চান বলেও উল্লেখ করেন এই কৃষি উদ্যোক্তা।

চারঘাটের বালিয়াডাঙ্গার কৃষি উদ্যোক্তা মো. হিমেল জানান, দেশের মাটিতে স্টেভিয়া চাষ নতুন চমক। দীর্ঘদিন গবেষণার পর স্টেভিয়া চাষে সফলতা মিলেছে। এটি উচ্চ মূল্যের একটি ফসল। চিনির বিকল্প হিসেবে এটি এরই মধ্যে অনেকের কাছে ব্যাপক পরিচিত ও জনপ্রিয়। যতই দিন যাচ্ছে এর চাহিদা বাড়ছে। তাই স্টেভিয়া চাষ তাদের কাছে আশাজাগানিয়া ফসল হয়ে উঠেছে।  

এটি কৃষি ও কৃষকের জন্য নতুন এক সম্ভাবনার হাতছানি দিচ্ছে। তাই তিনিও বিএসআরআই এর সার্বিক তত্ত্বাবধানে স্টেভিয়া চাষ শুরু করছেন। তার দেখাদেখি এখন অন্যরাও আগ্রহী হয়ে উঠেছেন বলেও জানান, তরুণ এই কৃষি উদ্যোক্তা।

এদিকে কৃষি গবেষক ও কর্মকর্তারা বলছেন, বাংলাদেশের আবহাওয়া ও জলবায়ু স্টেভিয়া চাষের জন্য উপযোগী। চারা রোপণের পরই বেড়ে উঠছে এই গাছ। কেবল রাজশাহীতেই নয়, মাটি পরীক্ষা করে অন্য অঞ্চলেও হতে পারে সম্ভাবনাময়ী এই স্টেভিয়ার চাষ।

বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউট বায়ো টেকনোলজি বিভাগের ঊর্ধ্বতন বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ও বিভাগীয় প্রধান ড. নাদিরা ইসলাম বলেন, দেশের মাটিতে নতুন কোনো ফসল চাষ শুরু করলে তা নিয়ে অনেক চড়াই-উৎরাই পার করতে হয়। প্রথম দিকে চাষ পদ্ধতি, সার ব্যবস্থাপনা, উৎপাদন, বিপণন ও বাজারজাত নিয়ে কৃষকদের অনেক সমস্যারই মুখোমুখি হতে হয়। তবে ধীরে ধীরে সব সমস্যাই কেটে যায়। ভেষজ গুণ সম্পন্ন স্টেভিয়া চাষের ক্ষেত্রে প্রথম প্রথম এমনটি ঘটছে বা ঘটবে। তবে তারা সব সময় কৃষকদের পাশে রয়েছেন। বুদ্ধি, পরামর্শ ও বাজারজাতসহ সব দিক থেকেই তাদের সহযোগিতার করা হচ্ছে।  

তিনি বলেন, দেশের মাটিতে অর্থকরী ফসল হিসেবে স্টেভিয়া চাষের জন্য তারা ২০০১ সাল থেকে গবেষণা চালিয়ে আসছেন। আজকে যে সফলতা এসেছে তা দীর্ঘ গবেষণারই ফসল। এই সফলতা তারা কৃষকদের মাঝে ছড়িয়ে দিতে চান। এছাড়া ভবিষ্যতে তারা স্টেভিয়ার গুণাগুণ আরও বাড়তে চান বলে জানান।  

বাংলাদেশ সুগার ক্রপ গবেষণা ইনস্টিটিউটের মহাপরিচালক ড. মো. ওমর আলী বলেন, চিনির উত্তম বিকল্প হচ্ছে স্টেভিয়া। দেশে চিনির চাহিদা বেশি। তবে উৎপাদন কম। তাই ভোক্তাদের চাহিদা মেটাতে ক্ষেত্রবিশেষে চিনি আমদানিও করতে হয় প্রায় সময়। কিন্তু স্টেভিয়া চাষের প্রচলন বাড়লে চিনি আর বাইরের দেশ থেকে আমদানি করতে হবে না। কোনোরকম পার্শ্বপ্রতিক্রিয়া ছাড়াই চিনির বিকল্প হিসেবে একই স্বাদের স্টেভিয়া ব্যবহার করা যাবে। চিনির অনেক ক্ষতিকর দিক আছে। কিন্তু স্টেভিয়ার আছে উপকারী দিক। এটি শরীরে শোষণ হয় না বলে ডায়াবেটিস রোগীরা অনায়াসেই খেতে পারেন। এছাড়া চা, সেমাই, পায়েসসহ মিষ্টি জাতীয় সব খাবারেই ব্যবহার করা যেতে পারে স্টেভিয়া। এতে ক্ষতির পরিবর্তে খাবারের গুণাগুণ আরও বেড়ে যাবে।

তিনি বলেন, অনেক গবেষণা পর বাংলাদেশের মাটিতে এই ভেষজ গুণ সম্পন্ন স্টেভিয়া চাষে সফলতা এসেছে। এটি এখন কৃষকদের মধ্যে ছড়িয়ে দিতে হবে। কারণ উচ্চমূল্যের এই ফসল কৃষকের ভাগ্য পরিবর্তনে সহায়ক ভূমিকা পালন করতে সক্ষম। এ সময় তিনি চিনির বিকল্প হিসেবে স্টেভিয়ার ব্যবহার বাড়াতে সবার প্রতি আহ্বান জানান।

চাষ পদ্ধতি: বাণিজ্যিক উৎপাদনের জন্য স্টেভিয়া সাধারণত বেডে চাষ করতে হয়। মাটি থেকে বেডের উচ্চতা হবে কমপক্ষে ৬ ইঞ্চি। বেডে এক সারি থেকে অন্য সারির দূরত্ব হবে এক ফুট এবং গাছ থেকে গাছের দূরত্ব লাগবে ৬ ইঞ্চি। ৫ থেকে ৬টি চাষ দিয়ে জমিকে ভালোভাবে তৈরি করতে হবে। জমির ওপরের ঢেলা ভেঙে গুঁড়ো করতে হবে মই দিয়ে।

আর দুইভাবে স্টেভিয়ার বংশবৃদ্ধি করা যায়। প্রথমত টিস্যু কালচার পদ্ধতি এবং দ্বিতীয়ত স্টেম কাটিং পদ্ধতি। তবে টিস্যু কালচার পদ্ধতি সবচেয়ে ভালো ও লাভজনক পদ্ধতি। কারণ স্টেম কাটিংয়ে সফলতার হার কম এবং কাটিং এ শেকড় গজাতে বেশি সময় লাগে। এছাড়া বীজ থেকে চারা গজালেও অঙ্কুরোদগমনের হার থাকে খুবই কম থাকে বলে পরীক্ষিত।

একর প্রতি ৪০ হাজার গাছ বা হেক্টরপ্রতি এক লাখ গাছ লাগানো যাবে। স্টেভিয়া চাষের সফলতা নির্ভর করে জমির পুষ্টি উপাদানের ওপর। তাই এর জমিতে ফসফেট ও পটাশ সারের পরিমাণ ইউরিয়া অপেক্ষা বেশি থাকতে হবে। কারণ অতিরিক্ত ইউরিয়া সার স্টেভিয়া পাতার মিষ্টতা কমিয়ে দেয়। তাই স্টেভিয়া চাষের জন্য জৈব সারই সর্বোৎকৃষ্ট।  

এই গাছ অতিরিক্ত আর্দ্রতা সহ্য করতে পারে না। তাই সাধারণত শীতকালে একবার এবং গ্রীষ্মকালে ২ থেকে ৩ বার ঝাঁঝরির সাহায্যে হালকা সেচ দিতে হবে। মাসে একবার বেডের আগাছা পরিষ্কার করতে হবে। তবে মালচিং করলে একই সঙ্গে আগাছা দমন হয় আবার আর্দ্রতাও সংরক্ষণ হয়। খড়কুটো, কচুরিপানা বা কম্পোস্ট দিয়ে মালচিং করা যায় যা গাছের শিকড়কে মাটির সঙ্গে সুসংহত রাখে।

বাংলাদেশ সময়: ১২৩৬ ঘণ্টা, জুন ১৫, ২০২৪
এসএস/এফআর

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।