মেহেরপুর: শুধু শীতকালে নয়, ১২ মাসই বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করে সংসারে আর্থিক স্বচ্ছলতা ফিরিয়ে এনেছেন মেহেরপুরের গাংনী উপজেলার সাহারবাটি গ্রামের কৃষকরা।
পাল্টে গেছে তাদের জীবনের চালচিত্র।
ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, পুঁইশাক, লালশাক, লাউ, বেগুন, চালকুমড়া, ডিমা কলমি, ভূটাং ডাটা শাক, শশাসহ বিভিন্ন জাতের সবজির পসরা এখন কৃষকের মাঠ জুড়ে। ফলে এ জেলার বাজারগুলোতে ১২ মাসই পাওয়া যায় টাটকা শাক সবজি।
শুধু সাহারবাটি থেকেই প্রতিদিন অর্ধশত ট্রাক বিভিন্ন জাতের সবজি নিয়ে যাচ্ছে ঢাকা, চট্টগ্রাম, বরিশালসহ দেশের বিভিন্ন অঞ্চলে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর জানিয়েছে, মেহেরপুর জেলায় এবার গরমকালিন সবজি চাষ হয়েছে প্রায় ৩ হাজার ৬১৫ হেক্টর জমিতে।
ফুলকপি, বাঁধাকপি, করলা, পুঁইশাক, লালশাক, লাউ, বেগুন, চালকুমড়া, ডিমা কলমি, ভূটাং ডাটা শাক, মেহেরচন্ডি কচু, মুলা, পটল, সিম, টমেটো, শশাসহ বিভিন্ন সবজির চাষ হয়েছে এ জেলায়।
সাহারবাটি গ্রামের সবজি চাষি মোশাররফ হোসেন ৩ বিঘা, গোলাম কিবরিয়া ২ বিঘা, শফিকুল ইসলাম ৬ বিঘা, বাবলু হোসেন ৯ বিঘা, রহেল উদ্দীন ২ বিঘা, পলাশ হোসেন ৫ বিঘা ও স্বপন আলী ৩ বিঘা জমিতে ফুলকপি চাষ করেছেন।
এসব কৃষকরা বলেন, শুধু আমরা নয়, আমাদের মত এ গ্রামের শতাধিক কৃষক ফুলকপির চাষ করেছেন।
মোশাররফ হোসেন ও বাবলু হোসেন জানান, বিঘা প্রতি ফুলকপি চাষ করতে ২০ থেকে ২২ হাজার টাকা খরচ হয়। সবজির বাজার ভালো হলে ৪০ থেকে ৫০ হাজার টাকায় এসব সবজি বিক্রি হয়। তবে কাঁচা সবজির বাজার সমন্ধে কিছু বলা যায়না। অনেক সময় ঢাকা-চট্টগ্রামে গাড়ি ভর্তি সবজি নিয়ে গিয়ে দেখা যায় গাড়ি ভাড়াটাও উঠেনা।
জাকারিয়া হোসেন ৩ বিঘা, আলহাজ আলী ৩ বিঘা, মহসিন আলী ২ বিঘা জিয়াবুর রহমান ২ বিঘা ও হায়দার আলী ৩ বিঘাসহ গ্রামের শতাধিক চাষি এসময়ে বাঁধাকপির চাষ করেছেন।
জাকারিয়া হোসেন মহসিন আলী ও জিয়াবুর রহমান জানান, মাঠে বাঁধাকপির ফলন ভালো হচ্ছে। আবহাওয়া এভাবেই থাকলে বাঁধাকপি থেকে অনেক অর্থ উপর্জন করা যাবে। বর্তমানে বাঁধাকপি জমি থেকে তোলা হচ্ছে। এক একটি বাঁধাকপি জমি থেকে ২২ থেকে ২৫ টাকা দরে কিনে নিচ্ছেন ফঁড়িয়া ব্যবসায়ীরা।
এছাড়া ঢাকা ও চট্টগ্রামের বাজারে নিয়ে গেলে আরেকটু বেশি দামে বিক্রি হচ্ছে এসব সবজি। বিঘা প্রতি ২২ থেকে ২৫ হাজার টাকা খরচ হলেও চাষিরা এসব সবজি বিক্রি করে ৫০ থেকে ৬০ হাজার টাকা আয় করছেন বলে জানান।
সাহারবাটি গ্রামের সাবেক ইউপি সদস্য রাহেদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সাহারবাটি গ্রামের সবজি চাষের ইতিহাস প্রায় ৩৫ বছরের। আমরা ছোট বেলায় দেখেছি, এ গ্রামের মাঠে শুধু কইদু ও কাউনের চাষ করতেন কৃষকরা। ধানের সময় সামান্য ধান হতো। কইদুর ভাত খেয়ে প্রায়ই পেটের সমস্যায় ভুগতেন এ এলাকার মানুষ। এ কারণে ধীরে ধীরে এ ফসল চাষ করা ছেড়ে দিয়েছেন কৃষকরা।
সে সময় থেকে এ গ্রামের আলী কামার, বাদল শাহ, আব্দুল হামিদ, তোজাম্মেল হকসহ কয়েকজন কৃষক সবজির চাষ করতে শুরু করেন। বিশেষ করে লাউ, মিষ্টি কুমড়ার চাষ করতেন তারা। লাভ ভালো পাওয়ায় গ্রামের মানুষ ধীরে ধীরে এ সবজিসহ অন্যান্য সবজি চাষে ঝুঁকে পড়েন।
সাহারবাটি গ্রামের বীজ ব্যবসায়ী অতুল বিশ্বাস বাংলানিউজকে জানান, সবজি চাষ শুরুর পর থেকে কৃষকের জীবনযাত্রা বদলে গেছে। এক সময় এ এলাকার মানুষ অর্থ কষ্ট আর দারিদ্রতার মধ্য দিয়ে জীবন যাপন করতেন। সবজি চাষ করে এখন প্রতিটি কৃষকই ভাগ্যের চাকা ঘুরিয়েছেন। গ্রামের প্রতিটি কৃষকই এখন আর্থিকভাবে স্বচ্ছল। প্রতিটি কৃষকের বাড়িতে রয়েছে, নামি-দামি মোটরসাইকেল, ফার্নিচারসহ বড় বড় দালান কোঠা। প্রায় ৫ শতাধিক মোটরসাইকেল রয়েছে এ গ্রামের কৃষকের ঘরে। এটা শুধু সবজি চাষেরই ফসল বলে উল্লেখ করেন তিনি।
সবজি চাষ করে আর্থ সামাজিক উন্নয়নের ফলে কৃষকের ছেলে মেয়েরা শহরের নামি দামি স্কুল কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ছেন। তিনি আরো বলেন, এলাকায় সবজি চাষকে ঘিরে ১৫ থেকে ২০টি বীজ ব্যবসায়ী প্রতিষ্ঠান গড়ে উঠেছে।
এছাড়া ৩৫ জন ফঁড়িয়া ব্যবসায়ী কৃষকের কাছ থেকে বীজ কিনে কোম্পানিগুলোর সঙ্গে ব্যবসাও করছেন। দেশের নামি দামি বীজ কোম্পানিগুলো এখানে এসে ব্যবসা প্রতিষ্ঠান গড়ে তুলেছেন। ফলে অনেকেই কাজের সন্ধান পেয়েছেন।
শুধু পুরুষ নয়, এখানে নারী শ্রমিকরাও কাজ করছেন। সবজি খেত ও চাষিদের বাড়ি ছাড়াও বীজ ব্যবসায়ীদের প্রতিষ্ঠানে নারী শ্রমিকরা বীজ উৎপাদনের কাজ করে সংসারের আর্থিক স্বচ্ছলতা আনছেন।
সাহারবাটি গ্রামের শ্রমিক সর্দার শাহাদৎ হোসেন, তৈহিদুজ্জামান ও কেরামত আলী বাংলানিউজকে জানান, সারা বছরই সাহারবাটি গ্রাম থেকে ট্রাক বোঝাই সবজি দেশে বিভিন্ন এলাকায় যায়। বিশেষ করে শীতকালীন সবজির সময়ে এখান থেকে প্রতিদিন ২৫ থেকে ৩০টি ট্রাক সবজি বোঝাই হয়ে দেশের বিভিন্ন স্থানে যায়। শীতকালীন সবজির সময়ে ৪ থেকে সাড়ে ৪শ’ শ্রমিক ও অন্যান্য সময় শতাধিক শ্রমিক ট্রাক বোঝাইয়ের কাজ করে থাকেন। শ্রমিকের শ্রেণী বিভেদে ৫শ’ থেকে ৮শ’ টাকা পর্যন্ত আয় করে থাকেন বলে জানালেন শ্রমিক সর্দার শাহাদৎ হোসেন।
বীজ ছড়ানোর কাজে ব্যস্ত নারী শ্রমিক কমেলা বেগম, পঞ্চাশোর্ধ্ব আছিরন নেছা, হাছেনা খাতুন (৩৫), সুন্দরী খাতুন (৪৮), হাজেরা খাতুন (৫৫), জালিমন নেছা (৫২) বাংলানিউজকে জানান, তাদের মতো প্রায় শ’খানেক অসহায় নারী সবজি খেতে কাজ করে সংসার চালাচ্ছেন।
হাজেরা খাতুন বলেন, প্রায় ১২ বছর আগে স্বামী হারিয়েছি। এখন বীজ তোলা ছড়ানো ও বাছাইয়ের কাজ করি। প্রতিদিন ১৩০ থেকে দেড়’শ টাকা আয় করি। একই কথা জানালেন, আছিরন বেগম ও মালেকা বানু। তারা জানান, এ কাজ করেই আমাদের সংসার চলে। তবে পরিশ্রম বেশি হলেও পারিশ্রমিক কম বলে জানালেন তারা।
কৃষকের পাশাপাশি লাভবান হচ্ছেন ব্যবসায়ীরাও। ফঁড়িয়া ব্যবসায়ী ফরমান আলী, সবেদ আলী ও সাইফুল ইসলাম বাংলানিউজকে জানান, এ বছর এখন থেকে ২২ থেকে ২৫ টাকার মধ্যে এক একটি ফুল কপি ও বাঁধা কপি কিনে চিটাগাং ও ঢাকার বাজারে নিয়ে গিয়ে ২৮ থেকে ৩০ টাকা দরে বিক্রি করছি। এতে আমরা যেমন লাভবান হচ্ছি তেমনি কৃষকরাও সরাসরি তাদের জমি থেকে ঝামেলামূক্ত নগদ মূল্যে তাদের খেতের সবজি বিক্রি করতে পারছেন।
বীজের ফঁড়িয়া ব্যবসায়ী হানিফ শাহ, কবির হোসেন ও খোকা মিয়া বলেন, সারা বছরই এখানকার কৃষকরা সবজি চাষের পাশাপাশি বিভিন্ন জাতের সবজির বীজ উৎপাদন করে থাকেন। এখানে দেশের নামি দামি কোম্পানিগুলো সবজি চাষিদের সঙ্গে চুক্তি ভিত্তিক বিভিন্ন সবজির বীজ কিনে থাকেন। যেমন লাল তীর, কাশেম, সুপ্রীম, এসিআই কোম্পানির পাশাপাশি আমরাও ফঁড়িয়ারা বীজ কিনে ঢাকার বিভিন্ন কোম্পানির সঙ্গে ব্যবসা করছি। সাধারণ যেসব কৃষকরা অল্প বীজ বিক্রি করে থাকেন এক মণ দেড় মণ বা আরো বেশি তাদের কাছ থেকে আমরা বীজ কিনে থাকি।
মেহেরপুর কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ পরিচালক এসএম মোস্তাফিজুর রহমান বাংলানিউজকে জানান, সময় ও বাজার বুঝে ফসল আবাদে সাফল্য অনেকটাই নিশ্চিত করছেন এখানকার চাষিরা। জেলার মাটি উর্বর হওয়ায় সব ফসলই ভালো উৎপাদন হয়ে থাকে। জেলায় বর্তমানে সবজি চাষিরা শুধু শীতকালেই নয়, তারা গরম কালেও শীতকালীন সবজির চাষ করছেন। ফলে তারা দামটাও ভালো পাচ্ছেন।
তিনি আরো বলেন, এলাকার সবজি চাষিদের কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে সব ধরনের কৃষি পরামর্শ দেওয়া হয়ে থাকে। তারা কোন সমস্যায় পড়লে উপ সহকারী কৃষি অফিসারসহ কৃষি বিভাগ সব সময় থাকে তাদের পাশে থেকে পরামর্শ দিয়ে থাকেন। তিনি আরো জানান, সবজি চাষকে ঘীরে শুধু সবজি চাষিদের নয়, জেলার আর্থ সামাজিক উন্নয়নও হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ০২৩০ ঘণ্টা, জুন ০৬, ২০১৬
আরএ