ঢাকা, শুক্রবার, ১৩ বৈশাখ ১৪৩১, ২৬ এপ্রিল ২০২৪, ১৬ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

মৎস্য অভয়াশ্রমে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ১৪৪৩ ঘণ্টা, জুলাই ৪, ২০১৭
মৎস্য অভয়াশ্রমে নতুন সম্ভাবনার হাতছানি পদ্মানদীর কোলে মৎস্য অভয়াশ্রম। ছবি: শরীফ সুমন

গোদাগাড়ীর (রাজশাহী) পিরিজপুর থেকে ফিরে: কথায় আছে মাছে-ভাতে বাঙালি। কিন্তু আগের মত নদী বা খাল-বিলে সব মাছ কী আর আছে, না নেই। কয়েক দশকের ব্যবধানে দেশী প্রজাতির সুস্বাদু অনেক মাছ বিলুপ্ত হয়ে গেছে। নানান কারণে হুমকির মুখে পড়েছে আরও অনেক মাছের অস্তিত্ব। এ অবস্থায় কাউকে না কাউকে তো এগিয়ে আসতেই হবে। আর এই ভাবনা থেকেই সামনে এসেছেন গোদাগাড়ীর শফিউল ইসলাম মুক্তা নামের উদ্যোমী এক যুবক।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলার পিরিজপুরে পদ্মানদীর কোলে গড়ে তুলেছেন মৎস্য অভয়াশ্রম। যেখানে এরই মধ্যে ৫০টিরও বেশি বিলুপ্ত প্রজাতির দেশী মাছের সন্ধান মিলেছে।

তাই অভয়াশ্রমটি এরই মধ্যে দেশের মধ্যে দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে। আর তার এই অগ্রযাত্রার সারথি ছিলেন বন্ধু শরৎ চন্দ্র মণ্ডল। দুজন মিলেই শুরু করেছিলেন এই আন্দোলন। জানাজানি হয় আরও পরে। তাদের এই সাফল্য গাঁথার কথা শুনে এ সময় সহায়তার হাত বাড়িয়ে দেয় সরকারও।
       
যুবকদের এই প্রচেষ্টার পালে বাতাস দিতে উপজেলা মৎস্য অফিসের পক্ষ থেকে পিরিজপুরের গ্রাম ঘেঁষা পদ্মা নদীতে কিছু খাঁচা বানিয়ে দেয়। বর্তমানে তার মধ্যেই প্রতিষ্ঠিত হয়েছে মৎস্য অভয়াশ্রম। নদীর মধ্যে থাকা ওই খাঁচার পানিতেই বেড়ে উঠছে বিলুপ্ত প্রজাতির দেশি মাছ। যা দেখতে প্রতিদিন নদীপাড়ে ভিড় করছেন দূর-দূরান্ত থেকে আসা মৎস্যজীবী, মৎস্য কর্মকর্তা এবং সাধারণ মানুষ। এছাড়া গত ৩১ ডিসেম্বর মৎস্য ও পানিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী নারায়ণ চন্দ্র চন্দ এই অভয়াশ্রম পরিদর্শন করে যান। নদীতে খাঁচা পেতে মাছ চাষের তাগিদ দেন মৎস্য ও প্রাণিসম্পদ প্রতিমন্ত্রী।

সর্বশেষ মঙ্গলবার (৪ জুলাই) পরিদর্শনে যান রাজশাহী জেলা প্রশাসক মো. হেলাল মাহমুদ শরীফ। মঙ্গলবার (৪ জুলাই) দুপুরে রাজশাহীর গোদাগাড়ীতে কার্প ও সিবিজি (খাঁচায় মাছচাষ) পরিদর্শনে করেন। এই সময় জেলা ও উপজেলা প্রশাসনের ঊর্ধ্বতন কর্মকর্তারা তার সঙ্গে ছিলেন। পরিদর্শন শেষে খাঁচায় মাছ চাষের তাগিদ দেন জেলা প্রশাসকও।

নদীপাড়েই কথা হয় শফিউল ইসলাম মুক্তার সঙ্গে। জানান, তার বাবা মৃত আনোয়ারুল ইসলাম ছিলেন স্কুলশিক্ষক। তিনি এইচএসসি পাস করে আর পড়াশোনা করেননি। সংসার ও সমাজসেবা নিয়েই দিন কাটে তার। পদ্মার কোলে মাছের এই অভয়াশ্রম গড়ে তোলার কাজটি প্রথম দিকে মোটেও সহজ ছিল না। স্থানীয় জেলেদের মাছ না ধরতে অনেক কষ্টে বুঝিয়ে শেষ পর্যন্ত তিনি অভয়াশ্রমটি করতে পেরেছেন। এসব মাছ ধরে স্থানীয় জেলের মুখে এখন হাসি ফুটেছে।

শফিউল ইসলাম মুক্তা বলেন, একসময় পদ্মায় মাছের প্রাচুর্য ছিল। এখন সেই নদীতে মাছের আকাল। তাই পদ্মা নদীর তীরে এমন একটি অভয়াশ্রম গড়ে তোলার স্বপ্ন দেখতে শুরু করেন তিনি। যেখানে কেউ জাল ফেলে মাছ ধরতে পারবে না। শুষ্ক মৌসুমে প্রায় আট মাস মা মাছকে বাঁচাতে পারলে একটি মাছ থেকে হাজারো মাছের জন্ম হবে। বর্ষায় নদী ভরে গেলে অভয়াশ্রমের মাছ অন্য নদ-নদীতে ছড়িয়ে পড়বে। ২০১০ সালে এই ভাবনা থেকেই কাজ শুরু হয় মুক্তার। পদ্মানদীর কোলে মৎস্য অভয়াশ্রম পরিদর্শন।  ছবি: শরীফ সুমন

সঙ্গে পান গ্রামের মৎস্যজীবী শরৎ চন্দ্র মণ্ডলকে। ২০১৪ সালে বর্ষায় পিরিজপুর গ্রামে পদ্মা নদীতে যখন পানি থৈ থৈ করছিল ঠিক তখন ১শ’ মিটার দৈর্ঘ্যের ছোট একটি খাঁচাকে অভয়াশ্রম ঘোষণা করেন তারা। এজন্য রাতের পর রাত জেগে ওই খাঁচা পাহারা দিতে থাকেন তারা। এতে কেউ আর সেখানে জাল ফেলে মাছ ধরতে পারেনি। মুক্তা দেখলেন, সব মা মাছ তার অভয়াশ্রমে পোনা ছেড়েছে। আট মাস জাল না ফেলার কারণে সেবছর প্রচুর মাছ হলো। উৎসুক মানুষ তখন সকাল-সন্ধ্যা দাঁড়িয়ে থেকে মাছের লাফালাফি দেখেন। পরের বর্ষায় অভয়াশ্রমের মাছ আবারও ভাসিয়ে দেওয়া হলো।

২০১৫ সালে মুক্তা ও শরৎ চন্দ্রের সঙ্গে পিরিজপুর গ্রামের আরও ২০ জন যোগ দেন। পরে এই ২২ জন সদস্য নিয়ে তারা ‘পদ্মা ফিশ কেয়ার’ নামে একটি সমিতি গঠন করেন। তবে ২০১৬ সালে এর নাম বদল করা হয়। এর নতুন নাম দেওয়া হয় ‘পদ্মা নদী অভয়াশ্রম’ সমিতি। আর নদীতে অভয়াশ্রমের দৈর্ঘ্য এবার বিস্তার করা হয় ৫শ’ মিটারে।

শফিউলদের নিঃস্বার্থ উদ্যোগের খবর জেনে উপজেলা মৎস্য অধিদপ্তর রড-সিমেন্ট দিয়ে ১০টি বিশেষ ধরনরে রিং তৈরি করে দেয়। যার ভেতরে মাছ লুকিয়ে থাকতে পারে। এগুলো স্রোতের বিপরীতমুখী করে রাখা হয়। যাতে প্রবল স্রোতেও মাছ এর ভেতরে ঢুকে থাকতে পারে। আর কেউ জাল ফেললে এতে বেঁধে ছিঁড়ে যায়। মাছ না ওঠে। বর্তমানে এখানে ৩৭টি খাঁচা রয়েছে। প্রতিটি খাঁচার দৈর্ঘ ২০ ফুট এবং প্রস্থ ১০ ফুট এবং গভীরতা ৬ ফুট। প্রতিটি খাঁচায় এক হাজার করে মাছ অনায়াসেই থাকতে পারে। প্রজনন মৌসুমে এই খাঁচার মধ্যেই ডিম ছাড়তে পারে মা মাছ।

এখান থেকে কোনো আয় হয় কীনা প্রশ্নে শফিউল ইসলাম বলেন, তাদের এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগ দেখে মৎস্য অধিদফতর তাদের কিছু আয়বর্ধক কাজের ব্যবস্থা করে দেয়। অভয়াশ্রমের ভাসমান খাঁচায় মনোসেক্স প্রজাতির তেলাপিয়া মাছ ছেড়ে দেওয়া হয়। মাছ-খাঁচা সবই তারা সরবরাহ করে। তবে খাঁচার মাছ সমিতির সদস্যরাই বিক্রি করবেন। আর এখান থেকে যা উপার্জন হয় তা সমিতির সদস্যরাই ভোগ করতে পারেন। এভাবে তাদের আয়ের পথও হয়েছে।

শফিউল বলেন, বর্তমানে এই অভয়াশ্রমের আশপাশে জাল ফেললেই দেশি কই, শিং, মাগুর, বাসপাতা, পাবদা, চিতল, বোয়াল, ময়া, উড়ল, চাপিলা, বৈচা, চাটুয়া, নাপতানি, চাঁদা, নামা চাঁদা, গোল চাঁদা, আঁইড়, গুলশা, দেশি পুঁটি, সরপুঁটি, তিতপুঁটি, মেনি, ভেদা, টাকি, ফলি, চেলি, মলা, ঢেলা, কানপোনা, দারকিনা, বাচা, বাটা, রিটা, পিয়ালি, জয়া, খৈলশা, ছোট টেংরা, বড় টেংরা, বড় বাইম, তারা বাইম, চিকরা বাইম, কুচিয়া, বেলে, রাণী, কাজলী, গুচি, লাচু, টাটকিনি, ভাংনা, গুতুম, কাকিলা, পিঠালি উড়োল, মাঘি, কালবাউসসহ নাম না জানা অনেক প্রজাতির দেশি মাছের দেখা মিলছে।

রাজশাহীর গোদাগাড়ী উপজেলা মৎস্য কর্মকর্তা শামসুল করিম বলেন, এই ব্যতিক্রমী উদ্যোগের জন্য শফিউল জাতীয় মৎস্য পুরষ্কারের জন্য আবেদন করেছেন। তাদেরও সুপারিশ রয়েছে। যাচাই-বাছাই শেষে নির্বাচিত করা হলে তিনি প্রধানমন্ত্রীর কাছ থেকে পুরষ্কারটি পাবেন। এজন্য তাদের সার্বিক চেষ্টা ও সহযোগিতা থাকবে বলেও জানান।

বাংলাদেশ সময়: ২০২০ ঘণ্টা, জুলাই ০৪, ২০১৭
এসএস/জেডএম

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।