স্বাস্থ্য ক্ষতিসহ জমির উর্বরতা রক্ষায় অনেক চাষি গত বছর তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে আলু চাষে ঝুঁকেছিলেন। ফলনও বাম্পার হয়েছিল।
তারা জানান, একই জমিতে টানা কয়েকবার তামাক চাষ করায় জমিগুলো দুর্বল হয়ে ফসলহানি দেখা দেয়। জমির উর্বরতা রক্ষায় এবং নিজের ও পরিবারের স্বাস্থ্য সুরক্ষায় তামাক চাষ বন্ধে বিকল্প লাভজনক ফসলের দাবি তাদের। তামাকমুক্ত থাকতে অনেক চাষিই গত বছর তামাকের জমিতে আলু চাষ শুরু করেন। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় গত বছর এ জেলায় আলুর বাম্পার ফলন হয়। কিন্তু ছিল না আলুর ন্যায্য মূল্য। ফলে শুরুতেই লোকসান গুণতে হয়েছে চাষিদের। এ ক্ষতি কাটিয়ে উঠতে আবারো তারা বিষবৃক্ষ তামাক চাষের দিকে ঝুঁকে পড়েছেন।
জেলার সব থেকে বেশি তামাক চাষ হয় আদিতমারী উপজেলায়। সেখানে রয়েছে দেশের সব ট্যোব্যাকো কোম্পানির বড় বড় ক্রয় কেন্দ্র ও গুদাম। কোম্পানি চাষিদের সহজ শর্তে ঋণ, সার ও বিনামূল্যে বীজ দেয়। বীজ তলা তৈরি থেকে উৎপাদিত তামাক কোম্পানির ক্রয় কেন্দ্রে পৌঁছা পর্যন্ত চাষিদের প্রয়োজনীয় পরামর্শ দিয়ে আসছে তামাক কোম্পানির কর্মকর্তারা। ফলে তামাক চাষেই ঝুঁকছেন কৃষকরা।
আদিতমারী উপজেলার বড়াবাড়ি গ্রামের চাষি মনসুর আলী বাংলানিউজকে জানান, স্বাস্থ্য ক্ষতিসহ জমির উর্বরতা রোধে গত বছর তামাক চাষ ছেড়ে দিয়ে দুই বিঘা জমিতে আলু চাষ করেন। বাম্পার ফলন পেলেও বাজার মূল্য কম থাকায় উৎপাদন খরচ তুলতে পারেন নি। তাই বাধ্য হয়ে এ বছর আলু চাষ ছেড়ে পুনরায় তামাক চাষ করেছেন।
তিনি বলেন, পরিশ্রম ও টাকা খরচ করে চাষাবাদে লাভের জায়গায় লোকসান হলে পরিবার চলবে কিভাবে? বিকল্প লাভজনক ফসল পেলে তামাক চাষ চিরদিনের জন্য ছেড়ে দেবো।
সারপুকুর ইউনিয়নের চাষি কৃষিবিদ হযরত আলী বাংলানিউজকে জানান, দুই বছর আগে আদিতমারী উপজেলা কৃষি অফিস থেকে স্ত্রীর নামে প্রদর্শনী নিয়ে তামাকের জমিতে ভুট্টা চাষ করেন। প্রদর্শনীর জন্য সেচ খরচের টাকা ব্যাংকের মাধ্যমে পেয়েছেন। বিনামূল্যে বীজ সার দেয়ার কথা থাকলেও জেলা থেকে মন্ত্রণালয় পর্যন্ত লিখিত অভিযোগ করার দুই বছরেও সদুত্তর পাননি।
তিনি বলেন, একজন কৃষিবিদ হয়েও বছরের পর বছর ঘুরে প্রদর্শনীর ন্যায্য পাওনা সরকারি বীজ সার পাইনি। সেখানে সাধারণ কৃষকরা কতটুকু সরকারি সেবা পাচ্ছে তা খুব সহজেই অনুমেয়। এ কারণেই সরকারি কৃষি বিভাগের কথা ভুলে কৃষকরা তামাক কোম্পানির পরামর্শে করছেন তামাক চাষ।
সদর উপজেলার কালমাটি গ্রামের চাষি হবিবুর রহমান, মালেক ও রশিদ মিয়া জানান, স্বাস্থ্য ক্ষতি বা জমির ক্ষতি নয়, যে ফসলে মুনাফা বেশি গরিব কৃষকরা সেই ফসলই চাষ করেন। কারণ লোকসান হলে পরিবার পরিজন নিয়ে না খেয়ে তাদের মরতে হবে। আসল কৃষকরা নয়, প্রতি বছর কৃষি প্রণোদনা ও প্রদর্শনী কৃষি অফিসের পরিচিত প্রভাবশালী অপেশাদার কৃষকরা পাচ্ছেন বলেও অভিযোগ তাদের।
চলতি বছরও আলুর বাজারে ধ্বস নেমে ক্রমান্বয়ে কমে যাওয়ায় আগামীতে বাজার সৃস্টি না হলে তামাক চাষ আরো বাড়তে পারে বলে মনে করেন কৃষকরা। বর্তমান বাজারে কৃষকদের আলু প্রতি কেজি আকার ভেদে ৪/৬ টাকা মূল্যে বিক্রি হচ্ছে। বহুমুখী ব্যবহারের মাধ্যমে আলু ও ভুট্টার বাজার সৃস্টি করতে পারলে তামাকের বিকল্প ফসল হিসেবে চাষিরা আলু ও ভুট্টা চাষ করত। তবেই বিষবৃক্ষ তামাক চাষ এ অঞ্চল থেকে বিদায় নিত। অন্যথায় সরকারের তামাকমুক্ত দেশ গড়ার ভিশন ভেস্তে যাবে বলে দাবি কৃষক ও কৃষি সংশ্লিষ্টদের। লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতর সূত্রে জানা গেছে, গত বছর লক্ষ্যমাত্রা অতিক্রম করে এ জেলায় ৫ হাজার ৩৮৫ হেক্টর জমিতে প্রায় এক লাখ ২৫ হাজার ১৪০ মেট্রিক টন আলু উৎপাদিত হয়েছে। এ বছর কমে গিয়ে আলু চাষ হয়েছে ৪ হাজার ৬২০ হেক্টর জমিতে। যার উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ধরা হয়েছে মাত্র ৯৫ হাজার মেট্রিক টন। আর তামাক গত বছর চাষ হয়েছিল ৮ হাজার ৫০ হেক্টর জমিতে। চলতি বছর তা বেড়ে গিয়ে চাষ হয়েছে ৯ হাজার একশ’ হেক্টর জমিতে। আলু চাষ কমে যাওয়ায় তামাক চাষ বেড়েছে।
লালমনিরহাট কৃষি সম্প্রসারণ অধিদফতরের উপ পরিচালক বিদু ভূষণ রায় বাংলানিউজকে জানান, কৃষকরা যে ফসলে মুনাফা বেশি পান, সেই ফসল চাষেই ঝুঁকে পড়েন। গতবছর আলুর চাষাবাদের মতই ফলনও হয়েছে বাম্পার। তবে মূল্য কম পাওয়ায় কৃষকরা খুব একটা লাভবান হতে পারেনি। তবে তামাক চাষে কৃষকদের নিরুৎসাহিত করতে কৃষি বিভাগের পক্ষ থেকে নিয়মিত সভা সেমিনার করা হচ্ছে বলেও দাবি করেন তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৫৭ ঘণ্টা, জানুয়ারি ২৯, ২০১৯
আরএ