দেশের গোলাপ ফুলের চাহিদার সিংহভাগ আসে সাভারের বিরুলিয়া থেকে। শুধু গোলাপই নয় এই এলাকাজুড়ে অনেক ধরনের ফুল চাষ হয়।
আগামী ১০ ফেব্রুয়ারি থেকে বিরুলিয়ার চাষিরা বসন্ত বরণ, বিশ্ব ভালোবাসা দিবস ও আন্তর্জাতিক মাতৃভাষা দিবসের জন্য বাজারে ফুল সরবরাহ করে আসছেন। ইতোমধ্যে প্রতিদিন সূর্য অস্ত যাওয়ার সঙ্গে সঙ্গে দেশের বিভিন্ন প্রান্ত থেকে আসা পাইকার ও খুচরা ব্যবসায়ীরা ফুল কিনতে ভিড় জমাচ্ছেন এই ফুলের রাজ্যে।
কৃষি অফিস সূত্রে জানা গেছে, সাভার উপজেলার বিভিন্ন এলাকায় ৫০০ হেক্টর জমিতে গোলাপের চাষ হয়। এর মধ্যে সবচেয়ে বেশি চাষ হয় বিরুলিয়ার মোস্তাপাড়া, ভাগ্নিবাড়ি, সাদুল্যাপুর ও শ্যামপুর এলাকায়।
বিরুলিয়ার কয়েকটি গ্রাম ও বাজার ঘুরে দেখা গেছে- সড়কের পাশে, বাড়ির সামনে এমনকি শিক্ষা প্রতিষ্ঠানের সামনের ফাঁকা জায়গাতে ফুলের চাষ করা হয়েছে। দুপুরের পর প্রতিটি বাগানেই শ্রমিকদের ব্যস্ততা শুরু হয়ে যায়। ফুল কাটা, বাছাই, ভেজানো, বাঁধা সবকিছুই কৃষক সন্ধ্যার আগেই শেষ করেন। কারণ সন্ধ্যার পরই জমে ওঠে মোস্তাপাড়া ও শ্যামপুর ফুল বাজার। ব্যবসায়ীরা এই ফুল কিনে দেশের সর্ববৃহত ফুল মার্কেট ঢাকার শাহবাগে সরবরাহ করেন। এছাড়াও চট্টগ্রাম, খুলনা, বরিশাল, রাজশাহীসহ সড়ক পথে দেশের বিভিন্ন স্থানে ফুল সরবরাহ করে আসছেন পাইকাররা। বিরুলিয়া গ্রামবাসীদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, ১৯৯০ সালে ঢাকার কয়েকজন যুবক অন্যের জমি লিজ নিয়ে এই এলাকায় বাণিজ্যিকভাবে প্রথম গোলাপ চাষ শুরু করেন। ফলন ভালো আর ওই যুবকদের সফলতা দেখে স্থানীয়রাও ধীরে ধীরে বাণিজ্যিকভাবে গোলাপ চাষ শুরু করেন। খুব কম সময়ের মধ্যে গ্রামটিতে গোলাপের চাষ জনপ্রিয় হয়ে ওঠে।
ফুলের বাগানে দেখা হয় কৃষক ফকির চাঁনের সঙ্গে। তিনি বলেন, এর আগের বছর আমাদের ওপর দিয়ে অনেক ঝড় গেছে। ফুলে রোগের আক্রমণ হয়েছিল তাই ভালো ফলন হয় নাই। ফুল বেশি বিক্রিও করতে পারি নাই। তবে এবার কোনো ঝামেলা নাই ভালো ফলন হয়েছে। এবার মনে হয় ঘরে কিছু টাকা আসবে।
তিনি আরও বলেন, আমি এখানে মেরিন্ডা, হাজারি, লিংকন, গাঁদা, গ্লাডিওলাস, জারবেরা, লাল গোলাপের চাষ করি। তবে বাজারে চাহিদা বেশি লাল গোলাপের।
সাভার সিটি ইউনির্ভাসিটির শিক্ষার্থী মাসুদ বাংলানিউজকে বলেন, বাবার সঙ্গে আমি মাঝে মাঝে কাজ করতে আসি ফুল বাগানে। এখন তো ফুলের মৌসুম এই সময়টি বেচা-কেনা হয় ভালো তাই বাবাকে সাহায্য করছি। ১১০ শতাংশ জায়গায় গোলাপের চাষ করেছেন বাবা। ১৬ ডিসেম্বর, ১৪ ফেব্রুয়ারি (ভালোবাসা দিবস), ২১ ফেব্রুয়ারি, ১লা বৈশাখসহ বিশেষ বিশেষ দিনে ফুলের চাহিদা বেড়ে যায় কয়েকগুন। দামও পাওয়া যায় ভালো।
বিরুলিয়া ফুল চাষি সমিতির আহ্বায়ক মুহাম্মদ নাসির বাংলানিউজকে বলেন, বসন্ত বরণ ও ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে ইতোমধ্যে বাজার জমে উঠেছে। প্রতিদিন বিরুলিয়ার বাজারে প্রায় আড়াই থেকে তিন লাখ টাকার ফুল বিক্রি হচ্ছে। বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে গোলাপ ফুলের সর্বোচ্চ চাহিদা থাকে, বিষয়টি মাথায় রেখে লাভবান হতে আমরা গোলাপের চাষ করি।
এ বছরও বিরুলিয়া এলাকার প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে গোলাপসহ নানা রকম ফুল চাষ করেছেন স্থানীয় চাষিরা। তবে মাসখানেক ধরে শীতের তীব্রতা থাকায় উৎপাদন কিছুটা ব্যাহত হয়েছে। পাইকারি ব্যবসায়ীদের ফুল সরবরাহ করতে হিমশিম খেতে হলেও তা সামলে নিচ্ছি আমরা।
তিনি আরও বলেন, যদি সরকার ফুল রফতানিতে ভূমিকা রাখতো তবে এর চেয়ে বেশি গোলাপ বিক্রি হতো বাজারগুলোতে। এ গ্রামের ৯০ শতাংশ মানুষ জীবিকা নির্বাহ করেন এই ফুল চাষ করে।
ফুলচাষিরা বলেন, সারাদেশে বিভিন্ন দিবস উপলক্ষে যে ফুল বেচা-কেনা হয় তার অনেকটাই পূরণ করে বিরুলিয়ার উৎপাদিত ফুল। আসছে ১৩ ফেব্রুয়ারি বসন্ত বরণ, ১৪ ফেব্রুয়ারি বিশ্ব ভালোবাসা দিবস, ২১ ফেব্রুয়ারি ভাষা দিবস, ২৬ মার্চ স্বাধীনতা দিবসে এ অঞ্চলের ফুলচাষিরা কমপক্ষে ৫-৭ কোটি টাকার ফুল বিক্রির টার্গেট নিয়েছেন। এর মধ্যে বিশ্ব ভালোবাসা দিবসকে সামনে রেখে চলতি সপ্তাহের শুরু থেকে এ পর্যন্ত ফুল হাটে কোটি টাকার বেচা-কেনা হয়েছে।
কয়েক বছর ধরে বিভিন্ন গণমাধ্যম ও সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে ব্যাপক প্রচার হওয়ায় অসংখ্য দর্শনার্থী বিরুলিয়ার ফুল বাগান দেখতে আসেন। যে কারণে গত বছর ফুলে বিভিন্ন রোগের আক্রমণ হয়েছিলে বলে দাবি করেন ফুল চাষিরা। রোগের আক্রমণের কারণ হিসেবে অতিরিক্ত দর্শনার্থীর চাপ ও তাদের অবাধ বিচরণকেই দায়ী করেছেন তারা।
স্থানীয় পাইকারি ব্যবসায়ীরা জানান, এবার বিশ্ব ভালোবাসা দিবসে বেশি ফুল বিক্রি হবে। বাজারে জারবেরা, গোলাপ, রজনীগন্ধা ফুলের চাহিদা বেশি। কৃষকরাও ভালো দাম পাবেন। আমরা দেশের বিভিন্ন স্থান থেকে অর্ডার পাচ্ছি। তাদের চাহিদা মতো ফুল সরবরাহ করার জন্য প্রস্তুত আছি।
সাভার উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা মো. শহিদুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, সাভারের বিরুলিয়ায় প্রায় ৫০০ হেক্টর জমিতে ফুলের চাষ হচ্ছে। এ গ্রামের অধিকাংশ মানুষ ফুল চাষ করেই জীবিকা নির্বাহ করেন। একর প্রতি ফুল উৎপাদন খরচের তুলনায় লাভ বেশি পাওয়ায় দিন দিন কৃষকরা ফুল চাষে ঝুকছেন।
তিনি আরও বলেন, পহেলা ফাল্গুন থেকে শুরু করে সামনে তিনটি দিবস। এ জন্য এই গ্রামে এখন উৎসব বইছে। গত বছরের তুলনায় এবছর ফুলের ফলন ভালো হয়েছে। সতেজ ও টাটকা অবস্থায় ঢাকার বাজারে বিক্রি করায় দামও বেশি পাচ্ছেন কৃষক ও ব্যবসায়ীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০১৫৬ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
আরএ