এ সফরেই বঙ্গবন্ধু সরকারি চাকরিতে কৃষিবিদদের মর্যাদা দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণি করার প্রতিশ্রুতি দেন এবং কিছুদিন পরেই তা বাস্তবায়ন করেন। বঙ্গবন্ধুর এ অবদান স্মরণীয় করে রাখতে ২০১১ সাল থেকে কৃষিবিদরা এ দিনটিকে ‘কৃষিবিদ দিবস’ হিসেবে পালন করে আসছেন।
আজ বাংলাদেশ খাদ্যে স্বয়ংসম্পূর্ণতার দ্বার প্রান্তে। কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েই স্বয়ংসম্পূর্ণতার প্রথম ধাপটি স্থাপন করেন জাতির পিতা। সেদিনের সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে শেখ মুজিব বক্তব্য রাখেন। সেই বক্তৃতাতেই তিনি সরকারি চাকরিতে কৃষিবিদদের দ্বিতীয় শ্রেণি থেকে প্রথম শ্রেণি করার প্রতিশ্রুতি দেন। এর কিছুদিন পরেই বঙ্গবন্ধু তার প্রতিশ্রুতি বাস্তবায়ন করেন। এজন্যই ওই বক্তৃতা কৃষিবিদদের কাছে আজও ঐতিহাসিক ও তাৎপর্যপূর্ণ। চাকরিতে কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির স্বীকৃতি দেওয়ার কারণেই মেধাবী শিক্ষার্থীরা কৃষিতে পড়তে আসেন। মেধাবী কৃষিবিদরা নিরলস গবেষণা করে দেশে চাষ উপযোগী বিভিন্ন ফসলের উন্নত জাত উদ্ভাবন করছেন। যার সুফল পাচ্ছে সারা দেশের মানুষ।
বঙ্গবন্ধুর আগমন উপলক্ষে সেদিন বাকৃবি ক্যাম্পাস সাজানো হয়েছিল অপরূপ সাজে। সার্কিট হাউজ থেকে তৎকালীন উপাচার্য অধ্যাপক ড. কাজী ফজলুর রহিম, বাকসুর জি এস আব্দুর রাজ্জাক (বর্তমান কৃষিমন্ত্রী), ছাত্রলীগ সভাপতি মো. রহমতুল্লাহ, সাধারণ সম্পাদক মো. রফিকসহ অনেকে বঙ্গবন্ধুকে অভ্যর্থনা জানিয়ে সংবর্ধনাস্থলে নিয়ে আসেন। জয় বাংলা বাহিনীর এক সুসজ্জিত দল বঙ্গবন্ধুকে গার্ড অব অনার দেয়। বাকসুর সেই সময়ের ভিপি মুক্তিযোদ্ধা নজিবুর রহমান অনুষ্ঠান পরিচালনা করেছিলেন।
অনুষ্ঠানে আয়োজকরা বঙ্গবন্ধুকে ‘বাংলার উৎফুল্ল কৃষক’ নামে একটি আলোকচিত্র এবং ‘বাংলাদেশের কৃষি’ শিরোনামে একটি কাঠের শোপিস উপহার দিয়েছিলেন। অনুষ্ঠানে মানপত্র পাঠ করেছিলেন তৎকালীন বাকসু’র সাধারণ সম্পাদক আব্দুর রাজ্জাক (বর্তমান কৃষিমন্ত্রি)। এছাড়া বিশ্ববিদ্যালয়ের পশুপালন বিভাগের পক্ষ থেকে বঙ্গবন্ধুকে শিক্ষার্থীদের হাতে বোনা একটি কম্বল উপহার দেওয়া হয়। অনুষ্ঠানে জাতির পিতাকে আলোকচিত্রি নাইব উদ্দিন আহমেদের মুক্তিযুদ্ধ ভিত্তিক ফটো অ্যালবাম উপহার দেয় বাকসু। বিশ্ববিদ্যালয় কর্তৃপক্ষ ‘বিশ্ববিদ্যালয় বার্তা’র বিশেষ সংখ্যা বঙ্গবন্ধুকে উপহার দেয়।
পরে বঙ্গবন্ধু বিশ্ববিদ্যালয় শাখা ছাত্রলীগের অফিসে শহীদ স্মৃতি পাঠাগার উদ্বোধন করেন। পাঠাগারের বই কেনার জন্য পাঁচ হাজার টাকা, দু’টি ট্রাক এবং ছাত্রদের পুনর্বাসনের জন্য নগদ এক লাখ টাকা দেন বঙ্গবন্ধু।
সংবর্ধনা অনুষ্ঠানে জাতির পিতা তার বক্তৃতায় বলেছিলেন, অন্যান্য ইঞ্জিনিয়ার-ডাক্তারদের যে মর্যাদা, কৃষি গ্র্যাজুয়েটদেরও সে মর্যাদা দিতে হবে। কোনো মর্যাদা দিতে কোনো আপত্তি আমার নাই। তবে আমি যে এডমিনিস্ট্রেটিভ রি-অরগানাইজেশন কমিশন করেছি, পে-কমিশন করেছি, তাদের রিপোর্ট না আসা পর্যন্ত আমাকে কথা দেওয়া চলবে না। তারপরে আমি কথা দেবো। এর আগে আমি কথা দিতে পারবো না। এই জন্য যে, এডুকেশন কমিশন করেছি সঙ্গে এডমিনিস্ট্রেটিভ রি-অরগেনাইজেশন কমিশন করেছি এবং দুই কমিশনের কাজ আরম্ভ হয়েছে। আশা করি, দুই/তিন মাসের মধ্যে এ কাজ শেষ হয়ে যাবে। যদি তারপরে আপনাদের কোনো আপত্তি থাকে তারপরে আমার হাতে কিছু ক্ষমতা থাকতে পারে।
তিনি আরো বলেছিলেন, তবে আশা করবো, কমিশন রিপোর্ট আসা পর্যন্ত আপনারা ধৈর্য ধরে দেরি করবেন। কারণ, আপনারা জানেন না যে এডমিনিস্ট্রেশন বলে যে পদার্থটি আমাদের কপালে আসিয়া জুটিয়াছে তাকে এডমিনিস্ট্রেশন বলা চলে না। ১৩৩ ধাপও আছে। ৩৩ ধাপও আছে। ৪৪ ধাপও আছে। লোয়ার ডিভিশন, আপার ডিভিশন, সিনিয়র ডিভিশন, অনেক কিছু। তাই বলছি, সব এক করে ফেল। সাফ করে ফেল। ১, ২, ৩, ৪, ৫, ৬, ৭। আমি ৭ পর্যন্ত সাজেশন দিয়েছি। তারা কেউ বলেছেন ১১ দরকার, ১২ দরকার, আমি তাদের ওপর বাধা দিতে চাই না। আমি বলেছি, আপনারা এক্সপার্ট, আপনারা সেটা চিন্তা করে দেখেন। আপনারা দেখুন কতো পর্যন্ত পারেন। একটি রি-অরগেনাইজেশন করা দরকার। তখন বিবেচনা করে দেখা যাবে, আমি কথা দিতে পারলাম না সেজন্য দুঃখিত। আপনারা নিশ্চয়ই দুঃখিত হবেন না।
কৃষিবিদদের গ্রামে গ্রামে কাজ করার আহ্বান জানিয়ে শেখ মুজিব বলেছিলেন, কৃষি বিপ্লবের কথা বলছি। আমাদের নজর গ্রামের দিকে দিতে হবে। কৃষকদের রক্ষা করতে হবে। আর একটু বলতে চাই। ফ্রেগমেনটেশান অব ল্যান্ড দেশে আছে, সে কারণে কালেকটিভ ফার্ম-এর দিকে যদি না যাওয়া যায় তবে অধিক শস্য উৎপাদন সম্ভব হবে না। সেদিকে মানুষকে শিক্ষিত করে তুলতে হবে। জোর করে কিছু চাপিয়ে দেওয়া চলবে না। করে দেখাতে হবে–এই গ্রামের ২০ জন লোক এক সঙ্গে ক্ষেত-খামার করছে, এ উৎপাদন বেড়েছে। তখন সব লোকেরা এগিয়ে আসবে। সেদিকে নজর দিতে হবে। কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়ে যারা শিক্ষিত হচ্ছেন, আপনাদের সেদিকে বেশি নজর দিতে হবে। এখন ভুলে যান শহরমুখো রাজনীতির কথা।
বক্তব্যের শেষ দিকে বঙ্গবন্ধু বলেছিলেন, এতদিন আপনাদের দাম বাড়ে নাই। এখন আপনাদের দরকার হবে। আমি আপনাদের ধন্যবাদ দিচ্ছি। বিশেষ করে উপাচার্যকে, আপনাদের শিক্ষকমণ্ডলী, যারা আমার বন্ধুবান্ধব, আমার সহকর্মী এখানে আছেন, যাদের সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে ছিলাম বা কোলকাতাতে পড়েছি বা দেখা হয়েছে অনেকের সঙ্গে এখানে যারা রয়েছেন তাদের আন্তরিক ধন্যবাদ দিচ্ছি। কৃষি বিপ্লব করতে চাই। আপনাদেরও একটু গ্রামমুখি হওয়া দরকার। আর দেশের অবস্থা খুবই খারাপ। চিন্তা করতে হবে, আপনাদেরকেও কাজ করতে হবে।
বঙ্গবন্ধুই এদেশে কৃষি বিপ্লবের সূচনা করেছিলেন। বেশ কিছু যুগান্তকারী পদক্ষেপও নিয়েছিলেন। তার মধ্যে আধুনিক কৃষি গবেষণার ব্যবস্থা করা, কৃষিতে ভর্তুকি প্রদান, কৃষিঋণের সহজীকরণ ও সমবায় চাষ পদ্ধতির প্রচলন অন্যতম। কিন্তু দুঃখের বিষয়, ১৯৭৫ সালের ১৫ আগস্ট ঘাতকের নির্মম বুলেটের আঘাতে সপরিবারে না ফেরার দেশে চলে যান সারাবাংলার মেহনতি মানুষের নেতা বঙ্গবন্ধু। বঙ্গবন্ধুকে হত্যার সঙ্গে সঙ্গে দেশের কৃষির অগ্রযাত্রাও স্থিমিত হয়ে যায়।
দেশের কৃষি ও কৃষকের প্রতি বঙ্গবন্ধুর মমতা ছিল অপরিমেয়। তিনি জানতেন যে কৃষির উন্নয়ন করতে হলে আগে কৃষি গবেষণার দিকে জোড় দিতে হবে। কৃষি গবেষণায় মেধাবীদের উদ্বুদ্ধ করতে তিনি কৃষিবিদদের প্রথম শ্রেণির মর্যাদা দিয়েছিলেন। তাইতো কৃষিবিদরা আজও কৃতজ্ঞ চিত্তে বলেন ‘বঙ্গবন্ধুর অবদান, কৃষিবিদ ক্লাস ওয়ান’।
বাংলাদেশ সময়: ১২৪৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ১৩, ২০১৯
এসআই