এতে করে দিন দিন কমে যাচ্ছে আবাদযোগ্য ভূমি আর হ্রাস পাচ্ছে কৃষি উৎপাদন।
উত্তরবঙ্গের প্রাকৃতিক সৌন্দর্যের লীলাভূমি চলনবিল।
এ চলনবিলেরই বিশাল একটি অংশ সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলায়। এ অঞ্চলের জমি উর্বর পলি সমৃদ্ধ হওয়ায় ইরি-বোরো মৌসুমে বিপুল পরিমাণ ধান, শীত মৌসুমে রবিশস্য উৎপাদন হয়ে থাকে।
কিন্তু নানা প্রতিকূলতায় চলনবিল নিজের অপার সৌন্দর্য হারাতে বসেছে। গত কয়েক বছর ধরে বিলের মাঝখানে যত্রতত্র পুকুর খননের কারণে বিলের মধ্যাঞ্চলে সৃষ্টি হচ্ছে জলাবদ্ধতা।
সচেতন মহল মনে করছে, অবাধ পুকুর খননের কারণে ভবিষ্যতে হয়তো এ অঞ্চলে আবাদযোগ্য কোনো জমিই থাকবে না। শস্যভাণ্ডার চলনবিল শুধুই মৎস্যভাণ্ডারে পরিণত হবে।
সরেজমিন দেখা যায়, কিছু প্রভাবশালী মাটি ব্যবসায়ীর প্রলোভনে পড়ে কৃষকরা তাদের দুই বা তিন ফসলি জমি পুকুরে পরিণত করছেন। মাটি ব্যবসায়ীরা কয়েকজন কৃষকের জমি পাঁচ/সাত বছরের জন্য লিজ নিয়ে শুরু করেছেন পুকুর খনন। বছরে বিঘা প্রতি ১৮ থেকে ২৫ হাজার টাকা পর্যন্ত কৃষককে দেওয়া হচ্ছে। নগদ টাকার নেশায় কৃষকরা একের পর এক পুকুরের দিকেই ঝুঁকছেন।
রায়গঞ্জ উপজেলার ধুবিল, নইপাড়া, উল্লাপাড়ার সলঙ্গা, উনুখাঁর দিঘী, তাড়াশ উপজেলার লক্ষ্মীপুর, মহিষলুটি, মান্নানগর, দীঘি সগুনা, নওগা, কুন্দইলসহ বিভিন্ন এলাকা ঘুরে অবাধ পুকুর খননের চিত্র দেখা যায়।
কথা হয় আবুল কাশেম, বিদু আলী, সোলায়মান আলী, আব্দুস ছাত্তার, আফসার আলী, মজিদ শেখসহ বিভিন্ন এলাকার কৃষকদের সঙ্গে। তারা জানান, ধান, গম, আলু, রবিশস্যসহ অন্যান্য খাদ্যশস্য উৎপাদন করতে যে পরিমাণ খরচ হয় তা বিক্রি করে উৎপাদন খরচও ওঠে না। পুকুর কেটে লিজ দিলেও বছরে ২০/২৫ হাজার টাকা বিনা পরিশ্রমে পাওয়া যায়। তাছাড়া কয়েক বছর আগে থেকেই বিলের মধ্যে প্রভাবশালী ব্যক্তিরা পুকুর খনন শুরু করেন। এ কারণে নির্মিত ওইসব পুকুরের আশপাশের জমিগুলোও জলাবদ্ধ হয়ে অনাবাদি পড়ে থাকে। অপরদিকে, চলনবিল অঞ্চলের ছোট ছোট খালগুলো ভরাট করে রাস্তা কিংবা বাড়ি নির্মাণ করায় অনেকের জমিতে জলাবদ্ধতা সৃষ্টি হয়। ফলে এসব জমিতে বছরে একবারও আবাদ করা সম্ভব হয় না। এ কারণে ওইসব জমির মালিকরা বাধ্য হয়ে পুকুর খনন করছেন।
উল্লাপাড়ার জালশুকা গ্রামের কৃষক আবু ছাইদ, সাইফুল ইসলাম ও ওবায়দুর রহমান জানান, হাটিকুমরুল-বনপাড়া মহাসড়কের উত্তর পাশে একটি খাল ছিল। খালের মুখ ভরাট করে খন্দকার তৌফিকুর রহমান নামে এক প্রভাবশালী ব্যক্তি বেশ কয়েকটি পুকুর কেটেছেন। ফলে জালশুকা মৌজার সব জমিই বছরের বেশির ভাগ সময় জলাবদ্ধ থাকে। এ কারণেই বাধ্য হয়ে পুকুর নির্মাণ করতে হচ্ছে তাদের।
ভূমি পরিবর্তনে সংশ্লিষ্ট প্রশাসনের অনুমতি নিতে হয় বলার পর তাড়াশ উপজেলার ভিকমপুর গ্রামের সাবেক ইউনিয়ন পরিষদ সদস্য আব্দুস সাত্তার বলেন, আমার জমিতে আমি পুকুর কাটছি, এতে আবার কার অনুমতির প্রয়োজন?
একই গ্রামের আইয়ুবুর রহমানও ১০ বিঘা জমি জুড়ে পুকুর খনন করছেন। তিনি বলেন, ধানচাষে কোনো লাভ নেই। তাই আগেও আমি পুকুর কেটেছি। তার পাশে আরেকটি পুকুর খনন শুরু করেছি।
এ বিষয়ে কথা হয় মাছ ব্যবসায়ী খন্দকার তৌফিকুর রহমানের সঙ্গে। তিনি বলেন, চলনবিলের বুক চিড়ে মহাসড়ক হওয়ার পর থেকেই পুকুর খনন শুরু হয়। তবে তখন ছিল খুবই কম। বর্তমানে সেটা অনেক বেড়েছে। সাত বছর আগে আমরা সমবায় ভিত্তিতে বেশ কয়েকটি পুকুর খনন করি। সেখানে মাছ চাষ হচ্ছে।
কৈ মাঝুরিয়া গ্রামের আব্দুল করিম, আগরপুর গ্রামের আলমগীর রেজাসহ অনেক মাটি ব্যবসায়ী জানান, গত ১৫ বছর ধরে এ অঞ্চলে কৃষকদের পুকুর খনন করে দিচ্ছেন তারা। এতে কৃষকরা লাভবান হচ্ছেন। আগে জমি পরিবর্তন করতে অনুমোদনের প্রয়োজন পড়তো না। এখন অনেকেই উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তার (ইউএনও) অনুমোদন নেওয়ার চেষ্টা করছেন।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক আব্দুর রশিদ জানান, জেলার শস্যভাণ্ডার খ্যাত অঞ্চলগুলোতে ব্যাপক হারে পুকুর খননের বিষয়টি খুবই উদ্বেকজনক। এভাবে চলতে থাকলে ভবিষ্যতে কৃষি উৎপাদন আশঙ্কাজনক হারে হ্রাস পাবে। পুকুর খনন বন্ধে কার্যকরী পদক্ষেপ নেওয়ার জন্য মৌখিকভাবে জেলা প্রশাসনকে জানানো হয়েছে।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১৭ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৭, ২০১৯
এসআই