জেলা পাট অধিদফতরের কর্মকর্তাদের দাবি, জেলায় এবার পাটের উৎপাদন ভালো এবং পাটের চাহিদাও রয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এবার জেলায় পাটের আবাদ বেশি হয়েছে।
অর্থকরী ফসল হিসেবে চাষিদের কাছে পাটের গুরুত্ব রয়েছে। তবে চাষিদের ঘরে থাকা পর্যন্ত পাটের দাম বৃদ্ধি পায় না। কৃষকরা তাদের পাটের ন্যায্যমূল্য পায় না। এর পরিবর্তে মধ্যসত্বভোগী ও পাটের অসাধু ব্যবসায়ীরা অধিক লাভবান হচ্ছে বলে অভিযোগ পাট চাষিদের।
জেলা পাট অধিদফতরের দেওয়া তথ্যমতে, চলতি মৌসুমে কুষ্টিয়ায় পাট চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয় ৮৮ হাজার ৭৩৫ একর। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে চার লাখ ৭০ হাজার ৯৫১ বেল। চলতি মৌসুমে পাট চাষ হয়েছে ৮৯ হাজার ৫৩৫ একর জমিতে, যা লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৮০০ একর বেশি। আবহাওয়া অনুকূলে থাকায় এবার উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রাও অতিক্রম করবে বলেও জানা যায়।
এদিকে, ২০১৮ মৌসুমে ৬৮ হাজার ৮১৩ একর জমিতে পাট চাষ করা হয়েছিল। উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছিল তিন লাখ ২১ হাজার ৯০০ বেল। উৎপাদন হয়েছিল তিন লাখ ৬১ হাজার ৯৫৪ বেল। লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে ৪০ হাজার ৫৪ বেল বেশি উৎপাদন হয়েছিল। গত বছরের তুলনায় এবছর জেলায় পাট চাষ বেড়েছে ২০ হাজার ৭২২ একর।
এদিকে পাট চাষিদের দাবি, গত বছরের তুলনায় এবছর পাটের চাষ কম হয়েছে। উৎপাদন খরচ বৃদ্ধি, শ্রমিক সংকট, শ্রমিকের মূল্যবৃদ্ধি এবং কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পাওয়ায় পাট চাষে আগ্রহ হারাচ্ছেন তারা।
কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার পাটচাষি আব্দুল খালেক বাংলানিউজকে বলেন, গত বছর ৩ বিঘা জমিতে পাট চাষ করেছিলেন তিনি। এতে খরচ ও শ্রমিকের খরচ দিতেই হিমসিম খেতে হয়েছে। পাট নিড়ানি, পাট কাটা, পাটের আঁশ ছাড়ানোর সময় শ্রমিক পাওয়া যাচ্ছিলো না। আর পাওয়া গেলেও দ্বিগুণ মজুরি দিতে হয়েছে।
তিনি বলেন, এক বিঘা জমিতে পাট চাষ করতে নিড়ানি, কাটা, টানা, জাগ দেওয়া, আঁশ আলাদা করা, শুকাতে প্রায় ৩৩ জন শ্রমিক লাগে। জনপ্রতি ৩০০ টাকা করে দেওয়া লাগলে এতে প্রায় ১০ হাজার টাকা খরচ হয়ে যায়। এছাড়া জমি এবং সার-বীজ তো আছেই। সব চেয়ে বড় সমস্যা হলো টাকার জন্যই পাট চাষ করছি, তবে আমাদের ঘরে যখন পাট থাকে তখন পাটের বাজার দর মণপ্রতি ৯০০ থেকে এক হাজার ২০০ টাকা হয়। আর যখন কৃষকের ঘরে পাট থাকে না তখন এক হাজার ৮০০ থেকে দুই হাজার ২০০ পর্যন্ত হয়। এক বিঘা জমিতে ৭-৮ মণ পাট হয় বলেও জানান তিনি।
তিনি আরও বলেন, আমরা তামাকের চাষ করি। তামাক পোড়ানোর ঘরের জন্য পাট কাঠির প্রয়োজন হয়। এজন্য আমরা লাভ-লোকসানের হিসাব না করে পাট চাষ করছি। এবার দুই বিঘা জমিতে পাটের চাষ করেছি। পাট ভালোই হয়েছে, তবে আমরা তো সঠিক দাম পাবো না। দাম পাবে ব্যবসায়ীরা।
কৃষাণী বিউটি খাতুন বাংলানিউজকে বলেন, একই জমিতে বার বার পাট চাষ করলে উৎপাদন একটু কম হয়। কৃষকরা যদি পাটের সঠিক দাম পায় তাহলে পাট চিকন হলেও লাভ হয়। শ্রমিকের খরচ বেড়ে যাওয়া লোকসানের সম্ভাবনা বেশি হতে পারে বলেও জানান ওই কৃষাণী।
পাট চাষি শরিফুল ইসলাম বাংলানিউজকে বলেন, জাগ দেওয়ার পর পাটের আঁশ আলাদা করার ক্ষেত্রে একজন শ্রমিক দিনে ১৫ আটি পাট ধুয়ে থাকে। ওই শ্রমিক মুজরি নেন ৫০০ টাকা। পাট কাটা, টানা, আঁশ ছাড়ানোর হিসাব করলে এক আটি পাট প্রায় ৫০ টাকা খরচ হয়ে যায়।
‘গত বছর ১২ কাঠা জমিতে পাটের চাষ করেছিলাম। সেই পাট মাত্র দুই হাজার টাকায় বিক্রি করেছি। অতিরিক্ত লোকসান হওয়ায় এবছর পাটের চাষ করিনি’—জানান পাট চাষি লালন আলী।
ক্ষোভ নিয়ে পাট চাষি আলফাত হোসেন বলেন, পাট জাগ দেওয়ার জন্য পর্যাপ্ত পুকুর, খাল-বিল-জলাশয় নেই। আর পাটের সঠিক দাম তো কৃষক পায় না, পায় ব্যবসায়ীরা। তো তারাই পাট চাষ করুক।
মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে বলেন, অধিকাংশ কৃষক গরিব হওয়ায় তারা পাট শুকিয়ে তাড়াহুড়ো করে বিক্রি করে দেয়, এতে তারা পাটের সঠিক দাম পায় না। সরকারিভাবে পর্যাপ্ত পাট ক্রয় কেন্দ্র না থাকায় ব্যবসায়ীরা কৃষকদের দুর্বলতার সুযোগ নেয়।
তিনি বলেন, এ অঞ্চলের মাটি পাট চাষের জন্য খুবই উপযোগী। এ অঞ্চলে তোষা পাটে চাষ বেশি হয়ে থাকে। এবছর পাটে তেমন কোন পোকামাকড় দেখা দেয়নি। আশা করছি পাটের উৎপাদন ভালো হবে।
জেলা পাট অধিদফতরের মুখ্য পাট পরিদর্শক সোহরাব উদ্দিন বিশ্বাস বাংলানিউজকে বলেন, বর্তমানে পাটের বাজার দর এক হাজার ৯২০ টাকা থেকে দুই হাজার ২০০ টাকা পর্যন্ত। কৃষকদের পাট চাষে উদ্বুদ্ধ করতে জেলার প্রায় তিন হাজার পাট চাষিকে প্রশিক্ষণ দেওয়া হয়েছে। সেইসঙ্গে এক হাজার ৮০০ কৃষককে বিনামূল্যে সার ও বীজ দেওয়া হয়েছে।
তিনি বলেন, পাটের চাহিদা বৃদ্ধিতে নিয়মিত বাজার মনিটরিং করা হচ্ছে। ‘পাটজাত মোড়কের বাধ্যতামূলক আইন-২০১০’ নিশ্চিতে কুষ্টিয়া জেলায় ২০১৪-১৫ অর্থবছর থেকে এ পর্যন্ত ২০৯টি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করা হয়েছে। এসময় সাত লাখ ৬১ হাজার ৩০০ টাকা জরিমানা আদায় হয়েছে। এ অভিযান অব্যাহত থাকবে বলেও জানান তিনি।
প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি পাট ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা প্রয়োজন জানিয়ে সোহরাব উদ্দিন বলেন, জেলার খোকসা উপজেলায় একটি মাত্র বিজিএমসি’র পাটক্রয় কেন্দ্র রয়েছে। পরিবহন এবং আর্থিক সংকটের কারণে প্রান্তিক কৃষকরা সেখানে তাদের পাট না নিয়ে গিয়ে স্থানীয় বাজারে বিক্রি করেন। এতে প্রান্তিক কৃষকরা ন্যায্যমূল্য না পেয়ে আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
প্রতিটি উপজেলায় কমপক্ষে একটি করে সরকারি পাট ক্রয়কেন্দ্র স্থাপন করা হলে প্রান্তিক কৃষকরা তাদের পাটের ন্যায্যমূল্য পেতে পারেন বলেন মনে করেন এ কর্মকর্তা।
বাংলাদেশ সময়: ১৬১২ ঘণ্টা, জুলাই ১৫, ২০১৯
জিপি