সম্প্রতি চলনবিল অধ্যুষিত সিরাজগঞ্জের তাড়াশ, রায়গঞ্জ ও উল্লাপাড়া উপজেলায় সরেজমিন গিয়ে দেখা যায়, গত কয়েক বছর ধরেই জমির শ্রেণি পরিবর্তন করে পুকুর বা জলাশয় তৈরি প্রক্রিয়া চলছে। গত দুই বছরে এর পরিমাণটা আশঙ্কাজনকহারে বেড়ে গেছে।
এ বিষয়ে জানতে চাইলে গোলাম কিবরিয়া পিনু বাংলানিউজকে বলেন, স্থানীয় আওয়ামী লীগের নেতাদের সঙ্গে নিয়ে যৌথভাবে এই পুকুর খনন করছি। উপজেলা প্রশাসনের সঙ্গেও কথা বলেছি।
একই উপজেলার দবিরগঞ্জ এলাকায় মহাসড়কের সেতুর দু’পাশ মিলে অর্ধশতাধিক পুকুর তৈরি করা হয়েছে। এতে বন্ধ হয়ে গেছে সেতুর মুখ। জলাবদ্ধতায় কমে যাচ্ছে কয়েকশ’ একর জমির চাষাবাদ। তাড়াশে মহিষলুটি এলাকায় মহাসড়কের একটি সেতুর দক্ষিণপাশে বিশাল পুকুর খননযজ্ঞ চলমান রয়েছে। প্রভাবশালী আওয়ামী লীগ নেতা মিজানুর রহমান মাস্টার এ পুকুরটি খনন করছেন বলে স্থানীয়রা জানিয়েছেন। উপজেলা প্রশাসনের বাধা উপেক্ষা করে গত বছর নওগাঁ ইউনিয়নের চেয়ারম্যান মিজানুর রহমান মজনু ৪০ বিঘা জমিতে বিশাল পুকুর খনন করেছেন। ওই পুকুরকে ঘিরে সৃষ্ট জলাবদ্ধতা থেকে রক্ষা পেতে আশপাশের জমিগুলোতে পুকুর খনন করছেন কৃষকরা।
রায়গঞ্জ উপজেলার ধুবিল মেহমানশাহী গ্রামের সোহেল রানা পুকুর খনন করতে গিয়ে একটি মাটির সড়কের কালভার্টের মুখ বন্ধ করে দিয়েছেন। তিনি বলেন, আমি এ বছর ৪/৫টি পুকুর খনন করেছি। আমাম নর পুকুর খননে কেউ বাধা দেওয়ার সাহস পায়নি। এছাড়াও উল্লাপাড়ার রামকৃষ্ণপুর ইউনিয়নে মাটি ব্যবসায়ী আব্দুল করিম, লিটন, সোনাপাতিল গ্রামের হযরত আলী, তাড়াশ উপজেলার নওগাঁ ইউনিয়নের ভট্টমাঝিরা গ্রামের আল-আমিন, মহিষলুটি এলাকার জাহিদ, মিজান মাস্টার, হামকুড়িয়া গ্রামের আলাউদ্দিন, খালখুলার জাহিদ, ভায়াট গ্রামের শাহাদত, কাউরাইলের জাহাঙ্গীর, রায়গঞ্জের বাসুদেবকোল গ্রামের লিমন, সলঙ্গার নান্নু, আব্দুস সাত্তার, আড়ঙ্গাইল গ্রামের জান মাহমুদসহ কয়েকশত মাটি ব্যবসায়ী কৃষকদের অধিক মুনাফার লোভ দেখিয়ে ফসলি জমিতে খনন করছেন পুকুর।
কথা হয় বাসুদেবকোল গ্রামের আব্দুল কুদ্দুস, ধুবিলের হাফিজুর রহমান, রঙের বাজার এলাকার জয়নাল আবেদীন, জালশুকা গ্রামের শহীদুল ইসলাম, মহিষলুটির আব্দুল মজিদ, বাঙলার আবু মুসাসহ একাধিক কৃষকের সঙ্গে। এসব কৃষকদের দাবি এক বিঘা জমিতে ধান চাষ করে হাড়ভাঙ্গা খাটুনি খেটেও লাভ হয় না। অথচ এক বিঘা জমি পুকুর লিজ দিলে বছরে ২০/৩০ হাজার টাকা পাওয়া যায়। এ কারণেই আমরা পুকুর খনন করে মাছ চাষের জন্য লিজ দিচ্ছি।
কৃষকেরা আরও জানায়, চকের মাঝখানে প্রভাবশালীরা অনেক আগেই পুকুর খনন করে রেখেছে। এতে আশপাশের জমিগুলো জলাবদ্ধ হয়ে চাষাবাদ বন্ধ রয়েছে। বাধ্য হয়েই নিজের ফসলি জমিকে পুকুর পরিণত করতে হচ্ছে কৃষককে।
সিরাজগঞ্জ জেলা মৎস্য অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ অর্থবছরে জেলায় মোট পুকুর সংখ্যা ছিল ১৭ হাজার ৫৬টি। পরের দুটি অর্থ বছরে পুকুর সংখ্যা প্রায় পৌনে তিন হাজার বেড়ে দাঁড়িয়েছে ১৯ হাজার ৭৭০টিতে। এতে নতুন করে প্রায় প্রায় তিন হাজার হেক্টর জমি মৎস্য চাষের আওতায় এসেছে।
জেলা কৃষি বিভাগ সূত্র জানায়, এক যুগে প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর আবাদি জমি বিভিন্ন কারণে হ্রাস পেয়েছে। ২০০৫-০৬ অর্থবছরে এক লাখ ৮৭ হাজার ৬২৫ হেক্টর আবাদযোগ্য জমি ছিল। ২০১৫-১৬ অর্থবছর পর্যন্ত প্রায় সাড়ে পাঁচ হাজার হেক্টর কমে দাঁড়িয়েছে এক লাখ ৮২ হাজার ২০০ হেক্টরে।
জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপ-পরিচালক হাবিবুল হক জানান, পুকুর খননের কারণে বিপুল পরিমাণ কৃষি জমি কমে যাচ্ছে। আমাদের মাঠ পর্যায়ের কর্মকর্তারা কৃষকদের জমির শ্রেণি পরিবর্তণ না করার জন্য বোঝানোর চেষ্টা করছে।
তাড়াশ উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) ওবায়দুল্লাহ বাংলানিউজকে বলেন, আমরা অনেক স্থানে অভিযান চালিয়ে ভেকু মেশিনের চাবি নিয়ে এসেছি। কিন্তু দিনে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করা হলেও রাতের অন্ধকারে পুকুর খনন চলছে।
রায়গঞ্জ উপজেলার নির্বাহী কর্মকর্তা শামীমুর রহমান বাংলানিউজকে বলেন, এতো বেশি পরিমাণ পুকুর খনন হচ্ছে আমাদের বিদ্যমান জনবল তা দিয়ে আটকানো সম্ভব হচ্ছে না। সুনির্দিষ্ট নীতিমালা না থাকায় আইনগতভাবে বিষয়টি ফেস করতে আমাদের সমস্যা হচ্ছে।
সিরাজগঞ্জ জেলা প্রশাসক ড. ফারুক আহম্মেদ বাংলানিউজকে বলেন, পুকুর খনন বন্ধে সুস্পষ্ট কোনো নীতিমালা না থাকায় এর বিরুদ্ধে ব্যবস্থা নেওয়া সম্ভব হচ্ছে না। এরপরও অভিযোগ পেলে আমরা বিভিন্নস্থানে অভিযান চালিয়ে বন্ধ করার চেষ্টা করছি। এতেও বিশেষ কিছু করা সম্ভব হচ্ছে না। এ বিষয়ে নীতিমালা প্রণয়েনের জন্য ভূমি মন্ত্রণালয়ে সুপারিশ পাঠিয়েছি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯৩২ ঘণ্টা, মার্চ ০২, ২০২০
এনটি