ঢাকা, বুধবার, ১১ বৈশাখ ১৪৩১, ২৪ এপ্রিল ২০২৪, ১৪ শাওয়াল ১৪৪৫

কৃষি

ফিরছে গমের সুদিন, লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ চাষ কুষ্টিয়ায়

| বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম
আপডেট: ০৯০৭ ঘণ্টা, মার্চ ৫, ২০২০
ফিরছে গমের সুদিন, লক্ষ্যমাত্রার দ্বিগুণ চাষ কুষ্টিয়ায় গমক্ষেত। ছবি: বাংলানিউজ

কুষ্টিয়া: খাদ্যশস্যে ধানের পরেই রয়েছে গমের অবস্থান। কুষ্টিয়ায় এক সময়ে বিপুল পরিমাণে গম চাষ হতো। তবে ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ এবং তামাকের দাপটে পিঁছু হটতে বাধ্য হয় গমের আবাদ। ব্লাস্ট রোগের আক্রমণের ব্যাপক আকারে ক্ষতিগ্রস্ত হয় গম চাষিরা। এর পরেই বেশ কয়েকবছর মুখ ফিরিয়ে নেয় তারা। তবে বিগত বছরের তুলনায় এবছর কুষ্টিয়ায় রেকর্ড পরিমাণ গম চাষ হয়েছে। বলা চলে গমের সুদিন ফিরেছে কুষ্টিয়ায়। 

২০১৫-১৬ মৌসুমে কুষ্টিয়াসহ যশোর অঞ্চলের ৫ জেলায় (কুষ্টিয়া, মেহেরপুর, চুয়াডাঙ্গা, যশোর ও ঝিনাইদহ) মহামারী আকার ধারণ করে ছত্রাকজনিত রোগ ব্লাস্ট। পরের মৌসুমে এ ৫ জেলায় গম চাষের নিষেধাজ্ঞা দেয় কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তর।

এরপরেও কয়েকজন কৃষক নিষেধাজ্ঞা অমান্য করে গম চাষ করে ক্ষতিগ্রস্ত হয়। কৃষকরা প্রায় মুখ ফিরিয়ে নেয়, এ গম চাষ থেকে। পরে এসব গম চাষের জমি দখল করে নেয় বিষবৃক্ষ তামাক।  

তবে এ বছর কৃষি অফিসের পরামর্শে আবারো গম চাষ করছেন কৃষকরা। অনুকূল আবহাওয়া থাকায় গমও ভালো হয়েছে। তবে এবছর জেলায় কোথাও ব্লাস্টের আক্রমণ দেখা দেয়নি। তবে কিছু স্থানে দেখা দিয়েছে মরিচা রোগ। কৃষি অফিসের তৎপরতায় তা মোকাবিলা করতে সক্ষম হয়েছেন কৃষকরা। বর্তমানে রোগটি কৃষি বিভাগের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।  গমক্ষেত। কুষ্টিয়া জেলা শহর থেকে দূরে মেহেরপুর জেলার ও কুষ্টিয়া জেলার সীমান্তবর্তী উপজেলা মিরপুর ও দৌলতপুর। কুষ্টিয়ার অনান্য উপজেলার তুলানায় এ উপজেলা দুটিতে ২০১৫ সালে দেখা দেয় ব্লাস্ট রোগ। এর ফলে কমে যায় গমের উৎপাদন। কৃষকরা গম চাষের পরিবর্তে তামাক চাষ শুরু করে। কিন্তু এবছর চিত্রটা পাল্টে গেছে। বিগত দিনের মতো চাষিরা ঝুঁকেছে গম চাষে। কৃষি বিভাগের পরামর্শে তারা গম চাষ করে লক্ষ্যমাত্রার চেয়ে দ্বিগুণ ফলন হয়েছে।

মিরপুর উপজেলা কৃষি অফিস সূত্রে জানা যায়, ২০১৬-১৭ মৌসুমে ব্যাপকহারে গমে ব্লাস্টের আক্রমণ হয়। ২০১৭-১৮ মৌসুমে আমরা কৃষকদের গম চাষে নিরুৎসাহিত করি। যার কারণে কৃষকরা অনেকটা ক্ষতির হাত থেকে বেঁচে যায়। ২০১৮-১৯ মৌসুমে মিরপুর উপজেলায় ৪১৩ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চাষ হয় প্রায় ৬৫০ হেক্টর। চলতি ২০১৯-২০ অর্থবছরে ৬৫০ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে। চাষ হয়েছে প্রায় ১৩৫০ হেক্টর।

জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তদরের দেওয়া তথ্য মতে, ২০১৫-১৬ মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলায় ১৬ হাজার ৬৮৮ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। চাষ হয়েছিল প্রায় ১৬ হাজার ৭১০ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিলো ৫০ হাজার ১৩০ মেট্রিকটন। ২০১৬-১৭ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা  ছিল ১৩ হাজার ৮৩০ হেক্টর। চাষ হয়েছিল প্রায় ৪ হাজার ৩৭০ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিলো ১৫ হাজার ৭৩২ মেট্রিকটন। সে বছর ব্লাস্টের আক্রমণ দেখা দেয়।  এর ফলে ২০১৭-১৮ মৌসুমে কুষ্টিয়া জেলায় গম চাষে নিষেধাজ্ঞা দেওয়া হয়। ২০১৮-১৯ মৌসুমে লক্ষ্যমাত্রা ছিল ১০ হাজার ৩৬৮ হেক্টর। চাষ হয়েছিল প্রায় ৯ হাজার ২৯৫ হেক্টর। উৎপাদন হয়েছিল ৩৬ হাজার ২৫০ মেট্রিকটন। চলতি ২০১৯-২০ মৌসুমে জেলায় গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৯ হাজার ২৯৫ হেক্টর জমি। আবাদ হয়েছে ১১ হাজার ৫০৫ হেক্টর, উৎপাদন লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়েছে ৩৬ হাজার ৭১৫ মেট্রিকটন। গমের আবাদ ভালো হওয়ায় উৎপাদন বলে আশা করছেন ৪৫ হাজার ৪শ মেট্রিকটনের উপরে।  গমক্ষেত।  ছবি: বাংলানিউজচলতি মৌসুমে রেকর্ড পরিমাণ গমের চাষ হয়েছে। কুষ্টিয়ার দৌলতপুর উপজেলায় ৫ হাজার ৩শ ৮৭ হেক্টর, ভেড়ামারায় ১ হাজার ৬শ হেক্টর, মিরপুরে ১ হাজার ৩৫০ হেক্টর, কুমারখালীতে ১ হাজার ৫৫০ হেক্টর, কুষ্টিয়া সদরে ১ হাজার ১৫০ হেক্টর এবং খোকসা উপজেলায় ৪৬৮ হেক্টর জমিতে।  

কুষ্টিয়ার মিরপুর উপজেলার কচুবাড়ীয়া এলাকার গম চাষি আয়নাল হক বাংলানিউজকে জানান, গমে রোগ হওয়ার কারণে কয়েক বছর আগে অনেক ক্ষতি হয়েছিল। কৃষি অফিসের লোকজন এসে গম চাষ নিষেধ করেছিল। এজন্য গম চাষ করিনি। জমি তামাকের জন্য বর্গা দিয়েছিলাম। কিন্তু এবছর আবারো গম চাষ করতে বলেছে সবাই তাই গম চাষ করেছি। এবছর বেশ ভালো গম হয়েছে। দুইবছর এই জমিতে গম চাষ বন্ধ করে রেখেছিলাম। এত সুন্দর গম আগে কখনো হয়নি। এবার বেশ ভালো ফলন পাবো বলে আশা করছি।  

একই এলাকার কৃষক জুমির আলী বাংলানিউজকে জানান, আমি এক বিঘা জমিতে এবছর গমের চাষ করেছি। ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ হয়নি। তবে পাতায় মরিচা পড়ার মতো দেখা যাচ্ছে।  

মিরপুর উপজেলার সদরপুর এলাকার কাকিলাদহ এলাকার কৃষক কামরুজ্জামান বাংলানিউজকে জানান, গত বছর আমার জমিতে তামাক ছিল। এবছর দেড় বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। গম বেশ ভালো হয়েছে। বিগত বছরের তুলনায় এলাকায় গম চাষ বেড়েছে।  
মিরপুর উপজেলার চিথলিয়া এলাকার কৃষক মাজেদুল হক বাংলানিউজকে জানান, এবছর আমি ৬ বিঘা জমিতে বারি গম-২৮ এবং বারি গম-৩০ জাতের গম চাষ করেছি। অনান্য বছরের তুলনায় গম খুব ভালো হয়েছে। তবে কিছুদিন আগে গমের পাতার মরিচা রোগ দেখা দেয়। উপসহকারী কৃষি কর্মকর্তা সুকেশ রঞ্জন পালের পরামর্শে আমি নাটিভো নামে একটা ছত্রাকনাশক স্প্রে করি। এতে বেশ ভালো ফল পায়। আশা করছি গমে বেশ ভালো লাভ হবে।  

দৌলতপুর উপজেলার তারাগুনিয়া এলাকার কৃষক ফরিদ আহম্মেদ বাংলানিউজকে জানান, দুই বছর আগে গম চাষ করে রোগে গম নষ্ট হয়ে গিয়েছিল। এজন্য লোকসান হয়েছিল। এজন্য পরের বছর আর গম চাষ করিনি। এবার কৃষি অফিসের পরামর্শে আমি এক বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। বেশ ভালো হয়েছে। এবার কোনো রোগও হয়নি। আশা করছি গত দুই বছরের লোকসান এবার পুঁষিয়ে যাবে।  

ভেড়ামারা উপজেলার ঠাকুর দৌলতপুর এলাকার কৃষক দেলোয়ার হোসেন বাংলানিউজকে জানান, ব্লাস্টের কারণে দুই বছর গম চাষ করিনি। এবার দুই বিঘা জমিতে গম চাষ করেছি। আগের চেয়ে বেশ ভালো হয়েছে। রোগবলাই লাগেনি। দানাও বেশ ভালো।  

মিরপুর উপজেলা কৃষি কর্মকর্তা কৃষিবিদ রমেশ চন্দ্র ঘোষ বাংলানিউজকে জানান, এবছর মিরপুর উপজেলায় রেকর্ড পরিমাণ গমের চাষ হয়েছে। চলতি মৌসুমে ৬৫০ হেক্টর জমিতে গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা নির্ধারণ করা হয়। কিন্তু মিরপুর উপজেলায় গম চাষ হয়েছে প্রায় ১৩৫০ হেক্টর জমিতে। ২০১৫ সালে এ অঞ্চলে গমে ব্লাস্টের আক্রমণ মহামারী আকার ধারণ করে। সেসময় কৃষকরা ব্যাপক ক্ষতিগ্রস্ত হয়। পরবর্তী সময়ে বছর ২০১৬ সালে আমরা এ এলাকায় গম চাষে নিষেধাজ্ঞা জারি করি। এতে ব্লাস্টের প্রার্দুভাব কম হয়।  গমক্ষেত।  ছবি: বাংলানিউজতিনি আরো বলেন, গত বছর থেকে আমরা আবার গম চাষে কৃষকদের উদ্বুদ্ধ করছি। তারা পুনরায় গম চাষে আগ্রহ দেখিয়ে চাষ করছেন। কিছু কিছু জমিতে স্বল্প পরিমাণে গমের পাতায় মরিচা রোগ দেখা দেয়। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে তা প্রায় নিয়ন্ত্রণ করেছি ফেলেছি।

তিনি জানান, এ অঞ্চলের মাটি গম চাষের জন্য উপযুক্ত। আমরা কৃষকদের পরামর্শ দিয়ে বিভিন্ন রোগ প্রতিরোধী জাতের গম চাষের জন্য পরামর্শ দিচ্ছি।  

কুষ্টিয়া কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের অতিরিক্ত উপপরিচালক (শস্য) রঞ্জন কুমার প্রামানিক বাংলানিউজকে জানান, এবছর জেলায় গম চাষের লক্ষ্যমাত্রা ছাড়িয়েছে। আমরা ব্লাস্ট রোগের আক্রমণ যাতে না হয় এজন্য কৃষকদের বীজ শোধন করে বপন করিয়েছি। জেলাজুড়ে কোথাও ব্লাস্টের কোনো আক্রমণ দেখা দেয়নি। এছাড়া এবছর গম চাষের আবহাওয়া অনুকূলে রয়েছে। রোগবালাইও আমাদের নিয়ন্ত্রণে রয়েছে।  

তিনি বলেন, গম চাষে আমরা কৃষকদের সার, বীজ দিয়ে উদ্বুদ্ধ করছি। সেই সঙ্গে আমরা আধুনিক উপায়ে গম চাষের জন্য কৃষকদের প্রশিক্ষণ দিয়েছি।

বাংলাদেশ সময়: ০৯০৪ ঘণ্টা, মার্চ ০৫, ২০২০
এসএইচ

বাংলানিউজটোয়েন্টিফোর.কম'র প্রকাশিত/প্রচারিত কোনো সংবাদ, তথ্য, ছবি, আলোকচিত্র, রেখাচিত্র, ভিডিওচিত্র, অডিও কনটেন্ট কপিরাইট আইনে পূর্বানুমতি ছাড়া ব্যবহার করা যাবে না।