জানা গেছে, বুক ভরা স্বপ্ন নিয়ে গায়ের ঘাম পানি করে ক্ষেতে সবজি চাষ করে ভরে তুলেছেন জেলার চাষিরা। সবজি চাষ করে জীবিকার চাকা সচল রেখেছেন জেলার হাজার হাজার কৃষক পরিবার।
ভারতীয় সীমান্তবর্তী জেলা লালমনিরহাটের সবজি স্থানীয় চাহিদা মিটিয়ে চলে যায় রাজধানীসহ সারাদেশের বড় বড় বাজারে। দিনভর ক্ষেতের সবজি সংগ্রহ করে রাতে সেগুলো ট্রাকে ভরে পাঠানো হয় সারাদেশের বাজারে। পরদিন ভোরে ঢাকা চট্টগ্রামসহ বিভিন্ন জেলার বড় বড় বাজারে বিক্রি হত এসব টাটকা সবজি।
সারাদেশের চাহিদাকে বিবেচনায় রেখে চলতি মৌসুমেও বিভিন্ন জাতের সবজি চাষাবাদ করেছেন জেলার চাষিরা। বুক ভরা স্বপ্নে সন্তানতুল্য প্রতিটি সবজি বাগান বড় করেন পরম যত্নে। চাষিদের মাঠ ভরে আছে, করলা, শসা, বেগুন, শিম, বরবটি, লাউ, টমেটো, গাজর, মিষ্টিকুমড়াসহ নানান সবজি ও শাকে। মৌসুমের শুরুতে দাম ভাল পেয়ে বেজায় খুশি হলেও তা স্থায়ী হয়নি। সুদূর চীনের সেই প্রাণঘাতী করোনা ভাইরাস এসে মুহূর্তেই চুরমার করে দিয়েছে জেলার সবজি চাষিদের স্বপ্ন। ক্রেতার অভাবে মাঠেই নষ্ট হচ্ছে চাষিদের সবজি।
করোনা ভাইরাস সংক্রমণরোধে সরকার দেশকে অঘোষিত লকডাউন করেছে। ফলে বড় বড় মোকামে সবজির চাহিদা ও ক্রেতা নেই। তাই ব্যবসায়ীরাও সবজি কিনতে চাষিদের মাঠে ভিড়ছেন না। স্থানীয় বাজারেও চাহিদার তুলনায় যোগান বেশি হওয়ায় দামও নেই বললেই চলে। ফলে মুনাফা তো দূরের কথা ক্ষেতের সবজি সংগ্রহ ও পরিবহন খরচও উঠছে না। তাই ক্ষেতেই পচে নষ্ট হচ্ছে চাষিদের লালিত স্বপ্ন।
জেলার সবজি এলাকাখ্যাত বড় কমলাবাড়ী উত্তরপাড়া এলাকার কৃষক হাবিবুর রহমান জানান, প্রতি বছরের মত লাভের আশায় এ বছর প্রায় দেড় লাখ টাকা খরচে দেড় একর জমিতে বিভিন্ন জাতের সবজি চাষ করেছেন। সবজি বিক্রির শুরুতেই হঠাৎ করোনার ছোবলে লকডাউন হওয়ায় দরপতন ঘটেছে। এতে প্রতিমণ ১ হাজার ৬শ টাকা দরের সবজি এখন বিক্রি হচ্ছে মাত্র ৮০ টাকায়। এতে শ্রমিকের খরচও উঠছে হচ্ছে না। ফলে সবজির পরিচর্যা বন্ধ করেছেন তিনি। তবে করোনার এ দুর্যোগ মোকাবিলায় নেই কোনো প্রস্তুতি। ফলে ফসলের লোকসানসহ পরিবারের খাদ্যাভাব নিয়ে বড্ড চিন্তিত এ চাষি।
দোলাপাড়া গ্রামের কৃষক নুরুল ইসলাম জানান, কিছুদিন আগেও ক্ষেতেই করলা বিক্রি করেছেন প্রতিমণ আড়াই/তিন হাজার টাকায়। এখন তা বিক্রি হচ্ছে মাত্র এক/দেড়শ টাকায়। করলা ক্ষেত থেকে সংগ্রহ করা শ্রমিকের খরচও উঠছে না। অন্যের এক বিঘা জমি লিজ নিয়ে সবজি চাষ করে লোকসানের মুখে পড়েছেন তিনি। লিজের টাকা ও পরিবারের খরচ যোগান নিয়ে বড্ড চিন্তায় রয়েছেন এ বর্গাচাষি।
সবজি ক্ষেতের দিনমজুর তরনী কান্ত, শামীম ও আব্দুল মজিদ বাংলানিউজকে জানান, সারাবছর দৈনিক তিন/সাড়ে তিনশ টাকা মজুরিতে সবজি ক্ষেতে কাজ করেন তারা। এখন সবজির দাম নেই, লোকসানের কারণে মালিক কাজে ডাকেন না এবং করোনার প্রভাবে সরকার বাইরে না যাওয়ায় নির্দেশ দেওয়ায় তারা কর্মহীন হয়ে পড়েছেন।
সিংগিমারী গ্রামের সবজি চাষি আসাদুজ্জামান সাজু বাংলানিউজকে বলেন, চার বিঘা জমিতে চাষ করা দেশিজাতের বেগুন প্রথম দিকে ৪০ টাকা কেজি দরে বিক্রি করলেও এখন মাত্র দেড় থেকে দুই টাকা কেজিতে বিক্রি করতে হচ্ছে। সেটাও ক্রেতা নেই। ফলে মাঠেই পচে নষ্ট হচ্ছে। কেউ কেউ গরু ছাগলের জন্য কিনছেন। ক্রেতার অভাবে চলতি মৌসুমে কয়েক লাখ টাকার ক্ষতির আশঙ্কা করছেন এ চাষি।
সরকারি আদিতমারী কলেজের অবসরপ্রাপ্ত অর্থনীতি বিভাগের প্রধান আবু তাহের বাংলানিউজকে বলেন, ক্রেতা না থাকায় মাঠেই নষ্ট হচ্ছে চাষিদের ঘাম ঝড়া ফসল। চাষি সোনাখ্যাত সবজির বাজারে দরপতনের মন্দা প্রভাব পড়ছে জেলার তথা দেশের অর্থনীতিতে।
করোনা দুর্যোগ স্থায়ী হলে চাহিদা বৃদ্ধি পাবে তাই বর্তমান লোকসান হলেও স্বাস্থ্যবার্তা মেনে সবজি ক্ষেতের পরিচর্যার পরামর্শ দেন তিনি। একই সঙ্গে এসব বর্গাচাষিদের প্রণোদনাসহ করোনা দুর্যোগ মোকাবিলায় তাদের সহায়তা দিতে সরকারের প্রতি আহবান জানান তিনি।
বাংলাদেশ সময়: ০৯০৫ ঘণ্টা, এপ্রিল ০৭, ২০২০
আরএ