খাগড়াছড়ি: বলা হয় পৃথিবীতে পানীয়র মধ্যে চায়ের পরের অবস্থান হচ্ছে কফির। পশ্চিমা দেশগুলোতে ঘুম থেকে উঠে, আড্ডায় কিংবা মিটিংয়ের ফাঁকে কফি নিত্যদিনের সঙ্গী।
তবে, দেরিতে হলেও এই খাতকে গুরুত্ব দিচ্ছে সরকার। আর পাহাড়ের মাটিতে চাষের উপযোগী হিসেবে বাড়তি প্রাধান্য দেওয়া হচ্ছে। ভালো, উন্নত স্বাদের ও ঘ্রাণের কফি পেতে দীর্ঘ বছর ধরে কাজ করছে খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্র। ইতোমধ্যে সফলও হয়েছে। এখন কৃষক পর্যায়ে ছড়িয়ে দেওয়ার অপেক্ষা।
কৃষি সংশ্লিষ্ট গবেষকরা বলছেন, পৃথিবীতে ৬০ প্রজাতির কফি থাকলেও বাণিজ্যিকভাবে চাষাবাদ হয় ২টি জাতের কফি। একটি রোবাস্টা এবং অন্যটি অ্যারাবিক জাত। রোবাস্টা জাতের কফি গাছে রাস্ট রোগ কম হয়। অ্যারাবিক জাত আমাদের দেশে চাষের উপযোগী তবে, ফলন কম হয়। খোঁজ নিয়ে জানা গেছে, ২০০৩ সালে খাগড়াছড়ির বিভিন্ন জায়গার মধ্যে রামগড়ের বড়পিলাকে ৩০টি পরিবার এবং তৈকর্মা এলাকায় ২০ পরিবারকে ১৫০০ করে কফি গাছের চারা দেন পার্বত্য চট্টগ্রাম উন্নয়ন বোর্ড। পাশপাশি এই চারা রোপণের জন্য নগদ অর্থও দেওয়া হয়। অন্যান্য ফলের সঙ্গে কফি চাষ করলেও প্রক্রিয়াজাতকরণ ও বাজার ব্যবস্থাপনা না থাকায় এই চাষ মুখ থুবড়ে পড়ে।
এদিকে ২০০১ সাল থেকে কফি নিয়ে গবেষণা কার্যক্রম শুরু করে খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্র। এখন কেন্দ্রটিতে ৩৯৫টি রোবাস্টা গাছের ফলবাদনকারী বাগান রয়েছে। এছাড়াও অ্যারাবিক জাতের ২০০টি চারা নিয়ে আরও একটি নতুন বাগান স্থাপন করা হয়েছে। কফি পাহাড়ের ঢালে ছায়াযুক্ত গাছের নিচে ভালো হয়। তবে, অ্যারাবিক জাতের কফির জন্য তুলনামূলক বেশি উচ্চতার প্রয়োজন হয়। পাহাড়ে স্থান ভেদে গাছের আকার আকৃতি ভিন্ন হয়। ফলনেও ভিন্নতা দেখা যায়। প্রত্যেকটি গাছে ৭ থেকে ১০ কেজি পর্যন্ত ফলন হয়। প্রতি হেক্টরে রোবাস্টার ফলন সাড়ে ৭ হাজার থেকে ১০ হাজার কেজি। আর প্রতি অ্যারাবিকার ফলন সাড়ে ৩ হাজার থেকে ৬ হাজার কেজি। কৃষি গবেষণাকেন্দ্র থেকে ৩৯৫টি গাছ থেকে ৩ হাজার ১৬০কেজি ফলন পেয়ে থাকে।
ইতোমধ্যে কৃষিকের জন্য কফির প্রক্রিয়াজাতকরণের বেশ কয়েকটি প্রযুক্তি প্রস্তুত করেছে। এরমধ্যে বারি কফি পাল্লার, বারি ফি ডি-হলার, বারি কফি রোস্টার, কফি গ্রাইন্ডার অন্যতম।
কফি ও কাজুবাদাম গবেষণা, উন্নয়ন ও সম্প্রসারণে ২০০ কোটি টাকার প্রকল্পে গ্রহণ করেছে সরকার। প্রকল্পের আওতায় খাগড়াছড়ি, রাঙামাটি ও বান্দরবানের ২৫টি উপজেলায় কফি ও কাজু বাদাম চাষ সম্প্রসারণ, উৎপাদন বৃদ্ধি, প্রক্রিয়াজাতকরণ এবং বাজারজাত করার মাধ্যমে কৃষকের আয় ও কর্মসংস্থান সৃষ্টির উদ্যোগ নেওয়া হয়েছে। কফির বাণিজ্যিক উৎপাদন এগিয়ে নিতে স্থানীয়ভাবে কফির নতুন জাত উদ্ভাবনেও কাজ করছে বাংলাদেশ কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউট। নতুন জাতের নাম হবে বারি কফি-১। খাগড়াছড়ি কৃষি গবেষণাকেন্দ্রের মুখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা মুন্সী রশিদ আহমেদ বলেন, এ কেন্দ্রে ফলদানকারী রোবাস্টা ও অ্যারাবিকার গাছগুলো থেকেই নতুন অগ্রবর্তী লাইন তৈরির জন্য গবেষণা করা হচ্ছে। জাত হিসেবে স্বীকৃতি পেতে গেলে অগ্রবর্তী লাইনের ফলন, রোগবালাই ও মান নিয়ে তিন বছর গবেষণা করতে হয়। আমরা সেটা সম্পন্ন করেছি। আশা করি প্রক্রিয়া শেষে তা স্বীকৃতি পাবে।
রোবাস্টার ফলন অ্যারাবিকার আড়াই গুণ বেশি। তবে, অ্যারাবিকার ফ্লেভার ও টেস্ট রোবাস্টার চেয়ে ভালো, সেজন্য চাহিদাও বেশি। ক্যাফেইনের পরিমাণ রোবাস্টার বেশি।
কৃষি গবেষণা ইনস্টিটিউটের প্রধান বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা আবু তাহের মাসুদ বলেন, আমরা নিবিড়ভাবে রোবাস্টা ও অ্যারাবিকার চাষ পর্যবেক্ষণ করেছি। এ দুই প্রজাতির গাছ থেকেই আমরা নতুন এক জাত বারি কফি-১ প্রস্তাবনায় আনছি। আরও কিছু পরীক্ষা বাকি আছে। তারপর নিয়মমাফিক উপায়ে অনুমোদন প্রক্রিয়ায় যাবে। কফি গাছে রোগ বালাইয়ের ঝুঁকি কম, তাই অল্প পরিচর্যায় এর চাষ সম্ভব।
পার্বত্য চট্টগ্রাম বিয়য়ক মন্ত্রণালয়ের প্রস্তাবিত ‘পার্বত্য চট্টগ্রাম অঞ্চলে কফি ও কাজুবাদাম চাষের মাধ্যমে দারিদ্র্য হ্রাসকরণ’ শীর্ষক এ প্রকল্পে ব্যয় ধরা হয়েছে ৪৯ কোটি ৯৮ লাখ টাকা। যার পুরোটাই সরকারি অর্থায়নে করা হবে।
বান্দরবান সদর, রোয়াংছড়ি, রুমা এবং থানচি, রাঙামাটি সদর, নানিয়ারচর, কাপ্তাই এবং জুরাছড়ি; খাগড়াছড়ি সদর, মানিকছড়ি ও মাটিরাঙ্গার রামগড় উপজেলায় প্রকল্পটি বাস্তবায়ন হবে। অন্যান্য ফলের মত বাণিজ্যিকভাবে কফি চাষাবাদ করা গেলে দেশের চাহিদা মিটিয়ে বিদেশেও রপ্তারি করা যাবে, এমনটা আশা করছেন কৃষি বিজ্ঞানীরা।
বাংলাদেশ সময়: ০৮৫৪ ঘণ্টা, আগস্ট ০৪, ২০২১
এডি/এএটি