চাঁপাইনবাবগঞ্জ: ২শ বছর আগের যৌবন পাওয়া কুজা-রাজার আম বাগানটি যখন মুনাফালোভীদের কারণে ধ্বংসের শেষ প্রান্তে, ঠিক সেসময় বাগান রক্ষায় সরকারের বিশেষ প্রচেষ্টায় এখানেই প্রতিষ্ঠিত করা হলো ‘বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়াম’।
এটি পূর্ণাঙ্গরূপে প্রতিষ্ঠিত হলে এবার নাম পাবে বেনামি সব আম।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন, চলতি বছরই শেষ হবে লাইভ ম্যাংগো মিউজিয়ামের নির্মাণকাজ। ফলে এসব জাতের আমের বাজারমূল্য বৃদ্ধি পাবে। লাভবান হবেন চাষিরা। আর রাজস্ব পাবে সরকার।
বাগানটি ঘুরে দেখা গেছে, জেলার শিবগঞ্জ উপজেলার কানসাট মৌজার পার কানসাট ও মোবারকপুর ইউনিয়নের শিকারপুর মৌজা মিলিয়ে প্রায় ৩২ একর ৯৮ শতাংশ জমিতে ছোট বড় মিলিয়ে ৩ হাজার আম গাছের মধ্যে এখন রয়েছে প্রায় ২ হাজার আম গাছ। পাকিস্তান আমলের বেশ কিছু আম গাছ এখনও টিকে আছে।
স্থানীয়রা জানান, ১৯৪০ সালের আগ পর্যন্ত বিশাল এই বাগানটির মালিকানা ছিল ব্রিটিশ আমলের ইংরেজদের। দেশভাগের পর ব্রিটিশরা বাগানটি তৎকালিন কানসাট এলাকার জমিদার হিসেবে পরিচিত কুজা রাজার কাছে বিক্রি করে দেন। বাগানটি কিছুদিন ভোগের পর কুজা রাজা তার সব সম্পদ ছেড়ে ভারতে চলে গেলে সরকারের নিয়ন্ত্রণে চলে যায় রাজার সব সম্পত্তিসহ বিশাল এই বাগান। তখন থেকেই সরকারিভাবে নিয়ন্ত্রণ করা হয় কুজা রাজা নামে পরিচিত এই বাগানটি। ১৯৬৬ সালের দিকে বাগানটি পরিচর্যা ও দেখাশোনার দায়িত্ব পায় ঢাকার হর্টিকালচার। সে সময় বাগানে অনেক ছোট ছোট আম গাছ লাগানো হয়। তারা প্রায় ৫-৬ বছর থাকার পর বাগান ছেড়ে চলে যান। তখন থেকেই চাঁপাইনবাবগঞ্জ জেলা প্রশাসকের কার্যালয় বাগানটি দেখাশোনা করে। কিন্তু জেলা প্রশাসনের সঠিক তদারকি না থাকায় ধ্বংস হতে থাকে বাগানটি। একের পর এক গাছ মারা যেতে থাকে। বাগানটি পরিচর্যার অভাবে এর আয় দাঁড়ায় এক তৃতীয়াংশে। এ নিয়ে ২০১৯ সালে এ প্রতিবেদকের মাধ্যমে ‘ধ্বংসের দারপ্রান্তে কুজা রাজার বাগান’- এ শিরোনামে একটি সংবাদ প্রকাশের পর জেলা প্রশাসনের উদ্যোগে বাগানটি রক্ষার জন্য নেওয়া হয় বাউন্ডারি নির্মাণসহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা।
ইতোমধ্যেই বাগানটির গাছগুলো রক্ষায় পরিচর্যা আরম্ভ হয়েছে। মাদকের আখড়াগুলো ও অবৈধ বস্তি তুলে দিয়ে পুরো বাগানটির পরিচ্ছন্ন করার কাজ চলছে। জেলার ৩শ জাতের আমগাছ এ বাগানে ২০টি জোনে ভাগ করে সংরক্ষণ করা হবে। নির্মাণ হবে বঙ্গবন্ধু লাইভ ম্যাঙ্গো মিউজিয়াম, ২শ ফুট উঁচু আম গাছে উঠে আমপাড়ার ব্যবস্থা, সর্বোপরি আমের জাতগুলো রক্ষায় জার্ম প্লাজম সেন্টারসহ একগুচ্ছ পরিকল্পনা হাতে নেওয়া হচ্ছে। আর এ জন্য ইতোমধ্যেই এক কোটি টাকা বরাদ্দ দেওয়া হয়েছে।
এদিকে বেনামি সব আম সংরক্ষণের উদ্যোগ নেওয়ায় খুশি স্থানীয় আম চাষি ও ব্যবসায়ীরা। সেইসঙ্গে আমের দাম নিয়ে আশার আলো দেখছেন তারা।
স্থানীয় আম চাষি ইসমাঈল খান শামিম জানান, চাঁপাইনবাবগঞ্জের আমকে দেশে –বিদেশে তুলে ধরতে ও দেশের বিভিন্ন জাত এবং হাইব্রিড জাতের ৮শ আমের জাত সংরক্ষণে ভূমিকা রাখবে এ মিউজিয়াম।
চাঁপাইনবাবগঞ্জ সদরের তরুণ উদ্যোক্তা মুনজের আলম জানান, এ মিউজিয়ামটি ঘিরে একটি পর্যটন স্পট তৈরি হবে। এতে জেলার অর্থনীতিও মজবুত হবে। গত ৫ বছরের আমের হারানো ঐতিহ্য ফিরে পাবে জেলার আম সংশ্লিষ্টরা।
দেশের বৃহত্তম আম বাজার কানসাট আম আড়তদার সমিতির সাধারণ সম্পাদক ওমর ফারুক টিপু জানান, গত কয়েক বছর ধরে তারা কোটি কোটি টাকা লোকসান গুনছেন। অন্য জেলার আম দেশের বিভিন্ন স্থানে চাঁপাইনবাবগঞ্জের আম হিসেবে বিক্রি হওয়ায় সংকট আরও বেড়েছে। এটি প্রতিষ্ঠিত হলে জেলার আমকে চিনবে দেশ বিদেশের পর্যটকরা। এতে করে জেলার অর্থনীতি সমৃদ্ধির পাশাপাশি সরকারেরও রাজস্ব বাড়বে।
এদিকে পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তুলতে এবং জেলার আম শিল্পকে বাঁচাতে নেওয়া হয় একগুচ্ছ পরিকল্পনার কথা জানিয়ে শিবগঞ্জ উপজেলা নির্বাহী কর্মকর্তা মো. সাকিব আল রাব্বী জানান, আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জে নামি দামি আমের চেয়ে বেনামি ও অপরিচিত আমের সংখ্যা বেশি। চাঁপাইনবাবগঞ্জের বেনামি আমগুলো বাহারি সব নাম পাবে। এসব আমের মধ্যে এমন অনেক আম আছে, যেগুলো স্বাদে, গন্ধে অতুলনীয়। নাম-পরিচয় বা প্রচার না থাকায় এসব আম বাজারে কদর পায় না। দামও পান না চাষিরা। ফলে অনেকেই গুটি জাতের এসব আম গাছ কেটে ফেলছেন। এতে অনেক সুস্বাদু আমও বিলুপ্ত হয়ে গেছে এবং বিলুপ্তির পথে আছে আরও অনেক আমের জাতও। আর নতুনভাবে নাম পাওয়া জাতগুলো সংরক্ষণ করা হবে এই মিউজিয়ামে। তাই আমকেন্দ্রিক পর্যটন বিকাশে এবং সুস্বাদু আম রক্ষা ও জনপ্রিয় করতেই সরকারের ডেল্টা পরিকল্পনার অংশ হিসেবে জেলার কানসাটে এ মিউজিয়ামটি গড়ে তোলার উদ্যোগ গ্রহণ করেছে জেলা প্রশাসন। পাশাপাশি বাগানের একপাশে থাকবে পর্যটকদের জন্য আকর্ষণীয় কিছু স্পট।
চাঁপাইনবাবগঞ্জের জেলা প্রশাসক এস এম গালিব খান জানান, এরই মধ্যে ম্যাংগোপিডিয়া নামে ১০০টি প্রচলিত ও জনপ্রিয় আমের একটি প্রকাশনা অ্যালবামও প্রকাশ করেছে স্থানীয় প্রশাসন। চলতি বছরেই শেষ হবে মিউজিয়ামের নির্মাণ কাজ। আর এটি নির্মাণ হলে আমজাত পণ্য ও আমের পরিচিতি বৃদ্ধির পাশাপাশি ম্যাংগো ট্যুরিজমের ক্ষেত্রে সৃষ্টি হবে নতুন দিগন্ত।
অপরদিকে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের মূখ্য বৈজ্ঞানিক কর্মকতা মোখলেসুর রহমান বলছেন, আমের জাত বিকাশে এটি গুরুত্বপূর্ণ উদ্যোগ। ভবিষ্যতের গবেষণা ও জাতের উন্নয়নে এ উদ্যোগ অবদান রাখবে। মিউজিয়ামে সংরক্ষিত জাত থেকে গবেষণার মাধ্যমে আরও নতুন নতুন জাতের আম উপহার পাবে দেশ। এতে বিলুপ্তির হাত থেকে রক্ষা পাবে আমের বিভিন্ন জাত। আর উপকৃত হবে আম চাষিরা।
সংশ্লিষ্টরা বলছেন দেশে ছড়িয়ে ছিটিয়ে আছে প্রায় ৮শ জাতের আম। এর মধ্যে আমের রাজধানী চাঁপাইনবাবগঞ্জেই রয়েছে সাড়ে ৩শ জাতের আম। খুব শিগগিরই এই মিউজিয়ামের উদ্বোধন হলে আমে বিপ্লব ঘটবে।
বাংলাদেশ সময়: ০৭৫৪ ঘণ্টা, ফেব্রুয়ারি ২৮, ২০২২
আরএ