পটুয়াখালী: যে দিকে চোখ যায়, সেদিকেই সবুজের সমারোহ। এ যেন তরমুজ গাছের লতায় জড়ানো উপকূল।
হঠাৎ করেই তরমুজ গাছের পাতা কুঁকড়ে ফুল ঝরে গিয়ে গাছও মরে যাচ্ছে। এমনকি ফল ধরলেও তা ফেটে হচ্ছে নষ্ট।
দক্ষিণাঞ্চলের উপকূলীয় উপজেলা রাঙ্গাবালী তরমুজ উৎপাদনে অন্যতম প্রধান এলাকা হিসেবে পরিচিত। বিগত কয়েক বছর চাষিরা লাভের মুখ দেখলেও এবার উপজেলার অনেক তরমুজ ক্ষেতই আক্তান্ত হয়েছে রোগে।
ফলে চাষিরা এখন দিশেহারা। এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে ঋণ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন অনেকে। আশা ছিল, ভালো দামে তরমুজ বিক্রি করে শোধ করবেন ঋণ। সেই সঙ্গে স্বচ্ছলতা আসবে সংসারে। কিন্তু এখন ঋণ পরিশোধ করাই দায় হয়ে পড়েছে।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী এ বছর শতকরা ১০ শতাংশ তরমুজ ক্ষেত রোগের আক্রমণে নষ্ট হয়ে গেছে। এতে প্রায় একশ’ কোটি টাকারও বেশি ক্ষতি হয়েছে বলে প্রাথমিকভাবে ধারণা করা হচ্ছে।
রাঙ্গাবালী উপজেলার কাউখালী, হরিদ্রখালী, গহিনখালী, নেতা, আমলিবাড়িয়া, কাজির হাওলা ও চর ইমারশনসহ অন্তত ১০টি চরে দেখা গেছে রোগের সংক্রমণ। তবে এখনো রোগটির নাম বলতে পারেনি কৃষি বিভাগ।
রোগটিতে কোনো কোনো ক্ষেতের গাছ মরে গেছে, কোনো ক্ষেতে ফল বড় হচ্ছে না, আবার কোনো কোনো ক্ষেতে ফলের ওপর ফোটা ফোটা হলুদ দাগ পড়েছে। স্বপ্নের তরমুজ গাছ মরে যাওয়ায় কেউ কেউ ক্ষেত ফেলে চলে গেছেন।
পরিত্যক্ত এসব ক্ষেতের মরা গাছগুলো গবাদিপশুর খাবার হয়েছে। এসব তরমুজ ক্ষেতগুলো এখন গবাদিপশুর চারণ ভূমিতে পরিণত হয়েছে।
তরমুজ চাষি আনোয়ার হোসেন (৩৫) বলেন, আমি ভোলার বোরহানউদ্দিন উপজেলার বড়কাছিয়া এলাকা থেকে এসে এখানে ছয় একর জমিতে পাঁচ লাখ টাকা খরচ করে তরমুজ আবাদ করছি। চার বছর ধরে আমি এ এলাকায় তরমুজ আবাদ করি। প্রত্যেকবার লাভের মুখ দেখলেও এবার মূলধনই শেষ। তাই বাধ্য হয়ে ক্ষেতের আশা ছেড়ে দিয়েছি।
দুঃখ, হতাশা, ঋণের দায় নিয়ে ছলছল চোখে ক্ষেত ছেড়ে চলে যাচ্ছেন তিনি।
তিনি বলেন, ধারদেনা করে লাভের আশায় তরমুজ চাষ করছি। কিন্তু ভাইরাসে (অজানা রোগ) এবার সব শ্যাষ। মাসের পরে মাস কাঠপোড়া রোদে পুড়ে দিন-রাত শ্রম দিলাম, এখন এর সবই বৃথা।
তরমুজ চাষি বেল্লাল প্যাদা (৪৫) বলেন, প্রায় ১৫ বছর ধরে আমি তরমুজের চাষ করি। এবারও ১০ একর জমিতে আট লাখ ৫০ হাজার টাকা খরচ করে তরমুজ আবাদ করছি। কিন্তু লাভ তো দূরের কথা, আসলই উঠছে না। মাত্র দুই লাখ ৮০ হাজার টাকার তরমুজ বিক্রি করতে পারছি।
স্থানীয় তরমুজ চাষি আক্তার হোসেন, মেজবাহউদ্দিন, রফিক প্যাদা, মিথেল হাওলাদার, মফিদুল হাওলাদার, রায়হান মৃধাসহ বেশ কয়েকজন চাষি জানান, যারা তরমুজ চাষ করেন, তাদের অনেকেই অন্যের জমি একসনা (এক বছরের জন্য ভাড়া নেন) বন্দোবস্ত নিয়ে আবাদ করেন। জমিসহ প্রতি একরে ক্ষেত প্রস্তুত থেকে ফল কাটা পর্যন্ত ৭০-৮৫ হাজার টাকা খরচ হয়। বেশিরভাগ চাষি এনজিও বা মহাজনের কাছ থেকে চড়া সুদে ঋণ নিয়ে তরমুজ চাষ করেছেন। কেউ কেউ আবার আড়তদারের কাছ থেকে দাদন এনে তরমুজ আবাদ করেছেন। কিন্তু চলতি মৌসুমে অজানা রোগের কারণে ক্ষতিগ্রস্ত চাষিরা এবার সর্বস্বান্ত। কীভাবে পাওনা টাকা পরিশোধ করবেন, তা নিয়ে এখন তারা দুশ্চিন্তায় রয়েছেন।
কৃষি বিভাগ সূত্রে জানা যায়, তরমুজ লাভজনক ফল হওয়ায় প্রতিবছরই এর আবাদ বাড়ছে এ অঞ্চলে। চলতি মৌসুমে এ উপজেলার ছয়টি ইউনিয়নে নয় হাজার ৪৪৯ হেক্টর জমিতে তরমুজ আবাদ হয়েছে। যা গত বছরের চেয়ে এক হাজার ৮১৯ হেক্টর বেশি জমি।
কৃষি বিভাগের তথ্য অনুযায়ী, প্রতি হেক্টরে ৩৫ থেকে ৪০ মেট্রিকটন হারে তরমুজ উৎপাদনের লক্ষ্যমাত্রা ছিল। যা থেকে প্রায় সাড়ে পাঁচশ’ কোটি টাকার তরমুজ বিক্রির সম্ভাবনা ছিল। কিন্তু আবাদের ১০ শতাংশ অর্থাৎ প্রায় এক হাজার হেক্টর ক্ষেত নষ্ট হয়ে গেছে। ফলে একশ’ কোটি টাকার লোকসান হবে চাষিদের, এমটাই ভাষ্য কৃষি বিভাগের।
কিন্তু কৃষকরা বলছেন, ক্ষতির পরিমাণ আরও অনেক বেশি।
সম্প্রতি জেলার আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তাদের একটি দল রোগাক্রান্ত তরমুজ ক্ষেতগুলো পরিদর্শন করেছে। তারা এটিকে পাতা কোঁকড়ানো রোগ বলছেন। আর চাষিরা বলছেন, এটি একটি ‘ভাইরাস’।
জলবায়ু নিয়ে কাজ করা সংস্থা ভার্কের উপজেলা সমন্বয়কারী মোহসীন তালুকদার বলেন, তিনটি কারণে তরমুজ ক্ষেতে এ রোগ দেখা দিতে পারে বলে ধারণা করছি। জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাবে বৈশ্বিক উঞ্চতা বৃদ্ধি ও লবণাক্ততা এবং পানির উচ্চতাও বৃদ্ধি পেয়ে ধীরে ধীরে এর প্রভাব দৃশ্যমান হতে শুরু করেছে। উপকূলীয় এলাকা দিন ও রাতে তাপমাত্রার ব্যাপক তারতম্য দেখা দিয়েছে। দ্বিতীয়ত সঠিক পরামর্শ না পেয়ে কৃষক জমিতে অধিকমাত্রায় কীটনাশক প্রয়োগ করছেন। তৃতীয়ত একই জমিতে বার বার তরমুজ আবাদ করায় এমনটা হতে পারে।
তিনি আরও বলেন, এ ক্ষতি থেকে আগামীতে পরিত্রাণ পেতে কৃষকদের জলবায়ু সহিষ্ণু ফসল উৎপাদন ও সচেতনতা বৃদ্ধির লক্ষ্যে কাজ করতে হবে।
উপজেলা কৃষি সম্প্রসারণ কর্মকর্তা মো. আসাদুজ্জামান বলেন, তরমুজ আবাদের শুরুতে দিনে ও রাতে তাপমাত্রার ব্যাপক পার্থক্যের কারণে গাছে পোকা মাকড়ের প্রাদুর্ভাব দেখা দেয়। এ কারণে কোনো পরামর্শ ছাড়া অতিরিক্ত বালাইনাশক (কীটনাশক) প্রয়োগের কারণে পাতা কোঁকড়ানো রোগ হতে পারে বলে ধারণা করছি। আক্রান্ত এলাকার কৃষকদের কীটনাশক ও মাকড়নাশক স্প্রে করার ব্যবহার সম্পর্কে পরামর্শ সম্বলিত প্রচারপত্র বিতরণ করা হয়েছে।
এ বিষয়ে আঞ্চলিক উদ্যানতত্ত্ব গবেষণা কেন্দ্রের বৈজ্ঞানিক কর্মকর্তা ইফতেকার মাহমুদ বলেন, রাঙ্গাবালীর তরমুজ থেকে প্রথম যে বিষয়গুলো দেখেছি, তা হলো গাছের কাণ্ড ফেটে রস বের হচ্ছে, কাণ্ড কালো হয়ে গেছে, গাছ ঢলে পড়েছে, পাতা কুঁকড়ে গেছে। আসলে এক জমিতে এক ফসল বার বার ফলালে রোগবালাই বেশি হয়। পোকা-মাকড়ের উপদ্রপও দেখা দেয়।
বর্তমানে এলাকা ভিত্তিক পরিবেশ, পরিস্থিতি, আবহাওয়া ও তাপমাত্রা সহিষ্ণু ফসলের জাত উদ্ভাবনের দিকে সংশ্লিষ্টদের গবেষণা বাড়ানোর দাবি জানিয়েছেন স্থানীয়রা।
বাংলাদেশ সময়: ১৭৫৬ ঘণ্টা, এপ্রিল ১০, ২০২২
এসআই